একটা সময় ছিল যখন পড়াটা ছিল বড় ধরনের একটা নেশা। বই থেকে শুরু করে বাদাম বা মুড়ির ঠোঙ্গা যাই হোক না কেন, পড়ে ফেলতাম। ছাপার অক্ষরে যা কিছু সামনে পড়তো সবই পড়তাম। এ কারণে আশেপাশের সবার কাছে অনেক কথা শুনতে হতো। মনে পড়ে একদিন সমরেশ মজুমদারের উত্তরাধিকার পড়তে বসে বইয়ের পাতায় এতটাই ডুবে গেলাম যে চুলায় বসানো ভাত পুড়ে কয়লা। এটা বোধ হয় ১৯৯৩ সালের কথা। আর ৯৪ থেকে ৯৯ পর্যন্ত টানা চট্টগ্রামের বিভিন্ন গার্মেন্টেস কারাখানায় চাকরির সময়ও সুযোগ পেলেই পড়েছি আর পড়েছি।
১৯৯৬ সালের কথা। আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনে দিনের বেলায় সব গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ থাকতো, রাতে কাজ চলতো। ওই রকম সময়ে কাজের ফাঁকে এক কলিগের সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ তার মুখে একটা কথা শুনে আমি বললাম, ‘বাহ্ আপনিতো দেখি সুনীলও পড়েন’।
কথাটা ছিল আসলে সুনীলের কোনো একটা উপন্যাসের একটা লাইন। সে হেসে বললো, আপনিও তো নিশ্চিত পড়েন এসব। না হয় বুঝলেন কিভাবে। তারপর প্রতিদিন আমরা বই নিয়ে আলোচনা করতাম। ছেলেটার নাম সম্ভবত জাকারিয়া ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তার কাছে কোন কোন লেখকের বই আছে। সে হুমায়ুনের ভক্ত, সাথে কাসেম বিন আবু বাকারসহ সব লেখকের বই পড়ত। আমি তাকে সাফ বলে দিলাম, ভাই হুমায়ুন আর বাকার ছাড়া সব লেখকের বই দিও। যত পারো শরৎ দিও, সাথে আহমদ ছফা। প্রতিটা শরৎ এর জন্যে কাজীর দেউড়ি নিয়ে একটা করে কফি খাওয়াবো। শরৎচন্দ্র তখন আমার সবচে প্রিয় লেখক ছিল। জাকারিয়া প্রশ্ন করলো, ওই দুই লেখকের (হুমায়ুন আর বাকার) বই নয় কেন?
সেদিন আমার জবাবটা ছিল এরকম: আমার বয়স যখন বিশের নীচে ছিল তখন হুমায়ুন পড়েছি। সেটা ছিল মানানসই। এখন আমার বাস্তবতা ভিন্ন, আমি একটা গার্মেন্টস কারখানার ফ্লোরে দাঁড়িয়ে কাজ করছি। বয়স বিশ পার করার পর থেকে আমার জীবনের প্রতিটা দিন এক একটা পোকামাকড়ের ঘরবসতি। এই বাস্তবতায় হিমুর মতো খালি পায়ে হাঁটা একটা বোহেমিয়ান স্বভাবের অথর্বের হাতের নীলপদ্ম আমাকে মোটেও আকৃষ্ট করে না।
ভালোবেসে বটতলায় সংসার পাতানোর ফিলসফিতেও আমি নেই। স্যরি। আর বাকারের লেখা শুধুই কার্বোহাইড্রেটে ভরা, আয়োডিন, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, জিংক কিছুই নেই। সুতরাং এই বয়সে অতিমাত্রায় কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করে মস্তিষ্কের স্থূলতায় ভুগতে চাই না। তার মানে এই নয় যে, উনি খারাপ লিখেন। এরপর কেটে গেছে ২১ বছর। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় কাসেম বিন আবুবাকারকে নিয়ে ১০ নম্বর সিগন্যালের যে সাইক্লোন বয়ে যাচ্ছে তাতে আর নিরব থাকতে পারলাম না।
১৯৯১ পরবর্তী সময়টায় কিনে ভালো বই পড়া বা কিনে খবরের কাগজ পড়ার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। তবে বিআরডিবি’র সাথে যুক্ত থাকার কারণে আমাকে প্রায়ই উপজেলা সদরে যেতে হতো। সেখানে সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে আমার ভালো যোগাযোগ ছিল। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমি তাদের কাছ থেকে ধার করে বই পড়তাম। সাতকাহন, পূর্ব-পশ্চিম, দুর্গেশনন্দিনী, পোকা মাকড়ের ঘরবসতি, তসলিমার লজ্জাসহ আরো অনেক বই আমি ধার করেই পড়েছি।
সে সময় যেহেতু গ্রামে ছিলাম তাই ভালো লেখকের বই পাওয়া মুশকিল ছিল বলতে হয়। তাই যা পেতাম তাই পড়তাম। ওই সময়ই আমি ‘কাসেম বিন আবুবাকার’ এর তিনটি বই পড়েছি। তার মধ্যে একটা ‘ফুটন্ত গোলাপ’। তিনটি বইয়ে এমন কোন খারাপ কিছু দেখিনি যা এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ঢাকায় আসার আগে পর্যন্ত আমি ‘কাসেম বিন আবুবাকার’ এর যে পাঠক সংখ্যা দেখেছি তা হুমায়ুন আহমেদের চেয়ে কোন অংশে কম না। এখন কেউ যদি প্রশ্ন করে যে তাহলে এতদিন তার নাম জানলাম না কেন?
