আমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ। গাড়ী তো দূরের কথা রিকশায় চড়ারও মুরোদ নেই, তাই গণ পরিবহনেই চলাচল করি। এটাই আমার সাশ্রয়ী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মূলমন্ত্র। সময় ব্যয় হয় বটে, তবে সাশ্রয় হয় অর্থের। আমার বিশ্বাস, নানানজনের গুতো খেয়েও তাই গণ পরিবহনেই যাতায়াত আমার মতো অনেকের একমাত্র ভরসা।
সিটিং নামের বাসগুলোতে নৈরাজ্য চলতো ঠিকই, কিছুটা আরামও দিতো। ধরেন, লোকাল বাসে আপনি কাজীপাড়া থেকে ফার্মগেট যাবেন। এজন্য আপনাকে গুনতে হবে ১০ টাকা। স্টপেজ পাবেন মনিপুর স্কুল গেট, শেওড়াপাড়া, গ্রীন ইউনিভার্সিটি, তালতলা, এডিবি, আগারগাঁও, জিয়া উদ্যান, খামারবাড়ী। যদি সিট পান তাহলে ঠিক আপনারই ঘাড়ের ওপর দাড়িয়ে থাকা লোকের হিড়িক বাড়বে। আর যদি সিট না পান, তাহলে তো কথাই নেই, আপনার ডানে বামে সামনে পেছনে পুরুষরা লেপ্টে থাকবে যতটা না ভীড় তার চাইতে বেশি আপনি তেঁতুল বলে। লালা তাদের ঝরবেই। কিন্তু সিটিং বাসে দেবেন ১৫ টাকা। স্টপেজ পাবেন একটি, শেওড়াপাড়া। যতটা সম্ভব দ্রুততম সময়ে আপনাকে পৌঁছে দেবে ফার্মগেট। সবচেয়ে বড় স্বস্তি হলো ঘাড়ের ওপর কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে না।
ঘাড়ের ওপর দাড়িয়ে থাকা কথাটাতে বেশি জোর দিচ্ছি। কারণ, ঘাড়ের ওপর পুরুষগুলো এমনভাবে দাঁড়ান, যেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। এরপর শুরু হবে গাড়ীর ঝাকুনি বা দুলুনি, তখন যা হবার তাই হবে। আপনি যতই সরতে বলবেন, ওপরে ধরে থাকা হাত সরবে কিন্তু শরীরের অন্য কোন অংশ নড়বে না। এ করে কি যে আনন্দ পায় পুরুষরূপী এসব যাত্রীরা, তা কেবল তারাই জানেন। সে কারণে সিটিং সার্ভিস বন্ধ না করার পক্ষে আমি প্রয়োজনে ৫ টাকা বেশি গুনতেও রাজী।
আর মেয়ে সিট ও পুরুষ সিট নিয়ে বিতর্কের তো শেষ নেই। আর এ নিয়ে লিখতে বসলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যাবে। তারপরও বলি, ইদানিং শুরু হয়েছে নতুন এক উৎপাত। মেয়েদের জন্য প্রত্যেকটা বাসে ৯টি সিট বরাদ্দ থাকেই। মেয়েদের দেখলেই অনেকেই সিটে বসে থাকা পুরুষ উঠে যান। কখনও কখনও মেয়েদের কোটা পূরণের পরও মেয়েদের বসতে দেন। কিন্তু নতুন আইনের পর তারা যেনো পাগল হয়ে উঠেছেন। অন্য কোন সিটে মেয়ে বসলেই তাকে নামিয়ে দিচ্ছেন।
গেলো শনিবারের কথাই বলি, যাচ্ছিলাম কাজীপাড়া থেকে উত্তরা। মেয়েদের জন্য বরাদ্দ সব সিটই খালি। একটিতে বসলাম আমি। তখনো বাকী অন্যগুলো। পুরুষরা বসতে চাইলো, ড্রাইভারের কড়া নির্দেশ মেয়েদের সিট খালি রেখে বসেন। পেছনে পুরুষ সিটে বসে ছিলো একটি মেয়ে। অন্য যাত্রীরা ড্রাইভারকে চেপে ধরলো, তাহলে উনি এখানে বসেছেন কেন? ওনাকে মেয়েদের সিটে গিয়ে বসতে বলেন। কথা বলার কোনো স্কোপই নাই। সাধারণ সিট ছেড়ে মেয়েদের সিটে এসে বসলো মেয়েটি। বাকী সিটগুলো বিমানবন্দর এলাকা অবধি ফাঁকাই ছিলো। সেখানে উঠলো কয়েকটি মেয়ে। তারপর উঠলো রাজলক্ষীর কাছে গিয়ে। ততক্ষণ অবধি সিট খালিই ছিলো। এসবই কি বাড়াবাড়ির নমুনা নয়?
