বেশ কিছুদিন ধরেই প্রধান বিচারপতি বনাম সরকার যেন কিছুটা মুখোমুখি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইনের শাসন ইত্যাদি প্রশ্নে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য এবং তার প্রেক্ষিতে সরকারের সর্বোচ্চ মহল অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া কিছুটা ‘বিতর্ক’ তৈরি করছে।
‘বিতর্ক’ শব্দটিকে আমরা বন্ধনীর ভেতরে রাখছি এ কারণে যে, এটি ইংরেজি ‘ডিবেট’ যার পারিভাষিক অর্থ ঝগড়া-ফ্যাসাদ নয়, বরং যুক্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনা এবং একটি রাষ্ট্রের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এই হেলদি ডিবেট বা স্বাস্থ্যকর বিতর্ক খুবই জরুরি।
বলাই হয়, একটি রাষ্ট্র কতটা সভ্য, কতটা মানবিক এবং কতটা গণতান্ত্রিক-তা নির্ভর করে সেখানে আইনের শাসন কতটা শক্তিশালী। অর্থাৎ ওই রাষ্ট্রের আইনগুলো কতটা গণতান্ত্রিক এবং সেই আইন সরকার ও জনগণ কতটা মেনে চলে এবং বিচার বিভাগ কতটা স্বাধীন এবং বিচারকরা কতটা সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ।
পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রই আইনের দ্বারা পরিচালিত। তার অর্থ এই নয় যে, সকল রাষ্ট্রেই আইনের শাসন রয়েছে। হিটলার, মুসোলিনীর মতো একনায়ক সরকারেরও শাসনের ভিত্তি ছিল আইন। কিন্তু তারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেননি। হাল আমলেও আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত এবং আইনি ভিত্তিতে পরিচালিত বহু সরকার দেখব, যারা আইনের শাসন নিশ্চিত করেনি বা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আমাদের প্রধান বিচারপতি জনাব সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এমনকি আদালতেও বারবার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় নির্বাহী বিভাগ হস্তক্ষেপ করছে। বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়, দেশে আইনের শাসন নেই-এরকম কথা তিনি প্রায়ই বলছেন। যদিও সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, কোনো বিষয় নিয়ে প্রধান বিচারপতির ক্ষোভ থাকলে তিনি পাবলিকলি এসব না বলে সরাসরি সরকারের সাথে বিশেষ করে সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে কথা বলতে পারেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এমনও বলেছেন যে, প্রধান বিচারপতির এত বেশি কথা বলা উচিত নয়। তবে প্রধান বিচারপতি বলছেন, তিনি এসব কথা বলতে বাধ্য হচ্ছেন।
এ অবস্থায় কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, সরকার ও বিচার বিভাগ কি তাহলে মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেলো? আমরা বরং বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে পারি। কারণ যেকোনো বিষয়েই তর্ক হওয়া উচিত। ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’ এই প্রবাদের অর্থ অনেক সময়ই বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। কেননা তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়েই প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসে। সেটি আইনের শাসন, গণতন্ত্র, রাজনীতি, বাকস্বাধীনতা-যে ইস্যুই হোক না কেন।
বিতর্ক জরুরি, কারণ এর মাধ্যমে ভিন্নমত জানা যায়। আর গণতন্ত্রের পূর্বশর্তই হলো ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা। দেশে আইনের শাসন আছে কি নেই-এই নিয়ে এখন বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে যে ধরনের ভিন্নমত পরিলক্ষিত হচ্ছে, যে ধরনের তর্কের খোরাক আমরা পাচ্ছি, সেটি বরং জারি রাখাই জরুরি। কেননা এই তর্কের ভেতর দিয়েই বেরিয়ে আসবে প্রকৃত সত্য।
দেশে আইনের শাসন নেই-এ কথা বলার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি দেশে পুরোমাত্রায় আইনের শাসন বিদ্যমান, এমন দাবিও নিশ্চয়ই কেউ করবেন না। বরং অবস্থাটা মাঝামাঝি। আমাদের বিচার বিভাগ যেমন পুরোপুরি স্বাধীন নয়, আবার বিচার বিভাগের হাত-পা পুরোপুরি বাঁধাও নয়। এখানেও অবস্থাটা মাঝামাঝি। আর মাঝামাঝি বলেই বিতর্কটা কাঙ্ক্ষিত। কেননা আমরা দুপক্ষের কাছ থেকেই তাদের মতামত ও অভিব্যক্তি জানতে পারব যেই বিতর্কের মধ্য দিয়ে উঠে আসবে দেশের আইনের শাসনের প্রকৃত চিত্র। দুর্বল জায়গাগুলো আমরা চিহ্নিত করতে পারব এবং দুপক্ষই আন্তরিক হলে এই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে আমরা সত্যিকারের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারব।
