“অ্যান্টিনেটাল কেয়ার” শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল গর্ভকালীন পরিচর্যা। একজন মেয়ে যখন গর্ভবতী হন, তখন তার শারীরিক ও মানসিক যে পরিবর্তন আসে সে বিষয়ে তাকে অবগত করা এবং এ সময়ে তিনি কেমন থাকবেন, তার কোন জটিলতা হতে পারে কিনা অথবা আদৌ কোন জটিলতা তৈরি হয়েছে কিনা এ বিষয়গুলো নিয়েই যে আলোচনা তাকেই আমরা বলি গর্ভকালীন পরিচর্যা।
গর্ভকালীন সময়ে তিনি কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন, কোথায় গর্ভপাত করাবেন, কখন করাবেন এসব বিষয় ও আলোচনার মধ্যে পরে। একজন মেয়ের জন্য গর্ভকালীন পরিচর্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত বলা হয়ে থাকে যে, প্রথমবার ঋতুস্রাব বন্ধ হবার সাথে সাথেই একজন মেয়েকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। যদি কোনো কারণে প্রথমবার যেতে না পারেন তবে দ্বিতীয়বার ঋতুস্রাবের সময় পার হবার পর পর অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।
গর্ভবতী হবার পর যত দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া যায় তত সঠিকভাবে প্রসবের তারিখ গণনা করা যায়। সঠিকভাবে প্রসবের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা গর্ভকালীন পরিচর্যার অন্যতম বিষয়। তাছাড়া গর্ভকালীন পরিচর্যাকালীন সময়েই বোঝা যায় মা একজন সন্তান গর্ভধারণ করেছেন নাকি একের অধিক সন্তান।
এ সময় গর্ভবতী মায়ের কিছু প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়। যেমন তার রক্তে হিমোগ্লবিনের পরিমাণ ঠিক আছে কিনা, রক্তকোষের পরিমাণ যতটুকু থাকার কথা ততটুকু আছে কিনা, থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা আছে কিনা এসব চেক করা হয়। যেসব মায়েদের পরিবারে তার বাবা অথবা মায়ের ডায়েবেটিস এবং প্রেসারের সমস্যা থাকে তাদের ক্ষেত্রে গর্ভকালীন ডায়েবেটিস এবং প্রেসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তবে গর্ভকালীন ডায়েবেটিস এবং প্রেসার গর্ভের কারণে যে কোন মায়েরই হতে পারে।
এ বিষয়টি নিয়েও এ সময় আলোচনা করা হয়ে থাকে। যদি বাবা মায়ের ডায়েবেটিস এবং প্রেসারের সমস্যা থেকে থাকে অথবা এই মায়ের আগের সন্তান গর্ভে থাকাকালীণ সময়ে ডায়েবেটিস অথবা প্রেসারের সমস্যা ছিল সেক্ষেত্রে এই সন্তান পেটে আসার পর পরই স্পেশাল কেয়ার নিতে হবে। এখনও অনেকে রয়েছেন যারা মনে করেন গর্ভধারণ এক ধরণের রোগ এবং এ সময় তিনি কোন কাজ করতে পারবেন না। গর্ভাবস্থা যে কোন রোগ নয় এবং এ সময় তার যে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হবে তা বোঝানোর জন্য গর্ভকালীন পরিচর্যা প্রয়োজন।
অনেক মা আছেন যাদের এ সময় অনেক বমি হয়। পরিচর্যার এ সময় তাকে বোঝান হয় যে এই বমি ভাব হওয়া বা বমি হওয়া স্বাভাবিক। তবে যদি বমি অনেক বেশি পরিমাণে হয় তবে অবশ্যই গর্ভবতী মাকে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজনও হয়। গর্ভকালীন সময়ের প্রথম তিন মাস সময় পার হয়ে গেলে আস্তে আস্তে এক সময় বমি ভাব ও কমে যায়। এ সময় যে শুধুমাত্র শারীরিক পরিবর্তন হয় তা নয়, মানসিক পরিবর্তনও হয়। একজন গর্ভবতী মহিলা তার সারাদিনের অধিকাংশ সময়ই তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সাথে কাটান। সে ক্ষেত্রে তিনি শারীরিক ও মানসিক ভাবে কেমন থাকবেন তা তার পরিবারের সদস্যদের সাথে তার সম্পর্কের উপর ও নির্ভর করে।
