জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) হিসাবে প্রায় ৩১ শতাংশের বেশি বাংলাদেশি দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। খাদ্যের সংকটে রয়েছে প্রায় ৪ কোটি মানুষ। এর উপর মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। তারা চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ও অপুষ্টিতে ভুগছে বলে রিলিফওয়েবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়।
রোহিঙ্গারা সেখানে খাদ্য সংকটে ভুগলেও তাদের কারণে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রোহিঙ্গারা সেখানে খাদ্য সংকটে ভুগলেও তাদের কারণে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। বিদেশি সংস্থাগুলো তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করছে। তবে এই সংকটকে একেবারে উড়িয়েও দেয়া যাবে না বলেও মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস)সাবেক মহাপরিচালক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ সাহাব উদ্দিন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশ খুব বেশি খাদ্য সংকটে পড়বে বলে মনে হয় না। তবে একেবারে সংকটে পড়বে না তাও বলা যাবে না। কারণ ১০ থেকে ১২ লাখ রোহিঙ্গা কিন্তু সংখ্যায় কম নয়। যদিও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা তাদের খাদ্য সরবরাহ করছে, তবুও এদের খাদ্য নিশ্চিত করা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং।
দীর্ঘ মেয়াদে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অবস্থান করলে খাদ্য সংকটের চেয়ে দেশে অন্যান্য সমস্যা বেশি হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন: রোহিঙ্গারা বর্তমানে যেখানে অবস্থান করছে, সেখানে পরিবেশের ক্ষতি হবে, স্থানীয়দের সাথে তারা বিবাদ এবং বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে। এতে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হবে।
তবে রোহিঙ্গাদের কারণে খাদ্য সংকট হবে না বলে মনে করেন বিআইডিএসের ফেলো ড. এম আসাদুজ্জামান। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: বাংলাদেশে এই মূহূর্তে খাদ্য সংকট হবে বলে মনে করি না। আর রোহিঙ্গাদের বিষয়টি তেমন কিছ নয় যে তাদের কারণে খাদ্য সমস্যা হবে।
ডব্লিউএফপি’র বরাতে রিলিফওয়েবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের ৩৬ শতাংশই শারীরিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের ১৪ শতাংশই চরম অপুষ্টিতে ভুগছে।
তবে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার, শিক্ষায় লিঙ্গ বৈশম্য কমিয়ে এনেছে, টেকশই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। কিন্তু এরপরও মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ বা ৪ কোটি লোক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রযে গেছে।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কাজের বিবরন দিয়ে এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএইড) খাদ্য নিরাপত্তা অফিস (এফএফপি) কেয়ার ইন্টারন্যাশানাল, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল ও ওয়ার্ল্ড ভিশনের সাথে বহু বছর ধরে উন্নয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। অর্থাৎ কৃষিতে আগ্রহ সৃষ্টি, জীবিকা নির্বাহে, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তনে করণীয়, নারীদের শক্তিশালী করা ও প্রাকৃতিক ঝুঁকি কমাতে বিভিন্নভাবে কাজ করছে। চলতি বছরে এফএফপি এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার জন্য ৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের বেশি ডলার সহায়তা করেছে।
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে কক্সবাজারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জরুরি সহায়তা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) কাজে এফএফপিও সহায়তা করছে। এফএফপি ২০১৭ সালে ডব্লিউএফপিকে ৭০ লাখ ডলার সহায়তা দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের খাদ্য, মানবিক সহায়তাসহ সব ধরনের সহযোগিতা করার জন্য এই অর্থ দিয়েছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বহুদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চির কাছে জমা দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট।
৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
সেনাবাহিনীর ওই হামলায় এখনও পর্যন্ত প্রায় এক হাজার মানুষ মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। নৌপথে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতেও বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।
সেনাবাহিনীর হামলা ও সহিংসতার মাত্রার ভয়াবহতার কারণে জাতিসংঘ একে ‘পাঠ্যবইয়ে যোগ করার মতো জাতিগত নিধনের উদাহরণ’ বলে অভিহিত করেছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকাণ্ড শুরু করে।