কৌতূহল! নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি কৌতূহল কিশোর ও তারুণ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কৌতূহল ও নিষিদ্ধ জিনিস ঘেঁটে দেখার স্পৃহা ইতিপূর্বেই কেড়ে নিয়েছে দুই শতাধিক তাজা প্রাণ। ব্লু হোয়েল নামক প্রাণঘাতী এক খেলায় জড়িয়ে অকাতরে জীবন দিয়েছে কোমলমতি শিশু ও তরুণেরা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে (!) বাঙালি নতুন কোনো ইস্যু পেলে সেটাকে যাচ্ছেতাই করে ছাড়ে। আগা-গোড়া দেখে তবেই ক্ষান্ত হয়। এটাই ভয়ের অন্যতম কারণ। কৌতূহল নিবৃত্ত করতে কার সন্তান না মরণ খেলায় পা বাড়ালো?
ব্লু হোয়েল মানে নীল তিমি। নীল তিমি সাগর তীরে আছরে পড়ে আত্মহত্যা করে বলে এমন নাম। নাম থেকেই গেমের ভয়াবহতা আঁচ করা যায় । এই খেলায় একবার পা দিলে মৃত্যু অনিবার্য।
‘ব্লু হোয়েল’ গেম ৫০ টি লেভেলে বিভক্ত। ২০১৩ সালে F57 নামক রাশিয়ান হ্যাকার টিম গেমটি তৈরি করে। ২০১৫ সালে VK.com নামক সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল জনপ্রিয়তা পায় এবং প্রচুর ডাউনলোড হয় গেমটি।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হওয়া রাশিয়ান হ্যাকার মনোবিজ্ঞানের ছাত্র ফিলিপ বুদেকিন গেমটি নির্মাণ করে। রাশিয়ান আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর সে জানায়, ‘হতাশাগ্রস্তদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্যই গেমটি বানিয়েছে। হতাশাগ্রস্তদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।’
রাশিয়ায় এ গেম খেলে মৃতের সংখ্যা ১৫১। রাশিয়ার বাইরে মারা গেছে প্রায় ৫০ জন। জুলিয়া ওভা ও ভের্নিকা ওভা নামক দুই বোন প্রথম এই খেলার শিকার। গেমটির ৫০তম লেভেলে গিয়ে ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছিল দুইবোন। তারা মৃত্যুর আগে সোশাল নেটওয়ার্কে নীল তিমির ছবি আপলোড দিয়ে লিখেছিলো – ‘The end!’
ব্লু হোয়েল মূলত একটি ডার্ক ওয়েভের (dark wave) গেম। ডার্ক ওয়েভ হলো ইন্টারনেটের অন্ধকার জগত। এজন্য গেমটি একবার ডাউনলোড করলে আর কখনোই আনইন্সটল করা না। ইউজারের ফোনের সিস্টেমে ঢুকে আই পি এড্রেস, মেইলের পাসওয়ার্ড, ফেসবুক পাসওয়ার্ড কন্ট্রাক্টলিস্ট, গ্যালারির ফটো এমনকি ইউজারের ব্যাংক ইনফর্মেশন ও লোকেশন তারা জেনে নেয়।
‘ব্লু হোয়েল’ গেম ওপেন করা মাত্র ইউজারকে একজন এডমিন পরিচালনা শুরু করে। শুরুতে বলা হয় – ‘গেমটি খেলা শুরু করলে আপনি কোনভাবেই এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন না, যার সর্বশেষে মৃত্যু।’
শুরুতে মজার মজার সব টাস্ক দিয়ে ধীরে ধীরে ইউজারকে নিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। তার আগে ব্লেড দিয়ে হাত কেটে নীল তিমি আঁকতে বলা হয়।
