ইতিহাসের খলনায়ক তিনি। বাংলাদেশের ‘মীর জাফর’ হিসেবে কুখ্যাতি আছে তার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে নৃশংস হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে নাম, তিনি খন্দকার মোশতাক আহমেদ। অথচ বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন তিনি, ছিলেন অতি ভক্ত! মুখোশ পরা অতি বিনয়ী এই মানুষটির স্বরূপ উন্মোচন হবে এবার সিনেমায়!
বলছি বহুল আলোচিত বাংলাদেশ-ভারত এর যৌথ প্রযোজনায় নির্মিতব্য ছবি ‘বঙ্গবন্ধু’র কথা। যা নির্মাণ করতে যাচ্ছেন উপমহাদেশের বিখ্যাত নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল। বঙ্গবন্ধুকে পোট্রেট করলেও এই চলচ্চিত্রে দেখা যাবে ইতিহাসের বাঘা বাঘা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ও! একে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী থেকে শুরু করে মাওলানা ভাসানী হয়ে তাজউদ্দিন-নজরুল ইসলামরা। যেখানে চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আছেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। আর এই চরিত্রটি পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে বাংলাদেশ থেকে শ্যাম বেনেগাল মনোনীত করেছেন ভার্সেটাইল অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবুকে!
বহু জল্পনা-কল্পনার পর সম্প্রতি ‘বঙ্গবন্ধু’ চলচ্চিত্রে বাংলাদেশ অংশ থেকে কারা থাকবেন তার সম্ভাব্য ৫০ জন অভিনেতার নাম প্রকাশ পেয়েছে। যেখানে খন্দকার মোশতাক হিসেবে দেখা গেছে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ খ্যাত এই অভিনেতার নাম!
বঙ্গবন্ধু বালি হাঁসের মাংস পছন্দ করতেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় মোশতাকের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে এসেছিলো রান্না করা হাঁসের মাংস! এমন নিবিড় সম্পর্ক যার সাথে সেই মোশতাকই ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এমন ঠাণ্ডা মাথার একজন বিশ্বাসঘাতকের চরিত্রে অভিনয় করা ‘চাট্টিখানি কথা নয়’-এই চরিত্রে অভিনয় সুযোগ পাওয়ার পর নিজের অনুভূতি এভাবেই জানালেন অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু।
মোশতাকের চরিত্রে অভিনয় করাটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন ‘বৃত্তের বাইরে’র এই অভিনেতা। প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে বললেন, প্রত্যেকটা চরিত্রে অভিনয়ের জন্যই তো আলাদা করে প্রস্তুতির প্রয়োজন। সে ধরনের একটা কমন প্রস্তুতি তো মানসিকভাবে রয়েছেই। তবে বঙ্গবন্ধু চলচ্চিত্রে আমার যে চরিত্রটি এটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং, আমার জন্য তো বটেই। এই চলচ্চিত্রের বেশিরভাগ চরিত্রই পজিটিভ। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে যারা তার সহকর্মী ছিলেন, রাজনৈতিক নেতা প্রায় সবাই খুব পজিটিভ। লড়াই সংগ্রামে যারা পাশে থাকতেন সবাই কিন্তু পজিটিভ চরিত্র, শুধুমাত্র আমি যে চরিত্র প্লে করছি এটিই পুরোপুরি বিপরীত মেরুর। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থেকেও পুরোপুরি বিপরীত একটি চরিত্র।
ইতিহাস ঘেঁটে মোশতাকের মনস্তত্ব বোঝার চেষ্টায় লিপ্ত আছেন বাবু। জানালেন, স্ক্রিপ্ট যেহেতু হাতে পাইনি ফলে এখনো আমার জানা নেই যে এই চরিত্রটি কীভাবে বিন্যাস করা হয়েছে। কিন্তু তাকে মোশতাককে তো আমরা চিনি, বাঙালি তাকে চেনে, এই জাতি তাকে চেনে। একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে সবাই এই চরিত্রটিকে জানেন। ফলে সেটাই আসলে এখন বোঝার চেষ্টা করছি যে, ওই মানুষটার ভেতরের মনস্তত্ত্ব কেমন ছিলো! একজন বিট্রেয়ার কী ধরনের আচরণ করে, কীভাবে চলে, কীভাবে সুদুরপ্রসারি কল্পনা করে, এসব জানার চেষ্টা করছি এবং তা রপ্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এর আগে কি কেউ জানতো মোশতাক এরকম একটি কাজ করবে? যে লোকটি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগের দিন হাঁসের মাংস রান্না করে খাইয়ে গেছে!
