রাজনৈতিক ইশতেহার প্রতিটি রাজনৈতিক সংগঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। নির্বাচন এলে প্রতিটি দল নির্বাচন উপলক্ষ্যে নিজেদের দলীয় ইশতেহার বা মেনিফেস্টো প্রকাশ করে। নির্বাচিত হলে একটি দল কী কী ধরনের কাজ করবে মূলত সেগুলোই রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে সন্নিবেশিত বা প্রতিশ্রুত থাকে। এরপর দল ক্ষমতায় গেলে সেই প্রতিশ্রুতিগুলো জনগণের স্বার্থে বা উন্নয়নে বাস্তবায়নে মনোযোগী হয়। আবার জনগণও দেখতে চায় ইশতেহারে বর্ণিত প্রুতিশ্রতি বা অঙ্গীকার গুলো ক্ষমতাসীন দল বাস্তবায়ন করছে কিনা।
একাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইশতেহার প্রস্তত করছে। এখন পর্যন্ত কোনো দলই নিজেদের ইশতেহার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি।
তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল জানিয়েছে তাদের রাজনৈতিক ইশতেহারে কোন কোন বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাচ্ছে বা কী কী থাকছে।
আমরা বরাবরই দেখছি রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে দেশের চরাঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে স্বাপ্নিক বা টেকসই কোনোকিছু অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চরের মানুষেরর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথাগুলো তাই উপেক্ষিতই থেকে যায়। আর তাই এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলই চরের মানুষের পরিকল্পনাভিত্তিক উন্নয়নে মনোযোগী হয়নি। আর এ কারণেই চরের মানুষের যে সমন্বিত বা সামগ্রিক উন্নয়ন সেটা হয়নি।
আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ বলে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। বহু নদ-নদীর সমাহার চারিদিকে। বহুবিধ কারণেই বাংলাদেশের মোট আয়তনের বড় অংশ এখন চরভূমি। বিশেষ করে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রক্ষ্মপুত্র, তিস্তা-এসব নদীগুলোতে সবচেয়ে বেশি চর দৃশ্যমান। চরের আবার নানা রকমফেরও রয়েছে। মূলভূমির সাথে যুক্ত চর, দ্বীপচর, উপকূলীয় চর, অস্থায়ী চর ইত্যাদি। সব মিলিয়ে এসব চরে প্রায় ১ কোটি মানুষের বসবাস। বাংলাদেশের মোট ভূমির প্রায় ১০ শতাংশ চরভূমি । দেশের প্রায় ৩২টি জেলার ১০০ উপজেলার অংশবিশেষ জুড়ে বিস্তৃত এই চরাঞ্চল। তীব্র নদী ভাঙ্গন, বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে চরের মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়। প্রতিবছর গড়ে ৫০ হাজার মানুষ শুধুমাত্র নদী ভাঙনের শিকার হয়ে গৃহহীন হয়ে পড়ে। ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জলবায়ু পরিবর্তন জনিত দুর্যোগ ঝুঁকির দেশে পরিণত করেছে। নদীবাহিত এদেশের চরাঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠী এই দুর্যোগের প্রথম ও প্রধান শিকার।
গত বছরের বন্যার কথাই ধরা যাক। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়ের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কোঅর্ডিনেশন সেন্টার (এনডিআরসিসি) -এর দেওয়া তথ্যমতে- গতবছরের বন্যায় ২০৫টি উপজেলার ৯ হাজার ৭ শত ৮৭টি গ্রাম ও চর বন্যাক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বন্যায় ১ লক্ষ ১১ হাজার ১৮৮ টি পরিবারর সম্পূর্ণরুপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয় ১৬ লক্ষ ২৩ হাজার ১৯৬টি পরিবার। এবারের বন্যায় সম্পূর্ণরুপে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ লক্ষ ৩ হাজার ৮৫৫টি বাড়িঘর। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৬ লক্ষ ৩৩ হাজার ৭৯২টি ঘরবাড়ি।
প্রতি বছরই চরাঞ্চলে কোনো না কোনো ধরনের দুর্যোগ হয়। বিশেষ করে বন্যা হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয় চরের মানুষকে। বন্যাকালীন সময়ে চরের মানুষের বাড়িঘর নদীবক্ষে চলে যায়। ফসলের মাঠ নষ্ট হয়ে যায়। গবাদি পশুর মৃত্যু হয়। আবার গবাদি পশুর রাখার জায়গা না থাকায় খুব কম দামে গরু-বাছুর বিক্রি করে ফেলতে হয়। এতে করে দেখা যায়, চরের মানুষকে প্রচুর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এ বছরও আমরা দেখেছি ফরিদপুরের নিকটবর্তী শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলায় বেশ কয়েকটি চরের নদীগর্ভে বিলীণ হয়ে যাওয়া। পদ্মার পানি বাড়ার সাথে সাথে ¯্রােত বাড়তে থাকলে চোখের সামনে বহু চরবাসীর জমি-জিরেত হারিয়ে নিঃস্ব-রিক্ত হয়েছে এবার। নদী ভাঙ্গনকে এখনও দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয় নি।
চরে উৎপাদিত ফসলের বিপনন ব্যবস্থায়ও রয়েছে নানা ঝামেলা। অনেক চর দুর্গম এবং চর থেকে মূল ভূখ-ে পৌঁছাতে সময়সাপেক্ষ হওয়ার কারণে চরের কৃষকরা উৎপাদিত ফসল বাজারে আনতে পারে না। এতে করে তুলনামূলক কম দামেই তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে হয়। তবে এ কথা সত্য যে, চরে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা অনেক ভালো। বিশেষ করে চরে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের সবজি যেমন- পটল, ডাটা, চাল কুমড়া, ঝিঙা, শসা, মিষ্টি কুমড়া, পুঁইশাক- এসব সবজির চাহিদা ব্যাপক। খাদ্যগুণেও এসব সবজি অন্য যে কোনো জায়গার তুলনায় ভালো। কেননা চরে উৎপাদিত বেশিরভাগ সবজিতে অর্গানিক সার ব্যবহার করা হয়। এখনও অনেকটাই প্রাকৃতিক উপায়ে বা পদ্ধতিতে চরে সবজি উৎপাদন করা হয়। চরে উৎপাদিত ফসলের নায্যমূল্য না পাওয়ার কারণে চরবাসী অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে আসছে।