বলা হয় মাঝরাতে ভূতের ছবি দেখতে, বাবার পকেট চুরি করতে, নগ্ন হয়ে ছবি দিতে, প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে মিলিত হয়ে সেটা গোপনে ভিডিও করে পাঠাতেও বলা হয়ে থাকে অ্যাডমিনদের পক্ষ থেকে।
এসব তথ্য হাত করে ফেললে শুরু হয় ব্ল্যাক মেইলিং। ক্ষতিকর সব কাজ করিয়ে নেওয়া হয় চাপ দিয়ে। যার শেষ ধাপে অপেক্ষা করে মৃত্যু।
নীল, বিষাক্ত এই মরণ খেলা থেকে বাঁচার দুটি উপায় আছে বলে আমার মনে হয়েছে।
প্রথম ও সবচে কার্যকরী উপায় সবাই যা বলবে, আমিও তাই বলবো। বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। সে কী করছে না করছে খেয়াল রাখতে হবে। তার আনন্দ, বিস্বাদের সঙ্গী হতে হবে। সন্তানের বন্ধুদের বিষয়েও খোঁজ খবর রাখতে হবে। তাকে একা ও ভালোবাসাহীন ভাবার সুযোগ দেওয়া যাবে না। দূরে রাখতে হবে যাবতীয় হতাশা থেকে।
দ্বিতীয় উপায়টা একটু জটিল। কাজটাও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে কাজটা করতে হবে। ছিপ ফেলে মাছ ধরার পদ্ধতিতে সাবধানে আগাতে হবে।
এর জন্য প্রথমে ব্লু হোয়েল গেমের আসল লিংক যেন বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ব্লু হোয়েল গেমের মতো আরেকটা গেম নির্মাণ করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে কেউ ব্লু হোয়েল গেম খুঁজতে গেলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৈরি করা ক্লোন গেমের লিংক সাপ্লাই দেওয়া হবে। যেই গেমের অ্যাডমিন হিসেবে থাকবে আইনের লোক। তারা আসল গেমের আদলে ব্যবহারকারীদের শুরুতে মজাদার ও সহজ সব কাজ দেবে। এগুলো সাবমিট করলে এক পর্যায়ে কঠিন কাজ যেমন হাত কেটে নীল তিমি আঁকার মতো কাজ দেওয়া হবে।
এই ধাপ অতিক্রম করলে বুঝতে হবে সে আসলেই গেমের ব্যাপারে সিরিয়াস। এবং এই ইউজার যদি আসল গেম খেলে সত্যিই সে ভয়ানক সব কাজ করে ফেলবে।
তখন অ্যাডমিনের পক্ষ থেকে এমন একটা কাজ দিতে হবে যাতে গেম ইউজারের পরিবারের তথ্য অ্যাডমিন তথা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে চলে আসে। পরিবারের তথ্য পেয়ে গেলেই পুলিশের পক্ষ থেকে সন্তানের বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। সন্তানের গতিবিধির বিষয়ে অবহিত করে সন্তানকে কাউন্সিলিং করার পরামর্শ দিবে পুলিশ। বাবা-মা কী পদক্ষেপ নিলেন সে বিষয়েও ফলো আপ রাখবে পুলিশ।
তাহলেই বাংলাদেশ থেকে কেউ পা বাড়াতে পারবে না এই সর্বনাশা পথে। এ বিষয়ে সরকারকে সাহায্য করতে পারে বাংলাদেশের আইটিতে কাজ করা তরুণ গেমার ও পোগ্রামাররা।
গত পাঁচ অক্টোবর হলিক্রসের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণা আত্মহত্যা করেছে। স্বর্ণার বাবার দাবি, সে ব্লু হোয়েল গেমের শিকার। ঘটনার সত্যতা যাচাই করছে পুলিশ। সত্য মিথ্যা যাই হোক, নীল তিমির ভয়াল থাবায় আমরা কোন স্বর্ণাকে হারাতে চাই না। আমরা চাই স্বর্ণাদের সোনা ঝরা হাসি। যেই হাসিতে তাল মেলাবে স্বর্ণার পরিবার, পুরো দেশ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)