বিসিএসের ৩০তম ব্যাচের কাজে যোগদানের ৫ বছর পূর্ণ হয়েছে শনিবার। এই ব্যাচে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন সুশান্ত পাল যাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অনেক।
সুশান্ত পালের ডাক নাম বাপ্পি। শুধু ৩০তম বিসিএসেই নয়, এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সব বিসিএস পরীক্ষায় ফলাফলের দিক থেকে তিনি সর্বোচ্চ নম্বরের অধিকারী। বর্তমানে কর্মরত আছেন সহকারি কমিশনার কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট হিসেবেএ।
চ্যানেল অাই অনলাইনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ কর্মকর্তা জানিয়েছেন জীবনের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে অনেক উত্থান-পতনের পর সফল হওয়ার গল্প। দিকনির্দেশেনা দিয়েছেন বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য।
চট্টগ্রামের ছেলে সুশান্ত পাল। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিলেন। ক্লাসের ২ রোলটি বরাদ্দ ছিলো তার জন্য। তবে অষ্টম শ্রেণীতে উঠে প্রথম হয়ে যান। এর পেছনে রয়েছে এক মজার ঘটনা। ‘আমি কখনোই প্রথম হতে পারতাম না। তবে প্রথম যে হতো সে যখন অন্য স্কুলে চলে যায় তখনই আমি প্রথম হয়ে যাই,’ হেসে বলেন তিনি।
অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পান। ২০০০ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পাশ করেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল স্কুল থেকে ৮৬১ নম্বর পেয়ে। এইচএসসি পাশ করেন ২০০২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে। সেখানেও ছিল ভাল ফলাফলের ধারা।
পড়াশোনা করতে খুব ভালবাসতেন বর্তমানের এই কাস্টমস কর্মকর্তা। বিশেষ করে সাহিত্যের প্রতি তার ছিল আজন্ম আকর্ষণ। তাই নিজেই গড়ে তুলেছেন ব্যক্তিগত লাইব্রেরি যেখানে এখন ৬,০০০ বই রয়েছে। খুব ইচ্ছে ছিল ইংরেজি সাহিত্যে পড়ার। সেজন্য এইচএসসি পড়াকালেই পড়ে ফেলেন ইংরেজি সাহিত্যের নামি লেখকদের অনেক বই। তবে মা বাবা কখনোই চাইতেন না ছেলে সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করুক। তাই মা-বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী পরীক্ষা দেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। অনিচ্ছা আর অনাগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করেন কম্পিউটার প্রকৌশল বিষয়ে। তবে বিষয়টার প্রতি অনাগ্রহ থাকায় শুরু থেকেই ফলাফল খারাপ হতে থাকে। এক পর্যায়ে ৪ বছরেরর মাথায় যখন সব বন্ধুরা পাশ করে চলে যান, যোগ দেন কর্মক্ষেত্রে; তখনও তিনি চুয়েটের ছাত্র।
সময়টা অনেক চ্যালেজ্ঞিং ছিলো সুশান্ত পালের জন্য। ইচ্ছা ছিল সফল ব্যবসায়ী হবার। তাই মনে মনে ধারণা পোষণ করতেন, ব্যবসায়ী হতে হলে অনার্স কমপ্লিট করার দরকার নেই। সেসময় চার ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। তবে বিষয়টাকে কেউ ভাল চোখে দেখতো না। শিক্ষাজীবনে দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপমানিত হতে হতো তার মা-বাবা ও একমাত্র ভাইকেও। আর তিরস্কারের মুখোমুখি হতেন বাপ্পী।
