প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাণনাশের ভণ্ডুল চেষ্টার এক খবর প্রকাশ করেছে মিয়ানমার ও ভারতের মিডিয়া। ওই প্রতিবেদন করেছেন বিবিসির সাবেক সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, এই সংবাদ মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের বিবৃতি আমাদেরকে স্বস্তি দিয়েছে, কিন্তু উদ্বেগ কমায়নি। কারণ শেখ হাসিনা প্রাণনাশের হুমকির মধ্যেই আছেন এবং সেটা দেশি-বিদেশি আততায়ীদের দ্বারাই। এ পর্যন্ত তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে ১৯ বারের মতো। এর মধ্যে আছে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো প্রকাশ্য ঘটনাও, এর বাইরে আছে গোপনীয় অনেক চেষ্টা। তবে আগের সকল ঘটনার চাইতে এবারকার সংবাদের ধরণ আলাদা, কারণ এবার মিয়ানমার ও ভারতীয় মিডিয়ার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তাকে হত্যার এ প্রচেষ্টা চালিত হয়েছিল তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজনের মাধ্যমে, এবং সে একই বাহিনীর কিছু সদস্য দ্বারা তিনি প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। এ সংবাদেও সত্যি হলেও উদ্বেগের, আবার মিথ্যা হলেও উদ্বেগের।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) সদস্যদের নিয়ে এমন অবিশ্বাস্য ও আতঙ্কের কাহিনী এর আগে কখনও শোনা যায় নি। তাই এটা ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনায় একটা উপাদান যুগিয়েছে সন্দেহ নেই। এছাড়া এ সংবাদ প্রকাশের পর এ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে পরস্পরের মধ্যকার এক ধরনের অবিশ্বাস ও সন্দেহের জন্ম দিতে পারে যা স্বাভাবিক নিরাপত্তা প্রদানের একটা অন্তরায় হিসেবে কাজ করবে, ভবিষ্যতে।
ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপদ নন শেখ হাসিনা- এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে চলেছে। এর ফল খুব বাজে হতে যাচ্ছে। ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তাহীনতায় থাকা, আর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদেরকে সন্দেহের মধ্যে রাখা কারও পক্ষে আর যাই হোক স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব নয়।
বিবিসির সাবেক সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের এ প্রতিবেদন প্রথম প্রকাশ করেছেন মিয়ানমারের একটা অনলাইনে। সংবাদমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণের দেশ মিয়ানমারের মিজিমা ডটকম নামের ওই অনলাইন তাদের সামরিক বাহিনীর অনুমোদন সাপেক্ষ। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিপক্ষে যায় এমন কোন সংবাদ ওই দেশে কোন সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ করতে পারে না। শেখ হাসিনার হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে মিয়ানমার সেনাদের সম্পর্ক এক মাস আগেও না থাকলেও সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের আগ্রহ বেড়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডে আতঙ্কিত রাখাইনের রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারের এ গণহত্যাকে বিশ্বমাঝে উপস্থাপন করেছেন। যে কারণে মিয়ানমার বর্তমানে সারাবিশ্বের অদৃশ্য অবরোধের মুখে পড়েছে; দৃশ্যমান নানাবিধ অবরোধ হয়ত আসছে সামনে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে। যুক্তরাজ্য জানিয়ে দিয়েছে, তারা মিয়ানমারের সেনাদের প্রশিক্ষণ সহায়তাসহ অন্যান্য সহায়তা আর দেবে না।
মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির বিরুদ্ধে সারাবিশ্ব একাট্টা হয়ে ওঠেছে। জাতিসংঘের এবারকার অধিবেশনের আলোচনার উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও তাদেরকে দেশত্যাগে বাধ্য করা। এমন অবস্থায় চীন, পাকিস্তান আর ভারত ছাড়া আর কেউ মিয়ানমারের পাশে নাই। দেশটির কূটনৈতিক এমন হাল আদতে বাংলাদেশের শক্তিশালি কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে, এবং এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনাই।
এমন অবস্থায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রাণনাশের চেষ্টায় তার নিরাপত্তা বাহিনী বিশেষ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে একটা অবিশ্বাসের বীজ বপনের সর্বোচ্চ চেষ্টা মিয়ানমারের সেনা কর্তৃপক্ষ যে করবে না সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। এবং এর মোক্ষম চাল হিসেবে তারা হয়তো ব্যবহার করেছে সুবীর ভৌমিককে। বিবিসির সাবেক সাংবাদিক পরিচয়ের বাইরে তার আলাদা পরিচয় হচ্ছে তিনি বাংলাদেশের অনেকের কাছে পরিচিত, অনেক মিডিয়ার ঘনিষ্ঠ। তাছাড়া শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে এ সংবাদে তারা ভারতীয় গোয়েন্দাদেরও সম্পৃক্ত করেছে সুকৌশলে, যাতে বিশ্বাসযোগ্যতার পাশাপাশি সন্দেহও দানা বাঁধে। সেনা নিয়ন্ত্রণে থাকা সংবাদমাধ্যমের দেশ মিয়ানমার থেকে যে সংবাদের উৎপত্তি সে সংবাদ নিয়ে ভারতীয় একটি টেলিভিশন চ্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যেখানে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বক্তব্য নিলেও মন্ত্রী এ সংবাদের সত্যতা স্বীকার করেননি। কিন্তু অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা দাবি করেন, মন্ত্রী স্বীকার করেছেন। এর বাইরে ভারতীয় একটি অনলাইনও এ সংবাদ প্রকাশ করে। মিয়ানমার সেনাদের ঘনিষ্ঠ মিডিয়া ও ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিকের ঘনিষ্ঠ কিছু মিডিয়া বাদে এই সংবাদ কেউ প্রকাশ করেনি, যারা প্রকাশ করেছে তারা মিথ্যা করে হলেও এ সংবাদ প্রতিষ্ঠা করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছে।
