হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া হাসনাত করিমকে বাদ দিয়ে ৮ জনকে অভিযুক্ত করে ঢাকার সিএমএম আদালতে চার্জশিট দিয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট।
সোমবার দুপুরে আদালতে এই চার্জশিট দাখিল করা হয়। এর আগে সিটিটিসির দেয়া চার্জশিট অনুমোদন দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সোমবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য দেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই ঘটনায় ২১ জনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলেও এদের ১৩ জন বিভিন্ন সময়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হওয়ায় তাদের বাদ দিয়ে ৮ জনকে আসামী করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার হওয়াদের মধ্যে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমের ‘কোন সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায়’ চার্জশিট থেকে বাদ দেয়া হয়েছে তাকে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং বিভিন্ন সময়ে আলামত সংগ্রহকারীসহ তদন্ত সংশ্লিষ্ট দু’শ ২৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
জঙ্গি হামলার পরদিন সকালে উদ্ধারকৃত জিম্মিদের মধ্যে রহস্যজনক আচরণের কারণে হাসনাত করিমকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নেওয়া হয়। ঘটনার কয়েকদিন পর হাসনাতকে ছেড়ে দেওয়ার কথা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হলেও তাকে আর ছাড়া হয়নি।
একজন কোরিয়ান নাগরিকের গোপনে ধারণ করা ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর হাসনাত করিমের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষকের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বলেও অভিযোগ ওঠে।
গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় ওই বছরের ৩ আগস্ট তাকে ৫৪ ধারায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। ৪ আগস্ট প্রথম দফায় হাসনাতের আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ১৩ আগস্ট গুলশান হামলার মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
২৪ আগস্ট গুলশান হামলা মামলায় গ্রেপ্তার হাসনাত করিমের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। হাসনাত করিম বর্তমানে কাশিমপুর কারাগারে রয়েছেন।
অভিযানে নিহত হলি আর্টিজানের পাচক সাইফুল ইসলামকে শুরুতে সন্দেহের তালিকায় রাখা হলেও তার সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ তদন্তকারীরা পাননি।
সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম বলেন, সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তারা ওই অভিযোগপত্র আদালতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
তিনি জানান, জীবিত আট আসামির মধ্যে ছয়জন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন, বাকি দুজন পলাতক।
কারাগারে থাকা ছয় আসামি হলেন- জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগান, রাশেদুল ইসলাম ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান এবং হাদিসুর রহমান সাগর।
পলাতক দুই আসামি শহীদুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চাওয়া হয়েছে বলে জানান মনিরুল।
তিনি বলেন, তদন্তে দেখা গেছে, আসামিরা পাঁচ মাস আগে থেকেই হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশকে অস্থিতিশীল করা, বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র বানানো, সরকারকে চাপের মুখে ফেলা।
কাউন্টার টেররিজমের কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্ত প্রতিবেদনে চিহ্নিত ২১ জনের মধ্যে পাঁচজন গুলশান হামলায় সরাসরি অংশ নেন। বাকিরা হামলার পরিকল্পনা, সমন্বয়, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র-বোমা সংগ্রহসহ বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত ছিলেন।
গুলশান হামলার পর জঙ্গিবিরোধী বিভিন্ন অভিযানে হামলার ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ তামিম চৌধুরী, জাহিদুল ইসলাম, তানভীর কাদেরী, নুরুল ইসলাম মারজান, আবু রায়হান তারেক, সারোয়ার জাহান, বাসারুজ্জামান চকলেট ও ছোট মিজান নিহত হন।
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ২০১৬’র পয়লা জুলাই রাতভর জিম্মি করে রেখে জঙ্গিরা দুই পুলিশ কর্মকর্তা এবং ৯ ইতালীয়, ৭ জাপানি, এক ভারতীয় ও এক মার্কিন নাগরিককে হত্যা করে। মামলায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট- সিটিটিসি’র তদন্তে উঠে আসে জঙ্গি নেতা কানাডীয় নাগরিক তামিম চৌধুরী, সারোয়ার জাহান, তানভীর কাদেরী শিপার, নূরুল ইসলাম মারজান বাশারুজ্জামান চকলেট, মেজর জাহিদ, ছোট মিজান এবং নিবরাসসহ জঙ্গিরা নাটোরের একটি বাসায় বসে হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন হামলার মোটিভ ছিলো নতুন গড়ে ওঠা নব্য জেএমবির অস্তিত্ব জানান দেয়া। নেতৃত্ব পর্যায়ে জঙ্গিদের একজনকে জীবন্ত ধরতে না পারায় হলি আর্টিজানের হামলার পেছনে দেশের কোনো রাজনৈতিক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো কি না, জানতে পারেননি তদন্তকারী গোয়েন্দারা।