গর্ভকালীন পরিচর্যার উপর নির্ভর করছে সুস্থ গর্ভাবস্থা, একজন সুস্থ মা ও একজন সুস্থ নবজাতক শিশু- যা মূলত গর্ভকালীণ পরিচর্যার মূল প্রতিপাদ্য। গর্ভকালীন সময়ে স্বামী, মা, শাশুড়ি বা বোন যে কাউকে অবশ্যই নতুন এই মায়ের সাথে চিকিৎসকের কাছে আসা উচিত। কারণ তাদের ও পরামর্শের প্রয়োজন আছে। কিভাবে তারা এই মায়ের যত্ন নিবেন, একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য কোন কোন খাবার খাওয়া ভাল, কোন খাবার না খাওয়া ভাল, কতটুকু পরিমাণ খাবার অন্তত পক্ষে খাওয়া উচিত এসব ব্যাপারে মায়ের পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ও পরামর্শের দরকার আছে।
সাধারণত দেখা যায় যে গর্ভের প্রথম দু-তিন মাস নতুন মায়েরা তেমন কিছু একটা খেতে পারেন না। খাবারে গন্ধ লাগা এবং বমি ভাব হওয়াই এর মূল কারণ। তবে যত সময় পার হতে থাকে তাদের খাবারের প্রতি এই অনিহার ভাবটাও কমে আসে। একজন পূর্ণ বয়স্ক নারীর সাধারণত রোজ ২০০০ কিলোক্যালরী শক্তির দরকার হয় যার প্রধান উৎস হল তার দৈনন্দিন খাবার। গর্ভাবস্থায় প্রয়োজন ২২০০ কিলোক্যালরি। এ কারণে গর্ভবতী মায়ের প্রতি আমাদের উপদেশ থাকে আগে উনি যে পরিমাণ খাবার খেতেন গর্ভাবস্থায় তার চেয়ে এক-দেড় মুঠ খাবার বেশি খাবেন।
একবারে বেশি পরিমাণ না খেয়ে কিছুক্ষণ পর পর অল্প অল্প করে খেতে হবে। এতে করে পেটের ভেতরে গ্যাস কম হবে আর বমি ভাবও কম হবে। কোন কোন মা আছেন সকালের নাস্তা খাবার পর দুপুরের আগে আর কিছুই খান না। খেয়াল রাখতে হবে খুব বেশি সময় যেন খাবারে বিরতি না থাকে। মা অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলে বাচ্চারও অক্সিজেন এবং সুগারের ঘাটতি হয়। তখন দেখা যায় যে বাচ্চার নড়াচড়া কমে গিয়েছে বা বাচ্চা অনেক বেশি নড়াচড়া করছে, যা আমরা বাচ্চার শ্বাসকষ্টের কারণ বলে চিহ্নিত করি। অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকার কারণে যদি বাচ্চার নড়াচড়া কমে যায় তাহলে আমরা মাকে খাবার খেয়ে বাম কাত হয়ে শুয়ে থাকতে বলি। এরপরও যদি বাচ্চার নড়াচড়া ঠিক না হয় তখন আমরা মাকে হাসপাতালে ভর্তির উপদেশ দেই।
১২ ঘণ্টায় ১০-১২বার নড়াচড়া করা সুস্থ বাচ্চার লক্ষণ বলে ধরা হয়। যদি এর চেয়ে কম হয় তবে মাকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। গর্ভাবস্থায় সাধারণত প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি মায়ের শরীর থেকেই শিশু গ্রহণ করে। এ কারণে একজন সুস্থ শিশুর জন্মগ্রহণ নির্ভর করে মায়ের পুষ্টির উপর। গর্ভকালীন সময়ে মাকে অবশ্যই পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। এ কারণে একজন মায়ের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণ আয়রন, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, শর্করা, আমিষ, প্রোটিন এবং মৌসুমি ফল থাকতে হবে এবং তার সাথে খেতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি।