মেয়েদের আর ছেলেদের সিট আলাদা করতে হবে কেনো? সিট ফাঁকা থাকলে যে কেউই বসতে পারে, সেটা যেকোন জায়গাতেই হতে পারে। এমনটাই কি হওয়া উচিত নয়? পুরুষ, মহিলা বলে শুরুতেই একটা বিভেদ সৃষ্টি করার কি কোন দরকার আছে। কারণটা আসলে আমার বোধগম্য নয়। যারা আমরা ঘর থেকে বের হই, যাতায়াত করি তাও গণ পরিবহনে তারা জানি, পাশের সিটে কোন মহিলা সহযাত্রীকে নাও পেতে পারি। সে রকম মানসিক প্রস্তুতি সব যাত্রীরূপী নারীদের থাকেই। এ আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি।
এবার আসি ভাড়া প্রসঙ্গে। প্রতিটি বাসেই তা সিটিং হোক আর গণ পরিবহণই হোক না কেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বচসা বাঁধবেই। তারা দেবে হাফ ভাড়া কিন্তু হেল্পার চাইবে ফুল। এ নিয়ে তর্ক শেষ পর্যষন্ত হাতাহাতিতে গড়াতেও বহুবার দেখেছি আমি। একদিনের অভিজ্ঞতার কথা বলি, সিটিং বাসেই উঠেছি, যাবো জজকোর্ট। গাড়ি খামারবাড়ী দিয়ে ফার্মগেট সিগন্যালের কাছে। এক শিক্ষার্থী টাকা কম দিয়ে হেল্পারকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলেই দিলো। ঠিক দরজার কাছেই বসে ছিলাম আমি। ছাত্রটিকে আটকালাম। দেখতে চাইলাম তার আইডি কার্ড। সে দেখালো, তবে সেটি মেয়াদ উত্তীর্ণ। আমার সঙ্গে অন্য যাত্রীরাও ততক্ষণে ওই শিক্ষার্থীকে শাসন করলো। শেষে হেল্পারের কাছে ক্ষমা চেয়ে ছেলেটিকে বিদায় নিতে হয়েছিলো।
আমার কথা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা হাফ ভাড়া দেবে, এটাই স্বাভাবিক। সে যে গাড়িই হোকনা কেন। কিন্তু শিক্ষার্থীকে টাকার পরিবর্তে আইডি কার্ড দেখাতেই হবে, তাও ভ্যালিড আইডি কার্ড। এতটুকু নৈতিক শিক্ষা তো তাদের হওয়াই উচিত। আর ব্যবহার হতে হবে আরো নমনীয়। সে হোক হেল্পার বা ড্রাইভার কিংবা যেকোন মানুষের সাথেই।
আমার মতে, মেয়েদের সিট আলাদা না করলেও চলে। মেয়েদেরকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা জরুরী। একজন মেয়েকে দেখে যেমন অনেক পুরুষ সিট ছেড়ে দেন তেমনি একজন বয়োবৃদ্ধ পুরুষকে দেখলেও যেনো একজন মহিলাও তার সিটটা ছেড়ে দিতে দ্বিধা না করেন। গণপরিহণ নিয়ে সৃষ্ট এসব সমস্যা সমাধানে আমার কয়েকটি প্রস্তাব আছে।
প্রথমত: সব বাস হবে সিটিং সার্ভিস। দ্বিতীয়ত: কোন যাত্রী দাঁড়িয়ে যাবে না। তৃতীয়ত: দূরত্বভেদে সব গাড়ির ভাড়া এক হবে।চতুর্থত: শিক্ষার্থীরা আইডি কার্ড দেখিয়ে হাফ ভাড়া দেবেন। পঞ্চমত: কম স্টপেজ হবে এবং ষষ্টত: স্টপেজ এর বাইরে উঠানো এবং নামানো যাবে না। এসব নিয়মের ব্যতিক্রম হলে সে গাড়ি এবং ড্রাইভারকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
স্বপ্ন দেখি, এসব নিয়ম মেনে গণপরিবহন চলছে। ফলে কমে গেছে সড়ক দুর্ঘটনাও। দেখি বাসে বাসে কোন প্রতিযোগিতা নেই। ভাবি সকল বাস মালিকের আয়ও নিশ্চিত হয়েছে। নিশ্চিত হয়েছে হেলপার ও ড্রাইভারের খরচ। সমাপ্তি ঘটেছে যত্রতত্র যাত্রী উঠা-নামানোর নামে হয়রানির। যাতায়াতের সময় নারীদেরকে অশোভন কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। সমসম্মানে ও নির্বিঘ্নে যাতায়াত করছেন সকল নারী ও পুরুষ। সেই সুদিনের অপেক্ষায়, বলতে পারেন স্বপ্ন পূরণের অপেক্ষা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)