জীবনের প্রতিটা দিনেই আমাদের হাঁটতে হয় প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে। ঘুম থেকে উঠে ঘরের মেঝেতে পা ফেলার মাধ্যমে শুরু হয় এই হাঁটা। তবে সেই হাঁটার হয়তো সুনির্দিষ্ট কোন উদ্দেশ্য থাকে না, হয়তো উপলব্ধিও করা হয় না তেমনভাবে। যেমনটা হয় অভিযাত্রীদের ক্ষেত্রে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একদল অভিযাত্রী দেশমাতার মুক্তির লক্ষ্যে ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ’ পদযাত্রায় হেঁটে অসামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদায় ও গণহত্যা বন্ধে জনমত সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ৩৮ জনের একটি দল ১৯৭১ সালে বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা করেছিল।
সেই পদযাত্রা ছিল ১৯৭১ এর ১৫ অক্টোবর থেকে বিজয়ের পরদিন ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তারা মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে বেছে নিয়েছিলেন এমন প্রতিবাদের ভাষা। তারা বিশ্বকে জানিয়েছিলেন নতুন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের প্রবল আকুতি। বিভিন্ন দূতাবাসে স্মারকলিপি প্রদান করেছিলেন বাঙালির প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে।
পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক গণহত্যা ও হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা তুলে ধরে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তুলে ধরেছেন তারা ভারতের পথে ঘুরে ঘুরে। প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ১৬ মাইল পাঁয়ে হেঁটে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যেতেন। বিকেলের দিকে স্থানীয়ভাবে আয়োজন করা হতো জনসভার। দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের সাথে সে সময় হতো মতবিনিময়।
এভাবে দলটি মুর্শিদাবাদ, সেইনথিয়া, সুরি, শান্তি নিকেতন, ককশা, দুর্গাপুর, রাণিগঞ্জ, আসানশোল, নিয়ামতপুর, কুলটি, বিহার, পাটনা, লাখনৌ, আগ্রাসহ বিভিন্ন জায়গায় পদযাত্রা করে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরির কাজ করে গেছেন।
২৬ শে মার্চ, স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের লক্ষ্যে বর্তমান প্রজন্মের আরেক দল ‘অভিযাত্রী’ গত পাঁচ বছর ধরে ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ’ পদযাত্রার সেই অসামান্য দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ’৫২ থেকে ’৭১-এর সেই অগ্নিঝরা সময়টাকে স্মরণ করার জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত পদযাত্রা করে আসছে।
শোক থেকে শক্তি: অদম্য পদযাত্রা নামের এই ইভেন্টটিতে প্রথম বছর মাত্র আট জন পদযাত্রী অংশ নিয়েছিলেন। তারা হেঁটেছিলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে। এরপর থেকে প্রতি বছর অদম্য এই পদযাত্রায় পদযাত্রীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
তবে ২০১৬ সাল হতে এই পায়ে হাঁটা কর্মসূচীতে যুক্ত হয়েছে এক নবতর মাত্রা। গত দুইবারে পদযাত্রাটি নিবেদিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। সকলের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নিজ কাঠামোয় দাঁড়িয়ে গেলেও জাদুঘরের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য আরও সহায়তা প্রয়োজন। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও এই পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বিকাশের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে।
অভিযাত্রী জানায়, ‘একুশ মাইল দীর্ঘ এই পদযাত্রায় সবাই হয়তো পুরো পথটা হাঁটতে পারবেন না, তবে চাইলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী যে কেউ হাঁটতে পারেন এক মাইল পথ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ব্যানারসহ শিক্ষার্থীরাও পদযাত্রায় অংশ নিতে পারবেন। যার যার সাধ্য অনুযায়ী অনুদান প্রদান করে ন্যুনতম এক মাইল হেঁটে হতে পারে ইতিহাসের অংশীদার।’
