সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তা হলো প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ এবং এরপর প্রধান বিচারপতির শূন্য পদে নিয়োগ। ইতিপূর্বে বাংলাদেশে কোনো প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করেননি। সে ক্ষেত্রে বিচারপতি এস কে সিনহার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন বলা যায়। বিচারপতি এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতির পদ থেকে শুধু পদত্যাগই করেননি, প্রকৃত পক্ষে বিদেশ থেকে তিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। সেই দিক বিবেচনায়ও বিষয়টি অভিনব।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ১ মাস ১০ দিনের ছুটি নিয়ে বিদেশে চলে যান। তারপরে তিনি আর দেশে ফিরে আসেননি। সিঙ্গাপুর থেকে তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। এই নিয়ে দেশে প্রচুর আলোচনা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো যে, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা প্রথম প্রধান বিচারপতি যিনি তার কার্যকাল শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করলেন এবং বিদেশ থেকে পদত্যাগপত্র পাঠালেন।
বিচারপতি সিনহা গত ১১ নভেম্বর ২০১৭ ইং তারিখে প্রধান বিচারপতির পদ হতে পদত্যাগ করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি পরবর্তী সময় উক্ত পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করেছেন। সুতরাং বলা যায় যে, ১১ নভেম্বর ২০১৭ ইং তারিখ থেকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির পদটি শূন্য আছে। এই পদে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এখন মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপরে সাংবিধানিক যে দায়িত্ব পড়েছে তা হলো প্রধান বিচারপতির শূন্য পদে একজন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা।
আইনমন্ত্রী বলেছেন, সংবিধানের অনুশাসন হিসেবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিজস্ব এখতিয়ার। তিনি আরো বলেছেন, সংবিধানে প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হবার কত দিনের মধ্যে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রদান করতে হবে, সে বিষয়ে কোনো দিক নির্দেশনা নেই।
এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদ প্রণিধানযোগ্য: ৯৫(১) “ প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ দান করিবেন।”
এই বিষয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই যে, প্রধান বিচারপতির শূন্য পদে নিয়োগের এখতিয়ার শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতির। সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য সম্পান করবেন। সেই বিবেচনায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিজস্ব এখতিয়ার হলো প্রধান বিচারপতির শূন্য পদে নিয়োগ প্রদান।
রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ বা বিভাগের মধ্যে বিচার বিভাগের প্রধান হলেন প্রধান বিচারপতি। সেই হিসেবে সাংবিধানিক এই গুরুত্বপূর্ণ পদটি অনির্দিষ্টকালের জন্য পূরণ না করা সঠিক হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের ইতিহাসে অবশ্য ইতিপূর্বে একবার ১৩ দিন দেরিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রদান করার নজির আছে। সেই সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন লে: জে: অব: হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি সম্ভবত: তখনকার আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে অনীহা প্রকাশ করেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বার রাষ্ট্রপতির এই অভিলাসকে ভালো চোখে দেখেনি। সেই সময় বারের দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠে।
সংশ্লিষ্ট সময়ে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন ব্যারিস্টার রফিকুল হক এবং আইনমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ। তারা সুপ্রিম কোর্ট বার এবং রাষ্ট্রপতির সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসতে প্রচেষ্টা চালান এবং শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি এরশাদ বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদানে সম্মত হন। কিন্তু ইতিমধ্যে ১৩ টি দিন অতিবাহিত হয়ে যায়।
রাষ্ট্রপতি এরশাদের সময়ে বাংলাদেশে প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হওয়ার ১৩ দিন পরে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রদান করা হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ এর অব্যবহিত পূর্বে প্রধান বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী। তিনি ১লা জানুয়ারি ১৯৯০ সালে অবসরে যান। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন ১৪ই জানুয়ারি ১৯৯০ সালে।
বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের শপথ গ্রহণের সময় একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। শপথ গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতি এরশাদ বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ করেন। এবং সন্ধ্যা ৭টায় শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণ করেন। সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের মাননীয় বিচারপতিগণ, আইনমন্ত্রী, আইন সচিব, অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার এবং রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারী সহ অনেকেই সে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। যে অভূতপূর্ব ঘটনাটি ঘটে তা হলো শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ গ্রহণের বাক্য সম্পর্কিত কাগজ স্বাক্ষরের জন্য উপস্থাপন করা হলে আশ্চর্যজনক ভাবে রাষ্ট্রপতি এরশাদ যখন স্বাক্ষর করা শুরু করেন তখন তার কলমে দাগ পড়েনি। এবং তিনি বিরক্ত হয়ে কলমটি মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দেন। তখন এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিজেই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে শপথ বাক্য পাঠ করাচ্ছেন এবং প্রধান বিচারপতি শপথ গ্রহণ করছেন।
এই রকম একটি অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির কলমে কালি থাকবে না অথবা তার কলমে দাগ পড়বে না তা বিশ্বাস করা যায় না। তবুও ঘটনাটি ঘটেছিল। আমি নিজে সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। আমি পরিস্থিতি সামলে নিয়ে সাহস করে রাষ্ট্রপতি এরশাদক ইংরেজিতে বলি “আপনি অনুগ্রহ করে আমার কলম দিয়ে স্বাক্ষর করতে চেষ্টা করবেন কী?”। তিনি রাজি হন এবং অবশেষে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির অবসান হয়। এই ঘটনার রাজ স্বাক্ষী হিসেবে আজও আমি বেঁচে আছি। তখনকার মহামান্য রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারী নিশ্চয়ই এখনো বেঁচে আছেন। তিনিও ঘটনাটি ভুলেননি বলে আমার বিশ্বাস।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার ছিলেন তখন জনাব হামিদুল হক। পরবর্তীতে তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হয়েছিলেন। আইন সচিব ছিলেন বিচারপতি আব্দুল কুদ্দুস চৈাধুরী। তিনি ইতিমধ্যে বেহেস্তবাসী হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি এরশাদ এখনো বেঁচে আছেন। তিনি এই লেখাটি পড়বেন কিনা জানি না। তবে আমার বিশ্বাস ঘটনাটি তার মনে আছে।
এই কথাগুলো বললাম এই কারণে যে, রাষ্ট্রপতি এরশাদ ১৩ দিন পরে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ প্রদান করেন। এবং তিনি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ প্রদানে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহর কী ইশারা! এই বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে পরবর্তীতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং তার আদেশেই রাষ্ট্রপতি এরশাদকে আটক করা হয়। ভবিতব্যের কাছে আমরা কত অসহায়!
রাষ্ট্রপতি এরশাদের ভবিষ্যত সম্ভবত: প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের শপথ গ্রহণের দিনেই নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে এমন একটি অশুভ ঘটনা ঘটে এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতির কলমে দাগ পড়েনি। কে জানে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)