অতএব দেশে আইনের শাসন কতটুকু আছে, গণতন্ত্রের চেহারা কেমন কিংবা বাকস্বাধীনতার প্রকৃত চিত্রই বা কী-এসব বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে মূলধারার গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন পাবলিক ফোরামে বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত। সেই আলোচনার মধ্য দিয়ে নিশ্চয়ই আমরা আমাদের দুর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে পারব। আর অসুখ চিহ্নিত হলে চিকিৎসকের পক্ষে ওষুধ দেয়াও সহজ। অতএব একটি স্বাস্থ্যকর সমাজ বিনির্মাণের জন্য স্বাস্থ্যকর বিতর্ক চলুক।
হালের বিতর্ক শুরু হয়েছে কয়েকটি ইস্যুতে। যেমন বিচারকদের অপসারণ সম্পর্কিত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ, বারবার তাগাদা সত্ত্বেও নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশ না করা, বিচার বিভাগ সম্পর্কে দুজন মন্ত্রীর (মুক্তিযুদ্ধ ও খাদ্যমন্ত্রী) মন্তব্য এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের শাস্তি। তবে আপিল বিভাগ সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ সম্ভবত নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশ না করার ইস্যুতে। গেজেট প্রকাশে সরকার দফায় দফায় সময় নিচ্ছে এবং বারবারই তারা আদালতকে বলছে যে, এটি এখন রাষ্ট্রপতির দপ্তরে। আপিল বিভাগ বলছেন, বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার নেই যে, শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশে বারবার তার দোহাই দেয়া হবে। প্রধান বিচারপতি বলেন, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এমনকি ভারত, পাকিস্তানের মতো দেশেও নিম্ন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি ও বদলি, সবই করে থাকে সুপ্রিম কোর্ট। শুধু বাংলাদেশে এটি দেখা যায় না।
ফলে এই বিষয়গুলো নিয়েও খুব অ্যাকাডেমিক আলোচনা হওয়া দরকার এবং এই বিতর্কের সবচেয়ে ভালো জায়গা হতে পারে জাতীয় সংসদ। তাছাড়া রাষ্ট্রপতির দোহাই দেয়া নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, সেটিও একটি বড় আলোচনা বা বিতর্কের ইস্যু হতে পারে। কেননা সাংবিধানিকভাবেই আমাদের রাষ্ট্রপতি সীমিত ক্ষমতার অধিকারী যেখানে প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার ক্ষমতার কোনো ভারসাম্য নেই।
প্রাসঙ্গিক এরকম সব বিষয় নিয়ে আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক হওয়া উচিত। তবে বিতর্কের আগে এটিও নিশ্চিত করতে হবে যে, যেকোনো বিষয়ে নাগরিকের মুক্তভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে এবং বক্তব্য অপছন্দ হলেই তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দিয়ে কাউকে হয়রানি করা হবে না।
একটি স্বাস্থ্যকর বিতর্ক শুরুর আগে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, বক্তব্য অপছন্দ হলেই কারো বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা বা মানহানী মামলা দিয়ে হয়রানি করা হবে না। গঠনমূলক সমালোচনার মধ্য দিয়ে একটি মানবিক ও সহনশীল রাষ্ট্র গঠনের আগে এটিও নিশ্চিত করতে হবে যে, ভিন্নমতের কারণে কাউকে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল বা আদর্শের ট্যাগ লাগানো হবে না। কেননা, আমরা যদি আইনের শাসন নিয়ে প্রকৃতই গঠনমূলক আলোচনা করতে চাই, তখন বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন যেমন আসবে, তেমনি বিচারপতি নিয়োগ এবং বিচারপতিদের যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়েও আমাদের খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। সেই আলোচনার জন্য আমরা প্রস্তুত কি না?
সংসদ সদস্যরা আমাদের আইন প্রণেতা। কিন্তু আইন প্রণয়নের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য তাদের কত শতাংশ আসলেই যোগ্য এবং যে প্রক্রিয়ায় বিল পাস হয়, তা নিয়েও আমাদের নির্ভয়ে আলোচনার সুযোগ দিতে হবে। এরকম স্পর্শকাতর বিষয়ে আলোচনার সুযোগ থাকার অর্থই হলো বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা। কেননা একটি রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে কি না, তা নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রে জনগণের নির্ভয়ে মুক্ত আলোচনার সুযোগ কতটা রয়েছে, তার উপর।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)