দেশে বহুল প্রচলিত মাদক গাঁজাকে টপকে আশির দশকে পথভ্রষ্ট যুবসমাজকে ঘোরে মাতাতে আসে হেরোইন, নব্বইয়ের দিকে হেরোইনকে হটিয়ে জায়গা নেয় ফেন্সিডিল। আর গত কয়েক বছরে এইসব মাদককে ছাড়িয়ে গেছে এক উন্মাদনা জাগানো মেডিসিন অ্যাম্ফেটামাইন টাইপ স্টিমুলেন্ট (এটিএস), যার ডাক নাম ইয়াবা।
ইয়াবা আসলে ফেটামিন, মেথাফেটামিনের মিশ্রণে তৈরি ট্যাবলেট। ভ্যানিলা, অরেঞ্জ এবং লেমন ফ্লেভারে মিয়ানমার থেকে আসা গোলাপী, কমলা এবং লাল রঙের এই ট্যাবলেটে ভর করে কালো অন্ধকার নেমে এসেছে বাংলাদেশে। দেশে ইয়াবার শিকারদের মধ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ইয়াবা মহামারীর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে জানিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, গত কয়েক বছর ধরে মাদকে আগ্রহী তরুণদের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠেছে ইয়াবা। ২০১২ এবং ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে দেশে হেরোইনের প্রাদুর্ভাব কিছুটা কমে আসে।
প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ডিএনসি জানতে পারে, বিপুল সংখ্যক প্রাক্তন হেরোইনসেবী বর্তমানে ইয়াবায় আসক্ত হয়েছে। একই কারণে দেশে ফেন্সিডিলের প্রাদুর্ভাবও নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায় ২০১৬ সালে। কারণ হিসেবে ডিএনসি’র প্রতিবেদন বলছে, ফেন্সিডিলের চেয়ে দেশব্যাপী ইয়াবা সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় ফেন্সিডিল আসক্তরাও ইয়াবার দিকে ঝুঁকেছে।ইয়াবার এমন আগ্রাসী পরিস্থিতির পেছনে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল এবং মিয়ানমারের অসহযোগিতাকে দায়ী করছে ডিএনসি।
ইয়াবা মহামারীর বর্তমান চিত্র তুলে ধরে ডিএনসি’র মহাপরিচালক মোহাম্মদ জামাল উদ্দীন আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: এক সময়ে হেরোইন ছিলো প্রধান মাদক কিন্তু পরবর্তীতে ফেন্সিডিল তার জায়গা দখল করে। সাম্প্রতিক সময়ে ফেন্সিডিলের জায়গা দখল করেছে ইয়াবা নামের ট্যাবলেট। যা দেশের শহর-গ্রামের সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। ইয়াবা এখন আগ্রাসন চালাচ্ছে। বর্তমানে ইয়াবা যেভাবে অনুপ্রবেশ করছে এবং দেশব্যাপী খুব দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে তা আমাদের জন্য আতঙ্কের বিষয়। বাংলাদেশের প্রধান মাদক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ইয়াবা এবং বলা যায় এখন আমরা ইয়াবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি।
ইয়াবা মহামারীর কারণ হিসেবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং মিয়ানমারের নেপথ্য ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন: বাংলাদেশকে টার্গেট করে মিয়ানমার থেকে প্রচুর ইয়াবা প্রবেশ করানোর চেষ্টা প্রায় প্রতিদিনই করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের হাতে ইয়াবা জব্দের পরিমাণ বেড়েছে। এটার সঙ্গে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের সম্পর্ক থাকতে পারে।
একসময়ে থাইল্যান্ড ছিলো ইয়াবার প্রধান বাজার। কিন্তু গত কয়েক বছরে থাইল্যান্ডের বদলে ইয়াবার সবচেয়ে বড় বাজার হিসেবে মিয়ানমারের টার্গেট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। দেশে ইয়াবার টার্গেট বাজার রাজধানী ঢাকা।
দেশের সব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্ধার করা ইয়াবার পরিমাণের ভিত্তিতে করা ডিএনসি’র প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে ইয়াবা অনুপ্রবেশের শুরুর দিকে ২০০৮ সালে ইয়াবা আটকের পরিমাণ ছিলো ৩৬ হাজারের কিছু বেশি। এরপর থেকে উদ্ধার করা ইয়াবার সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধিতে বোঝা যায়, দেশে ক্রমবর্ধমান হারে ইয়াবার প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলেছে। ২০১১ সালে ১৩ লাখ ৬০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছিলো। ২০১৬ সালে ২ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার পিসের বেশি ইয়াবা আটক করা হয়। ২০১৬ সালে ডিএনসি কেবল ঢাকা থেকেই ৩ লাখ ৩৩ হাজার পিসেরও বেশি ইয়াবা উদ্ধার করে। ২০১৭ সালে সব বাহিনীর আটক করা হয় ইয়াবার পরিমাণ ছিলো ৪ কোটি ৭৯ হাজার পিস।
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে উদ্ধার করা ইয়াবার পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি বলে জানিয়েছেন ডিএনসি’র মহাপরিচালক।
বাংলাদেশে ইয়াবার অনুপ্রবেশ এবং সারা দেশে ইয়াবার আগ্রাসন প্রসঙ্গে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন ডিএনসি’র অপারেশন্স এবং গোয়েন্দা শাখার পরিচালক সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ।
দেশের মাদক পরিস্থিতির কেন্দ্রে চলে আসা ইয়াবা সম্পর্কে তিনি বলেন: হেরোইন, ফেন্সিডিল বন্ধে বাংলাদেশের আহ্বানে ভারতের সাড়া দেয়ার পর এসব সরবরাহ কমে আসছে। ১০ বছর আগেও ফেন্সিডিলের প্রাদুর্ভাব ছিলো। এখন ফেন্সিডিলকে ছাঁড়িয়ে প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে ইয়াবার। ফেন্সিডিলের চেয়ে ইয়াবা বহন করা খুবই সহজ এবং ইয়াবার রুট হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা তুলনামূলক অরক্ষিত।
তিনি আরও বলেন: মিয়ানমার হয়তো চিন্তাও করেনি যে বাংলাদেশ ইয়াবার এতো বড় বাজার হবে। কারণ তাদের টার্গেট ছিলো থাইল্যান্ড। ইয়াবা এমন এক মাদক যার জালে একবার জড়ালে কেউ বেরিয়ে আসতে পারে না। তাই বিপুল ইয়াবার অনুপ্রবেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অথচ এই এই ভয়াবহ মাদক উৎপাদনকারী প্রতিবেশি দেশটি ইয়াবা বন্ধে বাংলাদেশের আহ্বানে কোন সাড়া দিচ্ছে না। দেশে ইয়াবা আসক্তদের মধ্যে ৫০ শতাংশই যুবক-যুবতী। এই মাদকের হাত থেকে আমাদের তরুণ সমাজকে বাঁচাতেই হবে।
ডিএনসি’র প্রতিবেদনের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০১২ সালে চিকিৎসা নিতে আসা ইয়াবা আসক্তের পরিমাণ ছিলো মাত্র ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ যা ২০১৬ সালের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী গিয়ে দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৬১ শতাংশে।