সেসময় তিনি সবার কাছে এতটাই মূল্যহীন হয়ে পড়েন যে কাউকে ফোন করলেও কেউ কল রিসিভ করতো না। তাকে ডাকা হতো না কোন গেট টুগেদার বা পার্টিতে। চুয়েটে প্রতিনিয়তই অপমানিত হতেন বন্ধু ও শিক্ষকদের দ্বারা । সবার কাছে এই অগ্রহণযোগ্যতা মেনে নিতে কষ্ট হতো তার। তারপরও প্রতিনিয়ত বাঁচার লড়াই করে চলেছিলেন। এক পর্যায়ে জীবটাই অসহনীয় হয়ে ওঠে। সিদ্ধান্ত নেন আত্মহত্যার। এরই মাঝে এক সন্ধ্যায় হাতে নিয়ে বসেন বিষের পেয়ালা। হঠাৎ করে চোখের সামনে ভেসে ওঠে মমতাময়ী মায়ের মুখটা। শত বিপদ ও প্রতিকূলতার মাঝেও যে মা তাকে সাহস যুগিয়ে গেছেন। সেদিন সেই মায়ের কারণেই জীবনে ফিরে আসেন সুশান্ত পাল।
জীবনে শুধু বেঁচে থাকাটাকেই সবচেয়ে বড় বিষয় বলে মনে করেন তিনি।
হঠাৎ একদিন চায়ের দোকানে বসে তার দুই বন্ধু সত্যজিৎ ও পলাশ এর মাধ্যমে জানতে পারেন বিসিএস সম্পর্কে। দুই বন্ধু তাকে উদ্বুদ্ধ করেন বিসিএস দিতে। বন্ধু মারফত জানতে পারেন বিসিএস দিলে এমন একটা চাকুরি পাওয়া যায় যেখানে সবাই অনেক সম্মান করে। সমাজে পাওয়া যায় অন্যরকম এক কদর। তার এই চাকুরি তার বাবা-মায়ের জীবনেও সম্মান এনে দেবে। তখন থেকেই ভাবতে শুরু করেন বিসিএস নিয়ে। শুরু করেন পড়াশোনা। সেসঙ্গে আপ্রাণ চেষ্টা করেন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেন।
তার বিসিএসে’র ফরম পূরণের দিনটিও ছিলো অন্যদের থেকে আলাদা। সেদিনই ছিল ফরম পূরণ এবং জমাদানের শেষ দিন। একইদিন প্রকাশ হয় তার বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ফলাফল।
এরপর আর কোনদিকে না তাকিয়ে শুধুই পড়েছেন। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বাপ্পীর মাথায় তখন জেদ চেপে বসে: সফল তাকে হতেই হবে। পড়তে পড়তে অনেক রাত নির্ঘুম কেটেছে তার। দিনে সেসময় প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন। তবে সবচেয়ে বেশি পড়েছেন বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে। টিউশনি ও একটি কোচিং সেন্টারের কর্ণধার হওয়ায় বাংলা, ইংরেজি, অংক ও বিজ্ঞানে আগে থেকেই ছিলেন দক্ষ।
একইসঙ্গে চলে তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র জন্য প্রস্তুতি।
কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ের পর একে একে সফল হন প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায়। এরপর ভাইভা দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন ফলাফলের জন্য। সেসময় প্রতিদিনই গুজব ছড়াতো ফল প্রকাশের। এভাবে চলতে চলতে ২০১১ সালের ২ নভেম্বর কাছের এক বড় ভাই তাকে মুঠোফোনে জানান, ‘সুশান্ত আজ ফল প্রকাশ হবে।’ সূত্রটা নির্ভরযোগ্য হওয়াতে টেনশনে পড়ে যান অনেক। টেনশন কমাতেই বসে পড়েন মুভি দেখতে। কিন্তু কোন কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছিল না। এরই মাঝে বিকেল চারটার দিকে আরেকটা ফোন অাসে। জানায়, ‘সুশান্ত, তোমার রেজাল্ট হয়েছে। তুমি কাস্টমসে প্রথম হয়েছো।’ কথাটা বিশ্বাস হতে চায় না তার। নিজে কম্পিউটার খুলে বসেন। তবে সেসময় পিএসসির ওয়েবসাইটে অনেক লোড থাকায় কোনভাবেই লগইন করতে পারছিলেন না। অনেকবারের চেষ্টায় সক্ষম হন পিডিএফ ফাইলটা ডাউনলোড করতে। কিন্তু ডাউনলোড হওয়া ফরম্যাটটি তার কম্পিউটারে সাপোর্টেড ছিল না।
অনেক কষ্ট করে গুগল থেকে আবার পিডিএফ নামিয়ে ফলাফল দেখা শুরু করেন। সেখানে কাস্টমস ক্যাডারে প্রথমেই দেখতে পান তার ‘৩০২৬৫৩’ রোল নম্বরটি। ভাবতে থাকেন মুদ্রণ ত্রুটি। অচিরেই সংশোধনী আসবে, সেখানে তার রোল নম্বরটি থাকবে না। এভাবে প্রায় ১০ মিনিট অপেক্ষার পর যখন আবারও রোল নম্বরটি ১-এ দেখতে পান তখন বিশ্বাস করেন।
