১৩ সেপ্টেম্বর বুধবার ইউনুস সেন্টারের মাধ্যমে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করে পরিষদের সভাপতি ও সদস্যবৃন্দের প্রতি চিঠি দেওয়া হয়। সে চিঠিতে বলা হয়, ‘রোহিঙ্গা সংকট পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বান করায় প্রথমে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক সংকট ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। এর অবসানে আপনাদের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আপনাদের এই মুহূর্তের দৃঢ়সংকল্প ও সাহসী সিদ্ধান্তের ওপর মানব ইতিহাসের ভবিষ্যৎ গতিপথ অনেকটাই নির্ভর করছে।’
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে চিঠিতে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক আক্রমণে রাখাইন রাজ্যে শত শত রোহিঙ্গা জনগণ নিহত হচ্ছে। বাস্তুচ্যুত হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বহু গ্রাম, ধর্ষণ করা হচ্ছে নারীদের, বেসামরিক মানুষদের নির্বিচারে আটক করা হচ্ছে এবং শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। আতঙ্কের বিষয়, মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোকে রাখাইনে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে দারিদ্র্য পীড়িত এই এলাকায় মানবিক সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।’
রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীর সংখ্যা দিন বাড়ছে। এ প্রবণতা কখনও সুখকর কিছু নয়। স্থানীয় সূত্রগুলোকে উদ্ধৃত করে চিঠিতে বলা হয়, ‘গত দুই সপ্তাহে তিন লাখের বেশি (পরে যে সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়িয়েছে) মানুষ তাদের জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। মৃত্যুর মুখে নারী, পুরুষ ও শিশুদের এই ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি এবং অভিবাসন থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় ঠেকেছে।
এর আগেও সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে গত বছরের শেষে নোবেলজয়ী ও বিশ্বের বিশিষ্ট নাগরিকগণ রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছিলেন। অনুরোধের পর গৃহীত পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি উল্লেখ করে বলা হয়, ‘আপনাদের নিকট অনুরোধ জানিয়েছিলাম। আপনাদের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি ঠেকাতে নিরীহ নাগরিকদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে রাখাইন রাজ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমরা আবারও আপনাদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় সম্ভাব্য সবগুলো পথে হাঁটা উচিত মনে করে চিঠিতে বলা হয়, ‘আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সম্ভাব্য সব হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাচ্ছি, যাতে নিরীহ বেসামরিক মানুষদের ওপর নির্বিচার সামরিক আক্রমণ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়, যার ফলে এই অসহায় মানুষগুলোকে নিজ দেশ ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যেতে এবং রাষ্ট্রহীন মানুষে পরিণত হতে না হয়।’
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারেরই নাগরিক উল্লেখ করে চিঠিতে ১২ নোবেল বিজয়ী ও বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ বলেন, ‘মিয়ানমার সরকার যে যুক্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করছে তা একেবারেই অবান্তর। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে বার্মা স্বাধীন হওয়ার পর এবং পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের সময়কালে বার্মা তার সীমানাভুক্ত রোহিঙ্গাসহ সব জাতিগোষ্ঠীকে পূর্ণ নাগরিক বলে স্বীকার করে নেয় এবং সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্বও দেয়। এটা আশ্চর্যজনক যে ১৯৮০-এর দশকে সে দেশের সামরিক শাসকেরা হঠাৎ করেই আবিষ্কার করে বসে যে রোহিঙ্গারা বার্মিজ নয়। এরপর তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয় এবং তাদেরকে সে দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য বিভিন্ন সামরিক ও রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে। শুরু হয় জাতিগত ও ধর্মীয় নিধনের উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সুপরিকল্পিত নির্যাতন।
চিঠিতে জাতিসংঘ মহাসচিবের বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে বলা হয়, “জাতিসংঘ মহাসচিব যথার্থই বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও অমীমাংসিত দুর্দশা আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার একটি অনস্বীকার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারের শাসকদের অবশ্যই সহিংসতার এই দুষ্টচক্র বন্ধ করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং নিপীড়িত সবার নিরাপত্তা ও সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
চিঠিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার ২০১৬ সালে যে ‘রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশন’ গঠন করেছিল, তার সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকারকে উদ্বুদ্ধ করতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।
কফি আনানের সভাপতিত্বে গঠিত এই কমিশন, যার অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন মিয়ানমারের নাগরিক। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, অবাধ চলাচলের সুযোগ, আইনের চোখে সমান অধিকার, রোহিঙ্গাদের স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, যার অভাবে স্থানীয় মুসলিমরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং নিজ ভূমিতে ফিরে আসা মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সহায়তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছিল।
স্থায়ী শান্তির জন্য গঠনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে, যা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে বলে চিঠিতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য সাতটি পরামর্শ দেওয়া হয় চিঠিতে। এগুলো ছিলো- আনান কমিশনের সদস্যদের নিয়ে অবিলম্বে একটি ‘বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করা; যার কাজ হবে কমিশনের সুপারিশগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধান করা, দেশটি থেকে শরণার্থীর প্রবাহ বন্ধ করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের নিয়মিতভাবে পীড়িত এলাকাগুলো পরিদর্শন করতে আমন্ত্রণ জানানো, যেসব শরণার্থী ইতোমধ্যে দেশ ত্যাগ করেছে, তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা, ফিরে যাওয়া শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘের অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন, বাস্তবায়ন কমিটির কর্তৃত্বে আনান কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ মোতাবেক রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান এবং রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অবাধে চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
চিঠিতে জাতিসংঘের কার্যক্রম সম্পর্কে বলা হয়, ‘আমাদের মনে হয়েছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই ক্রমাগত সহিংসতা বন্ধ করতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কর্মপন্থায় সাহসী পরিবর্তন প্রয়োজন। সে দেশের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও অর্থায়ন রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক পরিবর্তনের ওপর নির্ভরশীল তা মিয়ানমার সরকারকে জানিয়ে দেওয়া দরকার। অপপ্রচার, ঘৃণা ও সহিংসতার উসকানির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র পরিচালিত সহিংসতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। বাতিল করতে হবে বৈষম্যমূলক বিভিন্ন নীতি ও আইন। অবশ্যই কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে।’
চিঠিতে বলা হয়, বিশ্ববাসী জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবিক সমস্যা সমাধানে তার ভূমিকা পালন করেছে, এটা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে।
চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা হচ্ছেন- প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস (নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০০৬ জয়ী), মেইরিড মাগুইর (নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৭৬ জয়ী) বেটি উইলিয়াম্স (নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৭৬ জয়ী) আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু (নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৮৪ জয়ী) অসকার আরিয়াস (নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৮৭ জয়ী) জোডি উইলিয়াম্স (নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৯৭ জয়ী), শিরিন এবাদী (নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০০৩ জয়ী) লেইমাহ বোয়ি (নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০১১ জয়ী) তাওয়াক্কল কারমান (নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০১১ জয়ী) মালালা ইউসুফজাই (নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০১৪ জয়ী), স্যার রিচার্ড জে. রবার্টস ( চিকিৎসা শাস্ত্রে ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরস্কার জয়ী) এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্ন (চিকিৎসা শাস্ত্রে ২০০৯ সালে নোবেল পুরস্কার জয়ী), জাভেদ আখতার (কবি ও গীতিকার),সাইয়েদ হামিদ আলবার, (মালয়েশিয়ার প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী), শাবানা আজমী (অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী), এমা বোনিনো (ইতালির প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী), স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন (ব্যবসায়ী নেতা ও সমাজসেবী), গ্রো হারলেম ব্রান্ড্টল্যান্ড (নরওয়ের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী), মো ইব্রাহীম (উদ্যোক্তা ও সমাজসেবী), আসমা জাহাঙ্গীর (পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সভাপতি), কেরী কেনেডী (মানবাধিকার কর্মী), আলা মুরাবিত (লিবীয় নারী অধিকার প্রবক্তা, এসডিজি সমর্থক), নারায়ণ মুর্তি (ব্যবসায়ী নেতা), কাসিত পিরোমিয়া (থাইল্যান্ডের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী), সুরিন পিটসুয়ান (আসিয়ানের প্রাক্তন মহাসচিব), পল পোলম্যান (ব্যবসায়ী নেতা, এসডিজি সমর্থক), ম্যারি রবিনসন (আয়ারল্যান্ডের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট), জেফরে ডি. সাচ (পরিচালক, জাতিসংঘ সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশান্স নেটওয়ার্ক), ফরেস্ট হুইটেকার (অভিনেতা, এসডিজি সমর্থক), জোকেন জাইটস (ব্যবসায়ী নেতা ও সমাজসেবী)।
রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার অবসান চেয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি প্রখ্যাত ব্যক্তিদের লেখা খোলা চিঠিতে ১৩ সেপ্টেম্বর নিজের নাম যুক্ত করেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। চিঠিতে মানবিক এ সংকট নিরসনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। ইউনূস সেন্টারের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অমর্ত্য সেন ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি চিঠি লিখেন। এতে তিনি বলেন, আমি সাধারণত যৌথ বিবৃতিতে নাম যোগ করি না। কিন্তু বার্মায় রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা এত অসহনীয় এবং নজিরবিহীন-বর্বরোচিত যে, আমি চিঠিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছি।’অমর্ত্য সেন ছাড়াও উইকিপিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা জিমি ওয়েলস এবং মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ব্যবসায়ী আরিফ নাকভীও চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের তালিকায় তাদের নাম যোগ করতে অনুরোধ করেছেন বলে জানানো হয়েছে ইউনূস সেন্টারের পক্ষ থেকে। সেসময় জাতিসংঘ এক বিবৃতিতে জানান, গত ২৪ আগস্ট রাতে সহিংসতা শুরুর পর থেকে রাখাইন অঞ্চলের প্রায় ৩ লক্ষ ৭০ হাজারেরও বেশি সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। গত ২৪ আগস্ট গভীর রাতে বেশ কিছু পুলিশ পোস্টে একযোগে হামলার পর থেকে দেশটির সেনাবাহিনী নজিরবিহীন অমানবিক অভিযান শুরু করে। এর পর থেকেই বাংলাদেশমুখী শরণার্থীর ঢল নামে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নিয়ে কদিন পরপরই নতুন নতুন বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। তখন রোহিঙ্গাদের ঢলটাও এমন ছিলো যে দুএকদিনের ব্যবধানেই সংখ্যা ৫০ হাজার বেশি হয়ে যেত। যদিও জাতিসংঘের হিসেবে সবসময় কম রোহিঙ্গাই দেখানো হয়েছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাগুলোও তখন মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রেখেছে। বিশ্বব্যাপী যে সাহায্য সংস্থাগুলো শরনার্থী ইস্যু নিয়ে কাজ করে সেসব সংস্থার প্রায় সবাই তখন উখিয়ায়। একদিন কথা হয় রেডক্রিসেন্টের এক কর্মকর্তার সঙ্গে। অন্যদের মত তারাও তখন রোহিঙ্গাদের সেবা দিতে ব্যস্ত। একদিকে অসুস্থ রোহিঙ্গাদের খাবার সরবরাহ করা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, অন্যদিকে কিভাবে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানো যায় তা নিয়ে চলছে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান যাইদ রাআ’দ আল হোসাইন সহিংসতার জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে অভিযুক্ত করে গৃহীত পদক্ষেপকে ‘স্পষ্ট বৈষম্য’ আচরণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তারা আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক বিষয়গুলোর তোয়াক্কাও করছে না বলে দাবি করেন যাইদ। তিনি মিয়ানমার সরকারের প্রতি চলমান এ সংকট দ্রুত নিরসনের দাবি জানান। একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার কথাও বলেন যাঈদ।
মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নিধনের চেষ্টা করা হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধানের এ বক্তব্যের পরই মূলত ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ জরুরী বৈঠক করে। এর আগে যদিও যুক্তরাজ্য এবং সুইডেন ক্রমবর্ধমান এ মানবিক সংকট নিরসনে নিরপত্তা পরিষদের কাছে বৈঠকে বসার আর্জি জানিয়েছিল।