সেক্ষেত্রে আমার জবাব, হুমায়ুনের নাম জানা সহজ ছিল। কারণ বিটিভি থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সবক’টি মিডিয়া তার দখলে ছিল বলে তাকে জানতে পেরেছে মায়ের পেটের ভ্রুণও। আর কাসেম বিন আবু বাকার এর কোন প্রচারমূলক কিছু কখনো দেখিনি। লেখাই উনাকে নিয়ে গেছে পাঠকের কাছে, পত্রিকার বিজ্ঞাপনে নয়। কোন ভাড়াটিয়া সাহিত্যবিশারদের আলোচনারও আশ্রয় নেননি কখনো।
আর আপনারা যারা ভালো সাহিত্য-খারাপ সাহিত্য বলে গলা ফাটাচ্ছেন তাদের বলছি, কে কী পড়বে বিশাল এই পাঠক গোষ্ঠিকে তা ঠিক করে দেয়ার আপনি বা আপনারা কে? আপনাদের তথাকথিত বিরিয়ানি ক্যাটাগরির সাহিত্যে যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায়, রাসুল (সাঃ) এর চরিত্র হনন করা যায় বা গল্পের চরিত্রকে মিনি স্কার্ট-অফশোল্ডার মিনিফ্রক পরানো যায় তাহলে অন্য কেউ কেন সাহিত্যে ধর্মীয় আচার-আচরণের কথা আনতে পারবে না কিংবা বোরকা পরাতে পারবে না?
এদেশের ১৬ কোটি নাগরিক কী আপনাদের কাছ থেকে সাজেশন নিয়ে বই পড়বে? নাকি আপনারা হিংসা আর ব্যর্থতার আগুনে পুড়ে ছটফট করছেন? এটা কী তাহলে যন্ত্রণার চিৎকার? আমার ধারণা গত এক সপ্তাহ ধরে তারাই চিৎকার করছেন যারা বইমেলায় পকেটের পয়সা খরচ করে বই বের করে ফতুর হয়েছেন। একশ কপির বেশী কেউ ছাপার সাহস পাননি। উচ্চমানের সাহিত্যের নামে যদি আপনারা নাস্তিক্যবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে চান, তাহলে অন্য কেউ কেন আস্তিক্যবাদ নিয়ে লিখতে পারবে না?
সমালোচকদের উদ্দেশ্যে বলছি, পাঠক কার লেখা পড়বে সেটা তাকে বেছে নিতে দিন। না হলে আপনাদের সাহিত্য পড়তেও বাধা আসবে অপরপক্ষ থেকে। আজ যারা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ভাষায় কাসেম বিন আবুবাকারকে নিয়ে বলছেন তার কিছুটা আমার গায়েও পড়ছে। কারণ আমিও কোন এক সময় তার লেখা পড়েছি।
আপনাদের মতো নেতিবাচক সমালোচকদের কোন অধিকার নেই পাঠকের সাহিত্যরুচি নিয়ে প্রশ্ন তোলার। আপনাদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলছি, আপনার বা আপনাদের সাহিত্য দিয়ে এই লেখকের অর্ধেক পাঠক ধরে দেখান এক বছরে। তখন বোঝা যাবে আপনি কতটা সাহিত্যিক আর পাঠকের সাইকোলজি বুঝেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)