মিয়ানমারের সেনানিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার সংবাদ এবং সুবীর ভৌমিকের এ ফরমায়েশি লেখা বাংলাদেশের কিছু মিডিয়াও প্রকাশ ও প্রচার করেছে। খেয়াল করলে দেখা যায়, এদের প্রায় সকলেই সরকার ও আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর মালিকানাধীন ডিবিসি নিউজ এটা প্রচার করেছে; প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস; প্রকাশ করেছে মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মালিকানাধীন ইত্তেফাক; প্রচার করেছে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ বলে স্বীকৃত একাত্তর টিভিসহ আরও কিছু মিডিয়া। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এসব মিডিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে এত বড় একটা ঘটনার পরেও রাষ্ট্রীয় বক্তব্য জানার চেষ্টা না করে কেবল আস্থা রেখেছে ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষান্তরের। কেউ কেউ আবার টেলিফোনে হাজির করেছে সুবীর ভৌমিককেও। এতে করে যে সংবাদের উৎপত্তি হলো মিয়ানমারের সেনানিয়ন্ত্রিত মিডিয়া থেকে সেটা পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী তাকে খুন করে ফেলতে পারে- এমন এক কৌশল সূত্রবিহীন সূত্রের পরও পৌঁছেছে মানুষের কাছে, একইসঙ্গে ষড়যন্ত্রকারীদের কাছেও রসদ হয়ে।
সাধাণ মানুষ সংবাদের সূত্রের চাইতে সংবাদমূল্য দেখেছে। আঁতকে ওঠে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এমন ষড়যন্ত্রের কথা শুনে। অনেকেই বিশ্বাস করেছে।
সুবীর ভৌমিকের এ প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নাকচ করার পর এ নিয়ে খেপেছেন ভৌমিক; তার ফেসবুক প্রতিক্রিয়া দেখে সেটাই অন্তত মনে হয়। ফেসবুকে এসব নিয়ে আরও লিখবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। লেখালেখির এ পর্যায়ে তিনি জানিয়েছেন, ওই ঘটনায় নাকি কয়েকজন সেনাসদস্য নিহতও হয়েছেন। সোমবার ফেসবুকে সুবীর ভৌমিক নিহতদের একজনের পরিচয় ক্যাপ্টেন রাসেল আজাদ দাবি করে পর্যায়ক্রমে নিহত আরও এসএসএফ সদস্যের পরিচয় প্রকাশ করবেন বলে জানান। তার এই পোস্টের পর এটা নিয়ে অনলাইন মাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বিষয়টি অনুসন্ধান শুরু করে দেখে সুবীর ভৌমিকের তথ্য সঠিক নয়। বিডিনিউজের এক সংবাদে দেখা যায়, মেজর মোহাম্মদ রাসেল আজাদ ভূঁইয়া নামের ওই সেনা সদস্য প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে ‘অগ্রবর্তী দলের অংশ হিসেবে’ বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন। সুবীর ভৌমিক যে এসএসএফ সদস্যকে মৃত বলছেন, তিনি এখন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা দিতে তার সঙ্গে বিদেশ সফরে আছেন।
সুবীর ভৌমিকের সোমবারের ফেসবুক পোস্টের পর এ নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির অনেকেরই বিরোধিতা ও আক্রমণের মুখে পড়েছেন। অনেকে তাঁকে র’-এর এজেন্ট বলছেন, এর জবাবে তিনিও জানাচ্ছেন বাংলাদেশে কারা র’-এর টাকা খায় সেটা তিনি দেখিয়ে দেবেন। এসব ভয়ঙ্কর ব্যাপার।
মিয়ানমার ও ভারতীয় মিডিয়ায় প্রকাশিত সুবীর ভৌমিকের প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন বলেছে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিকে আমরা বিশ্বাস করতে চাই। একইসঙ্গে দাবি করি সতর্কতারও, কারণ যাদেরকে উদ্দেশ্য করে এ ব্যর্থ হামলার কথা বলা হচ্ছে সে অবস্থানটি খুবই স্পর্শকাতর। সন্দেহের কথা যখন একবার উঠেই গেছে তখন আরও সতর্কতা জরুরি। এটা যখন সারাদেশের মানুষ এবং এসএসএফ সদস্যদের মধ্যেও পৌঁছেছে তখন বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজন আছে।
মিডিয়া সংশ্লিষ্টজন ও মিডিয়ার কাছে দাবি থাকবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে অন্তত দায়িত্বশীলতা। ‘সবার আগে সংবাদ’ প্রকাশ মিডিয়ার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না, ‘সবার আগে সঠিক সংবাদ’ প্রকাশই বরং দায়িত্বশীলতা। আর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা যখন কোনও সংবাদে সংযুক্ত হয়ে যায় তখন দরকার অতিরিক্ত সচেতনতা এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের শরণ নেওয়া। আশা করি ভবিষ্যতে সেটাই দেখতে পাব!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)