করোনার কারণে এ বছর বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের আনুষ্ঠানিকতা নেই। তবে এ বছর দিনটি এমন সময়ে এলো, যার কয়েক দিন আগেই রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আরও একধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। এই সূচকে প্রতিবেশি সবগুলো দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে। এমনকি যে মিয়ানমারে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই, সেই মিয়ানমারেরও পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ।
সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমরা স্মরণ করতে পারি, করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের বিভিন্ন খাতের জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রায় এক লাখ কোটি টাকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন, সেখানে গণমাধ্যম কেন নেই- তা নিয়ে অনেকে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের তরফেও সরকারের কাছে প্রণোদনা বা বিশেষ সহায়তার দাবি জানানো হয়েছে। এই ইস্যুতে আমি একটু ভিন্ন মত পোষণ করতে চাই।
আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, গণমাধ্যম বরাবরই সরকারের প্রতিপক্ষ। সাংবাদিকরা যেহেতু সরকারের ওয়াচডগ হিসেবে ভূমিকা পালন করেন, সে কারণে সরকারের সাথে গণমাধ্যমের সব সময়ই একটা মুখোমুখি অবস্থান থাকে। এর কারণ যখন যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, তারা অন্যায় করবেই এবং সেই খবর মানুষকে সাংবাদিকরা জানায়। অতএব সরকার গণমাধ্যমের সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হবে, এই সরল ভাবনার কোনো কারণ নেই। সরকার কখনোই তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের বন্ধু ভাবে না।
আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলতে পারি, ২০০৩ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আইন প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান ওমর এবং তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে প্রথম আলোয় রিপোর্ট করে ছাত্রদল যুবদলের হামলা মামলার শিকার হয়ে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসি। ২০০৩ সালের ৮ ডিসেম্বর ঝালকাঠিতে কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল, তা ওই সময়ের পত্র-পত্রিকা খুঁজলে পাওয়া যাবে। দীর্ঘদিন পালিয়ে ছিলাম। তারপর থেকে ঢাকাতেই কাজ করি। অথচ এখন যদি আমি টকশোতে বা কোনো কলামে অথবা ফেসবুকে এমন কিছু লিখি যাতে সরকারের কোনো কাজের বা সিদ্ধান্তের সমালোচনা হয়, তখন সরকারের অনুসারীরা বলবেন, আমি বিএনপির দালাল। মানে হলো, সাংবাদিকরা সব সময়ই ক্ষমতাবানদের শত্রু। তাতে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকুক। বিএনপির আমলে যখন ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে লিখেছি, তখন তারা বলেছে আওয়ামী লীগের দালাল। আবার এখন যদি বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের কাজের প্রশংসা করি, তাহলে আমাদের সহকর্মীরাই বলবেন, সরকারের দালাল। মানে সাংবাদিকরা সব সময়ই দালাল।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের সূচকে নজর দেয়া যাক। কেন বাংলাদেশ বিশ্বে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ক্রমশই পিছিয়ে যাচ্ছে, তার উত্তর খুঁজতে গেলে মুক্ত গণমাধ্যমের মানদণ্ডগুলো জানতে হবে। সেই মানদণ্ড যাই হোক, গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের আচরণ যাই হোক, আখেরে এই সূচকে পশ্চাদপসরণের প্রধানত দায় গণমাধ্যমকর্মী এবং তাদের প্রতিষ্ঠানের মালিকদেরই। কতজন মালিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার পাশাপাশি এগুলোকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভেবেছেন? হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে পেশাদারিত্বের কোনো চর্চা নেই। কর্মীবান্ধব মানবসম্পদ নীতি নেই; নামকাওয়াস্তে একটি ওয়েজবোর্ড থাকলেও অধিকাংশ সংবাদপত্র তার ধার ধারে না। টেলিভিনে তাও নেই। মাসের পর মাস বেতন বন্ধ। যারা বেতন দেয়, তারা অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা থেকে কর্মীদের বঞ্চিত করে। যখন-তখন ছাঁটাই। এমনকি এই করোনার দুঃসময়েও ছাঁটাই বন্ধ নেই। গণমাধ্যমের জন্য মালিকদের কোনো বিজনেস মডেল নেই। তারা তাদের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান চালু করেন। ফলে তাদের জন্য একটা সাইনবোর্ডই যথেষ্ট। তারা প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারলেই খুশি। তার প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা বেতন পেলেন কি না, নিয়োগপত্র আছে কি নেই, চাকরিচ্যুতি বা কোনো সংবাদকর্মী স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিলে তার দেনা পাওনা সঠিক নিয়মে পরিশোধ করা হলো কি না- তা নিয়ে মালিকদের ভাবনা নেই। যে খাতের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাই এত দুর্বল, সেখানে সরকার কী সহায়তা দেবে বা কেনই বা দেবে?
কেউ কি স্মরণ করতে পারেন বা বলতে পারেন যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার গত প্রায় ৫০ বছরের কোন দশক বা কোন বছরটি গণমাধ্যমের জন্য খুব সুসময় ছিল বা সরকার গণমাধ্যমের জন্য খুব সহায়ক ছিল? এমনকি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (যাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা ছিল না বলে দাবি করা হয়) আমলেও দেশের সাংবাদিকরা বা গণমাধ্যম খাত খুব আরামে ছিল, এমন দাবি কেউ করতে পারবেন? যদি তাই হয়, তাহলে সরকার গণমাধ্যমের জন্য এটা করে দেবে, ওটা করে দেবে- এমন ভাবনার কী কারণ থাকতে পারে?
তাহলে গণমাধ্যম কিভাবে টিকবে? গণমাধ্যম টিকবে তার নিজের শক্তিতে। যদি গণমাধ্যম টিকে থাকার মতো শক্তি অর্জন করতে না পারে, তাহলে তার গণমাধ্যম হিসেবে পরিচয় দেয়ার কোনো মানে নেই। সরকার তার জন্য কুসুমাস্তীর্ণ পথ তৈরি করে দেবে এবং সেই পথে সে হাঁটবে- এমন প্রত্যাশা মূলত বোকার স্বর্গের বসবাস। হ্যাঁ, সরকার কুসুমাস্তীর্ণ পথ তৈরি করবে সেইসব গণমাধ্যমের জন্য, যারা তার মুখপত্র যেমন বিটিভি, বাংলাদেশ বেতার, বাসস ইত্যাদি। যেগুলো জনগণের পয়সায় চলে। যেসব প্রতিষ্ঠান সরকারের কোনো কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। কোনো অনিয়ম দুর্নীতির অনুসন্ধান করে না। কিন্তু যেসব গণমাধ্যম অনিয়ম দুর্নীতি খুঁজে বেড়ায়, উন্নয়ন প্রকল্পে লুটপাট হলে সেই খবর তুলে ধরে, ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার অপব্যবহারের সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করে- সেইসব গণমাধ্যমের জন্য সরকার প্রণোদনা দেবে বা সহায়ক হবে, এমন ভাবনার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। বরং গণমাধ্যমকে টিকে থাকতে হবে জনগণের আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম এখন জনগণের আস্থা অর্জনের চেয়ে সরকারের আস্থা অর্জনে বেশি সচেষ্ট। ফলে গণমাধ্যম ক্রমশই জনবিচ্ছিন্ন একটি প্রচারমাধ্যমে পরিণত হচ্ছে। সুতরাং এরকম একটি বাস্তবতায় ২০২০ সালের তেসরা মে যখন Journalism Without Fear or Favour স্লোগানে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস হাজির হয়, সেটি ওই অর্থে কোনো তাৎপর্য বহন করে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)