একথাও সত্য যে, নদী ভাঙনের ফলে চরের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঠিক তথ্য রাখার কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত কোনো মন্ত্রণালয় থেকে গ্রহণ করা হয় নি। ফলে নদীভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত চরের মানুষের সঠিক তথ্য পাওয়া বরাবরই মুশকিল। আমরা গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে লক্ষ্য করছি যে চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে খুব পরিকল্পনা ভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি। ফলে টেকসই উন্নয়নের পথযাত্রায় চরবাসী অনেক পিছিয়ে আছে।
চরাঞ্চলে সরকারি সেবা আগের তুলনায় বাড়লেও দুর্গম চরাঞ্চলের বাসিন্দারা এখনও অনেক সেবা থেকেই বঞ্চিত। চরাঞ্চলে সেবা আরও সহজ করা এবং চরবাসীর জীবনমান উন্নয়নে কিছু অঞ্চলভিত্তিক কর্মকৌশলের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা মনে করি না যে, একই দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখে সব চরের উন্নয়ন করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন নদীভিত্তিক চরাঞ্চলগুলোকে ভাগ করে আলাদা আলাদা কর্মসূচি গ্রহণ করা। বিশেষ করে দুর্যোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে চরের মানুষের উন্নয়ন আরও টেকসই হবে। যে সব চর বেশি ভাঙ্গন ও ঝুঁকিপ্রবণ সেই সব চরের জন্য পরিকল্পনা একরকম হতে হবে, আবার যে সব চর দুর্গম, পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে তার জন্য আরেক রকম কৌশল গ্রহণ করতে হবে। একইভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের চরের জন্য আলাদা আলাদা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
চরের মানুষের উন্নয়নে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক ইশতেহারে দেশের অধিকার বঞ্চিত চরবাসীর উন্নয়নে সঠিক দিকনির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।
যেহেতু একাদশ জাতীয় নির্বাচন সমাগত সেহেতু ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স নিন্মোক্ত যে বিষয়গুলো প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে সংযোজনের জন্যে অনুরোধ করেছে তা এখানে তুলে ধরা হলো।
১. চর ফাউন্ডেশন/ চর বোর্ড গঠন: চরের মানুষের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জাতীয় পর্যায়ে একটি চর ফাউন্ডেশন বা চর বোর্ড গঠন করা যা চরের মানুষের উন্নয়ন এবং চরের দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশেষ অথিরিটি হিসেবে কাজ করবে। এরকম একটি অথিরিটি না থাকার কারণে প্রতিবছর চরের মানুষের উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে যে থোক অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় তা খরচ হয় না। একই সাথে নদী ভাঙ্গনসহ বিভিন্ন দুর্যোগের সময় চরবাসীর সহায়তা ও সহযোগিতা নিশ্চিত হবে।
২. চর জনগোষ্ঠীর জন্য সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন: চরের মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন এবং টেকসই উন্নয়নে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেবা নিশ্চিত, খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিত, কর্মসংস্থান তৈরি, দক্ষ জনসম্পদ তৈরি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি-এসব লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি)’র লক্ষ্য সমূহ পূরণ করতে হলে চর জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, আশ্রয়, সামাজিক সুরক্ষা, কর্মসংস্থান, কৃষি, দুর্যোগ মোকাবিলা-এসব খাতে সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন যা দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।
৩. জাতীয় চর উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন: চরের মানুষের উন্নয়নে আজ পর্যন্ত কোনো জাতীয় নীতিমালা প্রণীত হয়নি। ফলে চরাঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি পরিচালনা, বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ প্রতিরোধ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসেবা নিশ্চিতকরণ, নারী ও শিশুর অধিকার রক্ষা, চরের ভূমির ব্যবহার, চরের কৃষির উন্নতি, চরে উৎপাদিত ফসলের বিপণন পদ্ধতি, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিসহ চর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে রাষ্ট্রের সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন এখন পর্যন্ত দেখা যায় না। এমতাবস্থায় একটি ‘জাতীয় চর নীতিমালা প্রণয়ন’ চরের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে।
আমরা বিশ্বাস করি উক্ত বিষয়াবলী রাজনৈতিক দলের ঘোষিত ইশতেহারে সংযোজিত হলে অতিদরিদ্র চরের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে হবে। চরবাসীর জন্য ভাল খবর হলো ইতিমধ্যেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এবার তাদের রাজনৈতিক ইশতেহারে নতুন নতুন চমক থাকবে। সেই চমকের অন্যতম একটি বিষয় হলো- চরাঞ্চলের মানুষের টেকসই উন্নয়নে পরিকল্পনার কথা। আমরা বিশ্বাস করি অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও নিজ নিজ দলের ইশতেহারে চরের মানুষের দাবিসমূহ সংযুক্ত করবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)