শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর রোববারের (৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম ছিল ‘স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ নিহত ১৪’। এটি শুক্রবার রাত থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশের ১০ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পরিসংখ্যান।
আরেকটি প্রথম শ্রেণির জাতীয় দৈনিক কালের কন্ঠ’র সোমবারের (৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) সংখ্যায় শেষপৃষ্ঠার একটি শিরোনাম হলো ‘মায়ের সামনে ট্রাকে পিষ্ট তিন বছরের শিশু, বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৪’। ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রোববারের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের তথ্য এটি।
যেকোনো মৃত্যুই বেদনার। তবে দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো কারণে অকাল মৃত্যু অধিক বেদনাদায়ক। আর সেই মৃত্যুর শিকার যদি সম্ভাবনাময় শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী তথা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হন তাহলে বিয়োগযন্ত্রণা বহুগুণ বেড়ে যায়। স্বপ্নভঙ্গ ও অপূরণীয় ক্ষতি হয় নিহত পরিবারগুলোর; যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সড়ক দুর্ঘটনা ও অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণহানি এখন নিত্যদিনের ঘটনা। গত দুই দশকে এমন একটি দিন নেই, যেদিন পত্রিকার পাতায় সড়কে মৃত্যুর খবর ছিল না। বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম মাসে (১-৩১ জানুয়ারি) সারা দেশে ৩৮৩টি দুর্ঘটনায় ৪১১ জন নিহত ও ৭২৫ জন আহত হয়েছেন। নিহতের তালিকায় ৫৩ নারী ও ৭১ শিশু, আর আহতদের মধ্যে ৫৮ নারী ও ৪০ শিশু রয়েছে।
গেলো বছর (২০১৮) ৪,৩১৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৯১ নারী ও ৬৭৯ শিশুসহ ৪,৫৮০ জন নিহত এবং ১০,৮২৮ জন আহত হয়েছে। এর পূর্ববর্তী বছর ২০১৭ সালে সারা দেশে দুর্ঘটনা ঘটেছিল ৪,২৮৪টি। এতে ৫১৬ নারী ও ৫৩৯ শিশুসহ ৪,২৮৪ জন নিহত ও ৯,১১২ জন আহত হয়। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে প্রাণহানির হার প্রায় ৭ (৬ দশমিক ৯) শতাংশ ও আহতের হার প্রায় ১৯ (১৮ দশমিক ৮৪) শতাংশ বেড়েছে (সূত্র: নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি)।
২০১১ সালে নন্দিত চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ ও প্রখ্যাত সাংবাদিক মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পর দেশের প্রায় সকল মহল সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছিল। সেই থেকে বিভিন্ন সংগঠনসহ সমাজের নানা পর্যায়ের মানুষও দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে কম-বেশি সোচ্চার। তবে গত বছরের শেষার্ধে সড়ক দুর্ঘটনা বিরোধী আন্দোলন নতুন মাত্রা পেয়েছিল। ওই বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বনানীতে বিমানবন্দর সড়কে দু’জন কলেজশিক্ষার্থী বাস চাপায় নিহত হওয়ার পর প্রথমে ফুঁসে উঠেছিল রাজধানীর ছাত্র সমাজ; এরপর সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র-ছাত্রীসহ গোটা জাতি। সপ্তাহজুড়ে চলা ওই অহিংস আন্দোলনের বিশেষত্ব ছিল- নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীর রাজপথে হাজার হাজার শিশু-শিক্ষার্থীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও অভিভাবকদের সমর্থন।
পরিস্থিতি এতোটাই টালমাটাল হয়ে উঠেছিল যে, তা নিয়ন্ত্রণে আনতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেই হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) সব ধরনের ত্রুটিপূর্ণ ও রুট পারমিট বিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন ও জাল লাইসেন্সধারী চালকসহ ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশী অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনার মূল উদ্দেশ্য হলো- আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর পেছনে উপরোক্ত কারণগুলিই মূখ্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে সড়কে কিছুদিনের জন্য হলেও শৃঙ্খলা কিছুটা ফিরে এসেছিল।
এর পরপরই প্রথমে মন্ত্রিসভায় ও পরে জাতীয় সংসদে পাস করা হলো সড়ক পরিবহন আইন (সংশোধিত) ২০১৮। তবে নতুন আইনের কতিপয় ধারা বাতিলের দাবিতে মালিক-শ্রমিক উভয়পক্ষ মিলে সারা দেশে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে সাধারণ জনগণকে চরম দুর্ভোগে ফেললো। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে- ধর্মঘট আহ্বানকারী পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের দুই শীর্ষ নেতাই তখন মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন; যারা আইন পাসের সময় মন্ত্রিসভা বৈঠক ও সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত থেকে নতুন আইনের পক্ষেই মত দিয়েছিলেন। অথচ সংবিধান মেনে শপথ নেওয়া মন্ত্রীদ্বয় ধর্মঘট ডেকে স্ববিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে শপথ ভঙ্গ ও সংবিধান লঙ্ঘন করলেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যদিও এবারের মন্ত্রিসভায় বিতর্কিত ওই দুই নেতার ঠাঁই মেলেনি।
দুর্ঘটনা রোধসহ সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কিছুদিন আগেই সারা দেশে শুরু হয়েছে পক্ষকালব্যাপী বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ। এ লেখার শুরুতে দুটি পত্রিকার বরাত দিয়ে দু’দিনের সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির যে তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে, সেসব দুর্ঘটনা ‘বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ’র মধ্যেই ঘটেছে। সোমবার রাজধানীর রাজারবাগে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করলেন পুলিশ সপ্তাহ-২০১৯। সেখানেও তিনি বলেছেন, মাদকের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নিরাপদ সড়ক গড়তে জনসচেতনতাসহ বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে (সূত্র: চ্যানেল আই অনলাইন)।
এতোকিছু সত্ত্বেও সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না; বরং সড়কে লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এতে কী শুধু নিহত পরিবারগুলো পথে বসছে, তাদেরই স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে? না, এভাবে অকালে অদক্ষ-অদক্ষ ও উদীয়মান মানবসম্পদ ধ্বংস হওয়ায় জাতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের তথ্য মতে, সড়ক দুর্ঘটনায় বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৪ হাজার কোটি টাকা; যা জিডিপির দুই শতাংশ [সূত্র: দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্র (এআরআই), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
দুর্ঘটনা রোধে বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্রগুলোর বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোনো গাফিলতির প্রমাণ নেই। এ ক্ষেত্রে পুলিশ আগের চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হয়েছে। সড়কমন্ত্রীও রাজপথে সরব। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেই যথেষ্ট আন্তরিক ও কঠোর। তাহলে প্রশ্ন- সড়ক দুর্ঘটনা কেনো কমছে না?
জাতীয় কোনো সংকটই একপক্ষের দ্বারা নিরসন করা সম্ভব নয়। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা সে শিক্ষাই দেয়। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনা এখন আর সমস্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, রীতিমতো জাতীয় সংকটে রূপ নিয়েছে; যা শুধু বিআরটিএ, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও ভ্রাম্যমান আদালত দিয়ে নিরসন করা যাবে না। এটা মোকাবিলার জন্য দরকার সম্মিলিত প্রয়াস। এই প্রয়াসে যুক্ত করতে হবে সব পর্যায়ের স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন, সব ধরনের পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সর্বোপরী সাধারণ জনগণকে। এ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি করাই হবে মুখ্য কাজ। সুষ্ঠু পরিকল্পনা মাধ্যমে ইউনিয়ন থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলেই সড়ক দুর্ঘটনা সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)