‘বঙ্গবন্ধু’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে দুটি বিশেষ অনুভূতি কাজ করছে ‘আহা!’র সুলেমানের। বাবু বলেন, দুটো দারুণ অনুভূতি কাজ করছে বঙ্গবন্ধু চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে। প্রথমত- এটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কে নিয়ে সিনেমা। এই ছবিতে যেকোনোভাবে আমার অংশগ্রহণটা একজন অভিনেতা হিসেবে একটা বড় পাওয়া বলে আমি মনে করি। এটা বুক ফুলিয়ে বলার মত, যে আমি বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক অভিনয় করছি! আমার জন্য এটা বড় প্রাপ্তি। দ্বিতীয়ত- এটি নির্মাণ করছেন শ্যাম বেনেগাল! উপমহাদেশের তথা সারা পৃথিবীর জন্যই উনি একজন অন্যতম চলচ্চিত্র নির্মাতা। তার সাথে কাজ করার একটা সুযোগ এটা নিঃসন্দেহে একজন অভিনেতা হিসেবে আমার জন্য অত্যন্ত গর্বের।
অডিশন পর্বের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের তুখোড় এই অভিনেতা জানান, অডিশনে যখন প্রথম দিন, তখন কিন্তু শ্যাম বেনেগাল ছিলেন না। তার সাথে আমার দেখা হয়নি। অডিশন বোর্ডে অনেকেই ছিলেন, বাংলাদেশ থেকে বাহাউদ্দিন খেলন, একজন সচিব ছিলেন, সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকেই ছিলেন। তারা অফ দ্য রেকর্ড আমাকে বললেন, ‘আসলে আপনার অডিশন কী নেব! আপনার অভিনয় সম্পর্কে তো আমরা জানি! আসলে আমরা দেখছি কার সাথে কার ম্যাচ করে!’-ধরুন আমার হাইট হচ্ছে ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি, এখন ৬ ফুট ২ ইঞ্চি চরিত্রের জন্য যদি আমি অডিশন দেই তাহলে কী হলো! আমাদের হাইট, চেহারা (লুক অ্যা লাইক), মানে কার সঙ্গে কার চেহারাটা যায়-এসব দেখতেই তারা অডিশন নিয়েছেন!
কথায় কথায় শ্যাম বেনেগালের সাথে প্রথম সাক্ষাতের কথাও জানালেন বাবু। বললেন, প্রাথমিক সিলেকশনের পর শ্যাম বেনেগালের সাথে সাক্ষাৎ হয়। প্রথম দেখাতেই তিনি আমাকে বললেন, ‘ঠিক আছে, গুড।’ এরপর আমার চেহারার সাথে মোশতাকের ছবি মেলালেন! তো আমার সম্পর্কে সেখানে যে সচিব সাহেব ছিলেন, তিনিও শ্যাম বেনেগালকে বললেন-আমি কী ধরনের কাজ করি, কেমন কাজ করি। একজনতো বললেন ই, ‘উনি শুধু অভিনেতা নন, উনি গান করেন’। এটা শুনে শ্যাম বেনেগাল আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলেন। বললেন ‘বাহ, বেশ ভালো তো!’ পরে আমি তাকে দুই লাইন গানও শুনিয়ে দিয়েছি। ‘মনপুরা’ ছবির ওই ‘সোনাই হায় হায় রে’ গানটা গেয়েছি।
চলতি মাসেই ‘বঙ্গবন্ধু’ চলচ্চিত্রটির মহরত অনুষ্ঠিত হবে। শোনা যাচ্ছে, ১৮ মার্চ থেকে শুরু হবে ছবির শুটিং। বাবু বললেন, প্রথমে বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলার শুটিং হবে শুনেছি। লোকেশন টুঙ্গীপাড়া। ফলে এখানে আমার কোনো উপস্থিতি নেই। হয়তো পরের মাস থেকে আমার শুটিং। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।