গর্ভের শিশুর হাড়ের গঠনে এবং গর্ভাবস্থায় মায়ের উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করার জন্য ক্যালসিয়ামের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে গর্ভাবস্থায় রোজ একজন মাকে ১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম খেতে হবে। রোজকার খাদ্য তালিকায় অবশ্যই ভাতের সাথে ২-৩ টুকরা মাছ অথবা ২-৩ টুকরা মাংস, ১ টা ডিম, ২ গ্লাস দুধ, ১ টা কলা থাকা উচিত। গর্ভবতী মা রোজ একটি করে ভিটামিন সি যুক্ত ফল যেমন কমলা, মালটা, পেয়ারা, টমেটো বা লেবু খেতে পারবেন। শরীরে আয়রনের ঘাটতি থাকলে রোজ এক বাতি কলিজা খেতে পারবেন।
এছাড়া ছোট মাছ, কাঁচা কলা, আনার ফল এসব ও খেতে পারেন। পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রাম নেয়া খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্রামের ব্যাপারে আমরা চাই গর্ভবতী মা অবশ্যই দুপুরে ২ ঘণ্টা এবং রাতে ৮ ঘণ্টা ঘুমাবেন। অধিকাংশ মায়ের ঘুম না হওয়ার সমস্যাটা বেশ প্রকট। এ নিয়ে তারা বেশ দুঃচিন্তাগ্রস্থও থাকেন। তাদের জন্য পরামর্শ, এটি কোন সমস্যা নয়। যখন ঘুম আসবেনা তখন গান শুনবেন, গল্পের বই পড়বেন, টেলিভিশন দেখবেন। এক সময় ঠিকই ঘুমিয়ে যাবেন। এর জন্য অতিরিক্ত ঔষধ খাবার প্রয়োজন নেই।
গর্ভাবস্থা এবং প্রসব জনিত কারণে এক সময়ে মাতৃমৃত্যুর হার আমাদের দেশে অনেক বেশি ছিল। এর পিছনে মূল কারণ ছিল অপর্যাপ্ত গর্ভকালীন পরিচর্যা। কখনও মা নিজে আসতে চাইতেন না, কখনও ঘরের মানুষ নিয়ে আসতেন না। বর্তমানে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যাপ্ত গর্ভকালীন পরিচর্যার কারণে মাতৃমৃত্যুর হারও কমে আসছে দিনে দিনে। আমরা চাই একজন গর্ভবতী মা প্রথম ৩ মাস প্রতি মাসে একবার চেক আপে আসুক, এরপর ৩৬ সপ্তাহ পর্যন্ত মাসে ২বার এবং এরপর প্রসব না হওয়া পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে চেক আপে আসুক। যদি পারিবারিক অথবা ব্যক্তিগত কারণে এতবার আসতে না পারেন তবে অন্ততপক্ষে ৩ বার চেক আপে অবশ্যই আসা উচিত।
গর্ভাবস্থায় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু কমই থাকে। শরীরে হরমোন বেশি থাকার কারণে সব সময় জ্বর জ্বর লাগছে এমন মনে হতে পারে। এর জন্য কোনো ঔষধ খাবার প্রয়োজন নেই। তবে যদি ঠাণ্ডা জ্বর অথবা সর্দি জ্বর হয়, অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গর্ভাবস্থায় বাচ্চার জন্য ক্ষতিকারক নয় এমন ঔষধ খাওয়া উচিত।
অনেক গর্ভবতী মা আছেন যিনি আগে থেকেই প্রেসার কিংবা ডায়বেটিসের চিকিৎসায় আছেন। এমতাবস্থায় গর্ভবতী হবার সাথে সাথেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গর্ভাবস্থায় সহায়ক ঔষধ নিতে হবে। তা না হলে বাচ্চার জন্মগত সমস্যা হবার সম্ভাবনা থাকে। যদি কারো আগেই টিটেনাসের পাঁচটি টিকা দেয়া থাকে তবে নতুন করে পুনরায় দেয়ার দরকার নেই। কিন্তু যদি পাঁচটি টিকা দেয়া না থাকে তবে ২টি টিকা দিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে ১ম টিকা গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহ সময়ে দিতে হয় এবং তার ১মাস পর ২য় টিকা। পরবর্তী টিকাগুলো বাচ্চার জন্মের পর দিয়ে নিতে বলা হয়।
গর্ভাবস্থায় অবশ্যই সুতি এবং ঢিলেঢালা পোশক পরা উচিত। আঁটসাঁট পোশাক এ সময় না পরাই ভালো। আর অবশ্যই উঁচু হিল জুতা না পরা উচিত। কারণ উঁচু জুতা পরলে পরে গিয়ে গর্ভপাত বা সময়ের আগে প্রসব হওয়া বা গর্ভের সন্তান আঘাতজনিত কারণে মারা যাবার ঝুঁকি অনেক বেশী থাকে।