নারীর উপর সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্য আর নিপীড়ন বিদ্যমান থাকা অবস্থায় সারা বিশ্বে ৮ মার্চ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আমাদের চোখে উন্নত পুঁজিবাদী দেশ যুক্তরাষ্ট্র মাত্র গত শতকের ষাট দশকে নারীর ভোটাধিকার বাস্তবায়ন করেছে। সারাবিশ্বে এখনও কমেনি বৈষম্য। আর অভ্যন্তরীণ নির্যাতনতো আছেই। বাংলাদেশে সব সরকারের আমলে নারীরা অপেক্ষাকৃত অবহেলার স্বীকার হলেও এই সরকারের আমলে নারীর প্রতি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বেড়েছে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে সরকার দমন-পীড়ন চালায়। ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯১০সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হয়। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে। বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার লাভের আগে থেকেই এই দিবসটি পালিত হয়। ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে পৃথিবী জুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অভীপ্সা নিয়ে। অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশের মতো বাংলাদেশেও নারী নির্যাতনের ভয়াবহ অবস্থা বিদ্যমান। গতকাল বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণায় জানানো হয়েছে, ৮০ শতাংশ নারী বিভিন্ন ভাবে নির্যাতিত হয়ে থাকে শারীরিকভাবে। ব্র্যাকের গবেষণা অনুযায়ী—নারী পথচারীদের মধ্যে ৪২ শতাংশের অভিযোগ, ১৯-২৫ বছর বয়সী তরুণরা যৌন হয়রানি করে। ২৬-৪০ বছর বয়সী পুরুষদের মাধ্যমে এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রায় ৫০ শতাংশ নারী। নারী পথচারীদের জন্য সবচেয়ে বিপদজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ২৬-৪০ বয়সী যৌন নির্যাতনকারীরা। গবেষণায় আরো বলা হয়, যৌন নির্যাতনকারী পুরুষরা ইচ্ছে করে নারীদের স্পর্শ করে বা চিমটি কাটা, কাছে ঘেঁষে দাঁড়ানো বা আস্তে ধাক্কা দেওয়া, চুল ধরা বা কাঁধে হাত রাখা কিংবা শরীরের অন্যান্য অংশে স্পর্শ করে থাকে। হয়রানির শিকার নারীদের সঙ্গে কথা বলে তারা জেনেছে, ভুক্তভোগীদের ৮১ শতাংশই নীরব থাকেন আর ৭৯ শতাংশ ঘটনাস্থল থেকে সরে যান। এই চিত্র নগরের হলেও গ্রামের নারী নির্যাতন আরো ভয়াবহ। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের এই নৈতিক বিপর্যয়ের সংবাদ আমাদের লজ্জিত করে। আমরা আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে কেবল একটি দিবস হিসেবে দেখতে চাই না। আমরা চাই, সমাজের সবক্ষেত্রে নারীর বৈষম্য ও অবমাননা বন্ধ হোক।