শাহাদুজ্জামানের ‘খাকি চত্বরের খোয়ারি’ পড়ে আশ্চর্য এক গদ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। গদ্যের জমিতে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলার মতো থোকায় থোকায় উপমা জ্বলছে বইজুড়ে।
লেখক মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের খাকি চত্বরে কৈশোরের বন্দী হয়ে যাওয়া সময়কে গেঁথেছেন নিদারুণ দুঃখবোধে। প্রতিটি শব্দের গোড়ায় গোড়ায় দীর্ঘশ্বাস। বইয়ের নামের মধ্যে বন্দীদশা লক্ষ্যনীয়। গ্রামে দলছুট গবাদী পশুকে আটকে রাখা হয় ‘খোয়ার’-এ।
‘খাকি চত্বরের খোয়ারি’কে উপন্যাস কিংবা কিশোর উপন্যাস বলা যায়। আত্মজীবনী বলা যায়। আবার ছোট গল্পও বলা যায়। অথবা খাকি চত্বরের খোয়ারি ভিন্ন কিছু, যার সাথে আমার বা আমাদের পরিচয় নেই।
বইটিকে উপন্যাস বলা যায় এই কারণে যে- একঝাঁক কিশোরের ক্লাস সেভেন থেকে এইসএসসি, দীর্ঘ ক্যাডেট জীবনের নানা ঘটনা চিত্র-বিচিত্র চিন্তা ভাবনা, দর্শন, কর্ম উঠে এসেছে। নিয়মের ঘোরটোপে বন্দী থেকে নিয়ম ভাঙ্গার অদম্য গল্প উঠে এসেছে। একঝাঁক চঞ্চল, দুরন্ত, ঝিমন্ত, চুপচাপ, ভাবুক, শহুরে, গ্রাম্যসহ নানা স্বভাবের ছেলেরা নানা জায়গা থেকে ক্রিম অব দ্যা সোসাইটি হবার লক্ষ্যে ভর্তি হয় মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে।
নানা ঘাত প্রতিঘাত ও ট্রেনিংয়ের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠলে সমাজের নেতা হওয়ার জন্য ক্লাস সেভেনের ছেলেগুলো তখন ‘মোক্ষম কাঁচামাল’। ঘটনা বা দুর্ঘটনাক্রমে মোক্ষম কাঁচামালের ভেতর পড়ে যান লেখক শাহাদুজ্জামান। যার কি না পেঁচার চোখ দিয়ে চারপাশ দেখার অভ্যাস।
এখানে এসেই জমা হয় খাকি মেঘ নামে পরিচয় দেওয়া মিলন। যার হওয়ার কথা ছিল জীবনানন্দ দাশ। যার হওয়ার কথা ছিল অশত্থ গাছ কিংবা শরতের মেঘ। খাতি চত্বরে জমা হয় মিলন, রুমি, ইফতি, সোবাহান, রাজীবরা। এক ঝাঁক কিশোর কঠোর শৃঙ্খলা ও শৃঙ্খল ভাঙ্গার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। জীবনের বড় অংশ এই কিশোরবেলাকে কিশোর উপন্যাস বললে দ্বিমত করার সুযোগ কম।
একইভাবে মিলন, রুমি, ইফতিরা যাকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে তিনি স্বয়ং লেখক শাহাদুজ্জামান। লেখকের জীবনের সঙ্গে জড়ানোর সুযোগেই তারা হয়ে উঠেছেন একেকটা চরিত্র। লেখক যা দেখেছেন, যা জেনেছেন, যা ভেবেছেন তাই লিখেছেন। ফলে ‘খাকি চত্বরের খোয়ারি’কে সচেতনভাবে লেখকের আত্মজীবনীও বলা যায় ।
প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে ছোট গল্প বলা কোন সাহসে? এখানেই মূলত চিন্তার কেন্দ্র। শাহাদুজ্জামানের খেলা। জীবনের বৃহৎ ও অবৃহৎ ঘটনাগুলোকে লেখক অত্যন্ত সরলভাবে বেঁধেছেন মাত্র দেড় থেকে দুই পৃষ্ঠায়। প্রতিটি ঘটনার শেষের রেশ টেনে শুরু করেছেন আরেকটি ঘটনা। আগের ঘটনার শেষ লাইনে একটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন। সেই প্রশ্নই পরের ঘটনার শিরোনাম। প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে চলে গেছেন গল্পে। সবেমাত্র হাহাকার জাগত শুরু করেছ, সেই সময়ই লেখক সুকৌশলে পাঠককে টেনে নিয়েছেন পরের ঘটনায়। পরের গল্পে। ফলে ‘খাকি চত্বরের খোয়ারি’ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ছোট গল্প।
ক্যাডেট কলেজের খাকি চত্বরে লেখকের সঙ্গে পরিচয় হয় অবিরাম কবিতার চাদর পরা একজন জীবনানন্দ দাশের। তার নাম মিলন। লেখকের নিঃসঙ্গতার সঙ্গী। যে সবার মাঝে অবস্থান করেও বিরাজ করে অন্য কোথাও। একাকীত্বের কুয়াশায় মিলনের বসবাস। প্রতিদিন বিকাল পাঁচটা ত্রিশ মিনিটে বিউগল বাজিয়ে পতাকা উড়ে। পতাকার উপর দিয়ে উড়ে যায় এক ঝাঁক পাখি। মিলনও উড়তে শুরু করে পাখিদের সাথে। কারণ মিলন যে খাকি পরা মেঘ। সে সবার মাঝে থেকেও কোথাও নেই।
এক সময় কথা রটে যায় মিলন আসলে মানুষ না। জ্বিন। জ্বিন মানুষ সেজে পড়তে এসেছে খুদে খাকিদের সাথে। মিলনকে ঘিরে জন্ম হতে থাকে নানা গল্প।
ক্যাডেটের নিয়ম নীতি আর দুরন্তপনার মধ্যে বড় হয় সবাই। একদিন খাকি চত্বরের নির্ধারিত সময় শেষ করে বেজে উঠে বিদায়ী বিউগল। কিন্তু বিদায়ী ছবিতে জায়গা হয় না মিলনের। কেন হয় না সেটা লেখার ক্ষমতা আমার নেই। আপনাদের সুযোগ হলে শাহাদুজ্জামানের কাছ থেকে জেনে নেবেন। ‘খাকি চত্বরের খোয়ারি’ পড়েও জানতে পারবেন। আমার বিশ্বাস মিলন কেন বিদায়ী ছবিতে নেই তা জানার পর আপনারাও কাউকে কোনোদিন বলতে পারবেন না। বলবেন কী করে, পাথর শুধু দেখে, বলতে পারে না। বইয়ের তের শব্দের একটা বাক্য আপনাকে পাথর বানিয়ে দেবে।
বই: খাকি চত্বরের খোয়ারি
লেখক: শাহাদুজ্জামান
প্রকাশনী: বেঙ্গল পাবলিকেশন্স
পৃষ্ঠা: ১১২
মূল্য: ২২০টাকা
প্রকাশকাল: ২০১৩