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা একটি নৃগোষ্ঠীর নাম যাদের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ইসলাম ও ১০ ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। রোহিঙ্গাদের আদি আবাসস্থল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। শত শত বছর ধরে রাজ্যটিতে বাস করা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি না দিয়ে মিয়ানমার সরকার এ জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালাচ্ছে তখন। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমারের স্বাধীনতার সময়ও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ছিল। ১৯৬২-তে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করার পর নতুন করে সংকটের মুখে পড়ে রোহিঙ্গারা। ১৯৭৪ সালে সামরিক জান্তা ‘বিদেশি’ আখ্যা দেওয়ার পর ১৯৮২ সালে প্রণোয়ন করা হয় নাগরিকত্ব আইন। আর এই কালো আইনের মাধ্যমে অস্বীকার করা হয় রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব। নাগরিকত্ব হরণ করে তাদের অস্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। সাদা কার্ড নামে পরিচিত ওই পরিচয়পত্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের দেওয়া হয় সীমিত কিছু নাগরিক অধিকার।
জাতিসংঘের সহায়তায় ২০১৪ সালে পরিচালিত আদমশুমারিতে রোহিঙ্গা চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাধার মুখে পড়তে হয় রাখাইনের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের। তাদের শুমারি বয়কটের ঘোষণার মুখে সামরিক জান্তা সিদ্ধান্ত দেয় রোহিঙ্গা হিসেবে নিবন্ধিত হতে গেলে অবাঙালি হতে হবে। ২০১৫ সালে সাংবিধানিক পুনর্গঠনের সময়ে আদমশুমারিতে দেওয়া সাময়িক পরিচয়পত্র বাতিল করে সামরিক জান্তা। পদ্ধতিগতভাবে রোহিঙ্গাদের বঞ্চিত করা হয় মৌলিক অধিকার থেকে। চলাফেরা, বাসস্থান নির্মাণ, শিক্ষা, চিকিৎসা, এমনকি চাকরির অধিকার থেকে আইনসিদ্ধভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে তাদের। সাম্প্রতিক ঘটনায় মিলিটারীরা যে নিধন শুরু করে এর ফলে রাখাইন রাজ্যের হাজার হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এ অবস্থায় দেশটির রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ১৭৬টি গ্রামে একজন মানুষও নেই। জন মানবশূন্য হয়ে পড়েছে এই ১৭৬টি গ্রাম। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের দফতরের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে ভারতের দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস জানায়, রাখাইনে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামে চলমান সেনা অভিযানে এখানকার বাসিন্দারা পালিয়ে গেছে। এক বিবৃতিতে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের দফতরের মুখপাত্র জ হতয় জানান, রাখাইন রাজ্যের তিনটি শহরতলির সর্বমোট ৪৭১টি গ্রামের মধ্যে ১৭৬টি গ্রাম এখন জনমানবশূন্য। অন্য ৩৪টি গ্রাম থেকেও কিছু কিছু লোক প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে গেছে।
বিবৃতিতে ‘রোহিঙ্গা’ নামটি ব্যবহার করেননি জ হতয়। তিনি আরও বলেন, ফিরতে চাইলেও পালিয়ে যাওয়া বাসিন্দাদের সবাইকে অনুমতি দেওয়া হবে না। যাচাই বাছাই এর পরই মিয়ানমার কেবল তাদের গ্রহণ করতে পারে। মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ দাবি করছে তাদের সেনাবাহিনী অস্ত্রধারী রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই করছে। ১২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার মিয়ানমারের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে জানানো হয়, ‘কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সাম্প্রতিক সময়ের বিশৃংখলা নিয়ে সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের বিষয়েও অবগত রয়েছে।’
এদিকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপগুলো আশাব্যঞ্জক ছিলো। তিনি ১২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থা পরিদর্শনে গিয়ে মিয়ানমারের প্রতি ‘রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে পদক্ষেপ গ্রহণের অহ্বান’ জানান। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার এ সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং তাদেরকেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক চাই।’ যদিও শেখ হাসিনার এ বক্তব্যের কদিন আগে ও পরে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার কয়েকবারই বাংলাদেশের সীমান্তে ঢুকে পড়ে। এ নিয়ে অবশ্য তখন বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান ছিলো, উষ্কানীতে মনোযোগ না দেওয়া। ফেসবুকেও তখন বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার কার সামরিক শক্তি কত? এ নিয়ে পোস্টগুলো রীতিমত ভাইরাল। অনেকে আবেগের বশে মিয়ানমারকে কঠোর জবাব দেওয়া উচিত বললেও সামরিক শক্তির পরিসংখ্যান ও ভারত ও চীনের মত প্রতিবেশি দেশগুলো মিয়ানমারের সমর্থন নেওয়ার কারণে সৃষ্ট বাস্তব অবস্থায় নিজেদের এ ধরণের বক্তব্য দেওয়া থেকে সংবরণ করেছেন। তবে উষ্কানী চলছিলো। কান নিয়েছি চিলে! এমন টাইপের উষ্কানী চলছিলো। একবারতো খবর বের হলো চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ রওয়ানা হয়েছে! যুদ্ধ বিমানও উড়তে শুরু করেছে! যদিও পরে আইএসপিআর এ খবরগুলোকে ভিত্তিহীন বলে বিবৃতি দেয়। (চলবে)
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।