দৌড়ে যান মায়ের কাছে। মাকে গিয়ে বলেন, ‘মা বিসিএসে’র রেজাল্ট দিয়েছে। কাস্টমসে আমার রোল নম্বরটা ১ নম্বরে। মা চিৎকার করে বলে ওঠেন: তুই ফার্স্ট হয়েছিস? এরপর মা আমাকে জড়িয়ে ধরেন। অঝোরে কাঁদতে থাকেন। ওই অনুভূতিটা ছিলো একেবারেই অন্যরকম। বলে বোঝানো যাবে না। বুঝতে পারছিলাম এক মুহূর্ত আগের সুশান্ত পাল আর এই সুশান্ত পালের মধ্যে অনেক তফাৎ। এখন আমি ফোন দিলে সবাই আমার ফোনটা ধরবে। আমাকে গুরুত্ব দেবে। ২০১১ সালের নভেম্বরে ২ তারিখ ফলাফলের দিন আমার দ্বিতীয় বার জন্ম হয়।’
কাকতালীয়ভাবে সেদিনটি ছিল তার জন্মদিন। তাই দিনটিকে জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ও জন্মদিনের শ্রেষ্ঠ উপহার হিসেবে তার প্রথম হওয়াকে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।
তার জীবনের অনুপ্রেরণা হিসেবে মা-বাবা, ও ভাই ছাড়া আর যে মানুষটাকে বারবার স্মরণ করেন, তার সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি তার। তবে আত্মিক এক বন্ধনে আবদ্ধ তারা। ইন্ডিয়ান অবাঙালি এই নারীর নাম রিতু সনি সোধি যিনি আমেরিকা প্রবাসি চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্ট। সুশান্ত পালের অনেক শ্রদ্ধাভাজন এই নারী । জীবনের গুরু হিসেবে তিনি এ নারীকে মানেন । চরম হতাশার মাঝে যখন নিমজ্জিত ছিলেন তখন এই নারী তাকে সাহস যুগিয়েছেন। তিনি সবসময় তাকে বলতেন ‘ বাপ্পি তুমি পারবে’।
প্রচণ্ড জেদী এ কর্মকর্তা জীবনের দুঃখ গুলোকেই নিয়েছেন অনুপ্রেরণা হিসেবে। চাকরি জীবনে প্রতিনিয়তই হয়েছেন চ্যালেঞ্জের সস্মুখীন। স্বর্ণ চোরাচালান ঠেকিয়ে দিতে অনেক ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বিসিএস পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘বিসিএসে ভালো করতে হলে পড়তে হবে অনেক বেশি। পড়ার কোন বিকল্প নেই। তবে এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের মূলমন্ত্রটা হলো কী কী পড়তে হবে না এটা জানা। প্রশ্ন পড়তে হবে অনেক বেশি। যত বেশি প্রশ্ন সমাধান করা যাবে ততো বেশি ধারণা পাওয়া যাবে প্রশ্নের ধরণ সম্পর্কে। বই পড়ার সময় দাগিয়ে পড়াটা অনেক বেশি কার্যকর। তবে একটা বই শেষ করে সেটা রিভিশন দেয়ার জন্য সেই সাবজেক্টের অন্য এক সেটের বই পড়াটা অনেক বেশি ভালো। এতে করে আগের প্রায় ৭০ ভাগ পড়া হয়ে যায় এবং এর সঙ্গে নতুন আরও ৩০ ভাগ যুক্ত হয়।
সাজেশন করে পড়াটা এক্ষেত্রে অনেক কার্যকর উল্লেখ করে এ কর্মকর্তা বলেন, নিজে থেকেই বুঝতে হবে কোন কোন বিষয়গুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ । এক্ষেত্রে চোখ কান খোলা রেখে পড়াশোনার পাশাপাশি প্রতিদিন ৫-৬ টি পেপার পড়ার পরামর্শ তার।
সর্বোপরি পরিশ্রমকেই সফলতার চাবিকাঠি বলে মনে করেন সুশান্ত পাল।
তবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে ফেসবুকে মন্তব্য করায় এ কাস্টমস কর্মকর্তাকে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হতে হয়। পরে তিনি ফেসবুকে ক্ষমা চেয়ে পোস্টটি মুছে ফেলেন। সেসময় তাৎক্ষণিকভাবে তাকে রংপুরে বদলী করা হয়েছিলো। একইসঙ্গে তার মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও আদেশ দেয়া হয়েছিল।ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে আইসিটি অাইনে মামলা চলমান রয়েছে।