এ বছরও স্বাধীনতা দিবসের সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হবে এই পদযাত্রা। এরপর জগন্নাথ হল-সিটি কলেজ-জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড-মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজ হয়ে-রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে মিরপুর মাজার রোড ধরে মিরপুরের বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ থেকে পদযাত্রীরা পৌঁছে যাবেন দিয়াবাড়ি ঘাট। ঘাট থেকে নৌকা বা ট্রলারে করে তুরাগ নদী পার হয়ে যাবেন সাদুল্লাপুর বটতলা। বটতলা থেকে আকরাইন স্কুলে যাবেন পদযাত্রা।
এ সময় ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না’ গানের সুরে সুরে পদযাত্রীরা হেঁটে চলবেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে গোকুলনগর গ্রামের মেঠো পথ ধরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। সূর্যাস্তের সময় স্মৃতিসৌধের গায়ে দিনের শেষ আলো পড়ার মুহূর্তে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণে হাঁটু গেড়ে বসে অনেক কান্না, শ্রদ্ধা ও নীরবতার পর উচ্চারিত হবে তারুণ্যের দৃপ্ত শপথ।
অভিযাত্রী জানায়, এ বছর শোক থেকে শক্তি: অদম্য পদযাত্রা ছড়িয়ে যাচ্ছে ঢাকার বাইরে। বাংলাদেশের প্রথম সরকারের রাজধানী ছিল মুজিবনগর। ঐতিহাসিক এই স্থানের বাসিন্দারা এইবারের পদযাত্রায় যুক্ত হতে যাচ্ছেন। ঢাকার আদলে মেহেরপুরেও এই পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।
এ বিষয়ে অভিযাত্রীর একজন সদস্য বলেন, ‘‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিলো আমাদের অধিকার আদায়ের লড়াই যা পরবর্তীতে ধাপে ধাপে স্বাধীকার আন্দোলনে রূপ নিয়ে ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পায় চূড়ান্ত পরিণতি । এই দীর্ঘ সময়ের পথটিতে অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পাই স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ।’
তবে প্রতি বছর যে শুধু স্বাধীনতা দিবসকে সামনে রেখেই অভিযাত্রী পদযাত্রা করে বিষয়টা তেমন নয়। তারণ্যের দৃপ্ত শক্তিকে ধারণ করে প্রায় প্রতি মাসেই সংগঠনটি ঢাকার আশেপাশে কিংবা ঢাকার বাইরে এরকম পদযাত্রা করে আসছে। কোন কোন সময় দল নিয়ে ছুটে যায় সবুজ কোন গ্রামে, নদীর ধারে। কখনো বা ধানক্ষেতের আল ধরে হেঁটে যায় ঐতিহ্যবাহী কোন জায়গায়। আবার কখনো বা ছুটে যায় পাহাড়ে, সমুদ্রে। আর অভিযাত্রীর নিবন্ধিত সদস্যরাই যে শুধু এইসব পদযাত্রা বা ট্রেকিংএ অংশ নেয় তা নয়, আত্মবিশ্বাসী এবং বন্ধুভাবাপন্ন যে কেউ যোগ দিতে পারেন অভিযাত্রীর সাথে।
২৬ মার্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শোক থেকে শক্তি নামের এই অদম্য পদযাত্রা হবে একাত্তরের উত্তাল সেই সময়গুলোকে উপলব্ধির জন্য। প্রথম অতিথি কবিতায় কবি নির্মলেন্দু গুন লিখেছেন-
“নদীর জলের সঙ্গে মানুষের রক্ত মিশে আছে
হিজল গাছের ছায়া বিপ্লবের সমান বয়সী
রপসী নারীর চুল ফুল নয়, গুচ্ছ গুচ্ছ শোকের প্রতীক
বাংলাদেশ আজ শুধু বাংলাদেশ নয়
এরকম বাংলাদেশ কখনো দেখোনি তুমি, কখনো দেখেনি কেউ।”
১৯৭১ এর সেই না দেখা বাংলাদেশকে উপলব্ধির জন্য অদম্য পদযাত্রা যাবে ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে সেই বিপ্লবের সমান বয়সী হিজল গাছের তল দিয়ে। হয়তো বা সেই হিজলের ছায়ায় অভিযাত্রীরা খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিতে পারেন। একাত্তরে মুক্তিকামী বাঙালিদের যে আত্মত্যাগ, সেই আত্মত্যাগকে উপলব্ধির জন্যই মূলত এই পদযাত্রা।
পদযাত্রার মাধ্যমে এ প্রজন্মের পদযাত্রীরা ফিরে যাবেন একাত্তরের সেই দিনগুলোতে। তাই, পায়ে হেঁটে এই পথটুকু অতিক্রমের বিষয়টি প্রতিযোগিতার নয় – বরং অনুভবের, শ্রদ্ধার, ভালবাসার। বায়ান্ন, ঊনসত্তর পেরিয়ে একাত্তরে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি তা অনুভবের মাধ্যমে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানিয়ে গ্রহণ করবে সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণের শপথ।
পদযাত্রার ইভেন্ট লিংক: https://www.facebook.com/events/222641858297735/