তিনি ঢাকাই সিনেমার প্রথম ‘রংবাজ’। স্বাধীন বাংলাদেশে তাকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে জহিরুল হক রংবাজ নামে যে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করলেন; তা ঢাকাই সিনেমার ব্যবসায় একটা মোটা দাগ এঁকে দিয়েছিলো। অবশ্য এর অনেক আগেই তিনি নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছিলেন।
মানুষের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বরাবরই বেদনার কালোফুল হয়ে ফুটেছে দেশে দেশে। কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকায় আসতে হয়েছিলো অভিনেতা রাজ্জাককে। তারপর বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য লড়াই-সংগ্রামের লম্বা অধ্যায়। তবে প্রতিভার জোরে তিনি হালে পানি পেয়েছিলেন এবং একটু একটু করে নির্মাণ করে নিয়েছিলেন নিজের আসনটি। এদেশে মানুষ তাকে ‘নায়করাজ’ হিসেবেই মেনে নিয়েছিলেন। এবং দীর্ঘসময় ধরে আমাদের চলচ্চিত্র আর রাজ্জাক ছিলেন সমার্থক। এই রাজ্জাককে পরিপূর্ণ ‘নায়ক’ করে প্রথমবার পর্দায় হাজির করেছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আরেক বিস্ময়কর প্রতিভা জহির রায়হান।
মাত্র ৩৭ বছরের একটা জীবন পেয়েছিলেন তিনি। সেই জীবনে ‘জীবন থেকে নেয়া’ আর ‘বেহুলা’র মতো দুটো সিনেমা আছে তার। লোককাহিনি নির্ভর বেহুলায় জহির রায়হান রাজ্জাককে নায়ক করলেন সুচন্দার সঙ্গে। এতো এতো সীমাবদ্ধতার ভেতরও সাদাকালোয় নির্মিত বেহুলার সিনেমাটোগ্রাফ দেখার বিষয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মাইলস্টোন ‘জীবন থেকে নেয়া’য় অন্যতম চরিত্রে রাজ্জাক। জহির রায়হানের হাতে এমন ব্রেক পাওয়ার পর রাজ্জাককে আর থেমে থাকতে হয়নি।
নিজস্ব স্টাইল
নির্বাক থেকে সবাক। সাদাকালো-ইস্টম্যান কালার। আংশিক রঙিন থেকে বাংলা সিনেমার ডিজিটাল ফর্মে যাত্রা, এতো কিছুর ভেতর দিয়ে চলচ্চিত্র ১০০ বছর পেরিয়েছে অনেক আগেই। তারপরও হলিউড থেকে বলিউড, টালিউড থেকে ঢালিউড কজন মানুষের নাম আসে ঘুরে ফিরে। চার্লি চ্যাপলিন, রাজকাপুর, দীলিপ কুমার, উত্তম কুমার, জহির রায়হান, সুভাষ দত্ত নামগুলো ঘুরে ফিরে আলোচনায় আসে এবং আসতে থাকবে। কেনো? তাদের নিজস্ব ঢং মানে স্টাইলের জন্য। রাজ্জাক বাংলা চলচ্চিত্র বিশেষ করে ঢাকাই সিনেমায় সেই জায়গাটি চিরস্থায়ী করেই বিদায় নিলেন। বাঁকানো পায়ের ছিপছিপে এক তরুণ, ভর দুপুরে একা একা ছুটছেন রাজপথ ধরে আর গাইছেন-‘নীল আকাশের নীচে আমি রাস্তায় চলেছি একা।’ অথবা সেই গানটি ‘ওদুটি নয়নে শয়নে চয়নে নিজেরে ভুলে যায়/ আজ মন রাখা হলো দায়’। অথবা টেলিফোনের দু’প্রান্তে আবেগে ভিজে একাকার সেই গানটি-‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’-এভাবে রাজ্জাক নিজের স্টাইল তৈরি করে নিয়েছিলেন। তার নিজস্বতা এমনি ছিলো যে রংবাজের মতো একটি মারদাঙ্গার ছবিও সুপার-ডুপার হিট হয়ে গেলো। সেসময় রংবাজের গান- ‘এই পথে পথে আমি একা চলি’, ‘সে যে কেনো এলো না’ আর ‘হৈ হৈ রঙ্গিলা রঙ্গিলারে’ মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। এবং অনেক বছর পর রংবাজ রঙিন হয়ে রিমেক হয়েছে। পর্দায় রাজ্জাকের হাঁটা, নায়িকার সঙ্গে রোমাঞ্চ আর সংলাপ বলার ঢং ছিলো একদম তার নিজের মতো। তার পর্দা উপস্থিতি দর্শককে কখনোই ক্লান্ত করেনি।
যেভাবেই হোক রাজ্জাক নিজেকে চলচ্চিত্রের সঙ্গেই জড়িয়ে রেখেছিলেন। চলচ্চিত্র ব্যবসায় পথ চলার জন্য রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন করেছেন। দুই সন্তান বাপ্পারাজ আর সম্রাটকে যুক্ত করেছেন সিনেমার সঙ্গে। পাগলা রাজা আর জোকার নামে দুটি সিনেমায় রাজ্জাক নিজের কন্যার সঙ্গেও অভিনয় করেছিলেন। সেই অর্থে রাজ্জাকের পুরো পরিবারই সিনেমা নির্ভর। পরিচালক হিসেবেও কম আলোচিত হননি তিনি। ববিতার সঙ্গে জুটি বেধে নির্মাণ করেছিলেন ‘অনন্ত প্রেম’ নামে দারুণ এক স্মার্ট প্রেমের ছবি। সব মিলিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে রাজ্জাকের নাম এই বলে খ্যাত হয়ে গেছে তিনি ‘সিনেমাঅলা’।
এই মানুষটার চলে যাওয়ায় একটা যুগ, একটা ইতিহাসের পর্দা নেমে গেলো!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)