তিনি রওশনারা বেগম (৮০)। এক সংগ্রামী মা। তার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে সমাজের নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। যে সংগ্রামের শুরু তার শৈশব থেকে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এখন তার বড় পরিচয় তিনি একজন সফল মা । তিনি রত্নগর্ভা । সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত সাত সন্তানের এই জননী নিজে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অল্প শিক্ষিত হলেও প্রতিটি সন্তানকে শিক্ষার পরিপূর্ণ আলোয় আলোকিত করে তুলেছেন। যারা স্বমহিমায় উজ্জ্বল। শুধু তাই নয়; অন্যদের কাছেও যেন অালোর দিশারী রওশনারা।
আপন আলোয় উদ্ভাসিত এই মা তার দৃঢ় মনোবল, অদম্য সাহস ও সতাতার কারণে জয়িতা অন্বেষণ কর্মসূচির আওতায় ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠ জননী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। ২০০৫ সালে পেয়েছেন রত্নগর্ভা অ্যাওয়ার্ড।
তার পাঁচ ছেলে এবং দুই মেয়ের মধ্যে প্রথম ছেলে সুলতান আহাম্মদ, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী পরিচালক, দ্বিতীয় ছেলে মো: সফিকুল ইসলাম মৌলভীবাজার জেলা জজ আদালতের জেলা ও দায়রা জজ, তৃতীয় ছেলে মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, সোনালী ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ অফিসার, চতুর্থ ছেলে মোহাম্মদ আল মামুন বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন সচিবালয়ের উপ-সচিব (অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ), পঞ্চম ছেলে মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের, ডিপার্টমেন্ট অব অফ-সাইড সুপারভিশনের উপ-পরিচালক। তার দুই মেয়ের মধ্যে বিলকিছ আজিজ, গৃহিনী। অন্য কন্যা লায়লা আঞ্জুমান বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একজন স্কোয়াড্রন লিডার হিসেবে ঘাঁটি বঙ্গবন্ধু কুর্মিটোলার কর্মরত।
অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন মা রওশনারা। পড়াশোনার প্রতি ছিল অগাধ আগ্রহ। সৎ মা-ভাইদের সংসারে বড় হওয়া রওশনারা সুযোগ পেলেই বসে যেতেন বই নিয়ে। তবে তার পড়াশোনায় ছিল নিষেধাজ্ঞা। তাই লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে তিনি বই পড়তেন। পড়াশোনার প্রতি তার এই ভালবাসার কারণেই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাসের কোন পরীক্ষায় কখনো দ্বিতীয় হননি। কিন্তু বরাবর প্রথম স্থান অধিকার করা এই মেধাবী নারীর পড়াশোনার ইতি ঘটে পঞ্চম শ্রেণিতেই। মাত্র ১০ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় নারী শিক্ষার ধর্মীয় পশ্চাৎপদতার কারণে আর এগোয়নি তার লেখাপড়া।
সেই সঙ্গে পরিবার থেকেও দেয়া হয়নি কোন উৎসাহ। তার থেকে বয়সে অনেক বড় সৎ ভাইদের মারধরের শিকার হতেন প্রায়ই। এরই মাঝে জীবন, বিয়ে, ভালবাসা, সম্পর্কের বিষয়গুলো বুঝে ওঠার আগেই পুতুল খেলার বয়সে বিয়ে হয় তার। চোখের জলে বাক্সবন্দী করে রেখে যান নিজের অনেক প্রিয় বইগুলোকে।
টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি জেলার কেন্দুয়া গ্রামের মতিয়ার রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। স্বামী বয়সে ১০ বছরের বড় হলেও ছোট্ট রওশনারাকে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে সহায়তা করেছেন বিস্তর।
রওশনারা ছিলেন পরিবারের বড় বউ আর তাই দায়িত্বটাও ছিল একটু বেশি। শ্বশুরের ভালবাসা ও স্নেহের কথা স্মরণ করে এখনো চোখ ভিজে যায় এ নারীর। স্বামীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় সাংসারিক জীবনের অনেক ঝামেলায় সমাধান করতে পারতেন সহজে। তবে সব বিষয়ে সহায়তা পেলেও শিক্ষার বিষয়ে স্বামী শ্বশুর বা কারো কাছ থেকেই পাননি ইতিবাচক সাড়া। তাই তখন থেকেই সংকল্প করেন রওশনারা সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করে গড়ে তোলার।
বিয়ের তিন বছর পরে রওশনারা’র কোল জুড়ে আসে তাদের প্রথম সন্তান। সুলতান আহাম্মদ। এর দু’ বছর পর আসে দ্বিতীয় সন্তান মো: সফিকুল ইসলাম। এভাবে ৭ সন্তানের জননী হন এই নারী। এই সন্তানদের মাধ্যেমেই রওশনারা নিজের অপূর্ণ আকাঙক্ষাকে পরিপূর্ণ করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালান। দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন তাদেরকে সুশিক্ষিত এবং স্বশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে।
রওশনারা ছিলেন পরিবারের সবচেয়ে বড় বউ। প্রায় ৩৫ জন সদস্যের বিশাল সংসারে উদয়-অস্ত পরিশ্রম করতে হত তাকে। এর মাঝে শ্বশুর চেয়ারম্যান হওয়ায় নিত্য মেহমান লেগেই থাকতো বাড়িতে। নিজের ও সন্তানদের জন্য ছিল না কোন সময়। তাই সেই প্রত্যন্ত গ্রামে থাকা এ নারী তার সন্তানদের পড়াশোনা করানোর জন্য বেছে নেন এক অভিনব সময়। রান্না করার সময় রান্নাঘরে চুলার পাশে পাটি বিছিয়ে তার সন্তানদেরকে পড়াতে বসাতেন। পঞ্চম শ্রেণি পাশ এই মায়ের হাতেই হয়েছে সন্তানদের পড়ালেখার হাতেখড়ি। এমনকি তার সব সন্তানকে তিনি নিজেই পড়িয়েছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত।
গ্রামের স্কুল থেকে সন্তানদের প্রায় সবাই পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পেয়েছেন মেধাবৃত্তি। তার দ্বিতীয় সন্তান মো. সফিকুল ইসলাম ১৯৭৮ সালে গ্রামের স্কুল থেকে ঢাকা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তার ৭ সন্তানদের মধ্যে ৪ জনই দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলাফলের ক্ষেত্রেও রেখেছেন সাফল্যের স্বাক্ষর।
ওই সময়ে কেন্দুয়া গ্রাম ও তার আশেপাশের এলাকায় শিক্ষিত লোকের সংখ্যা ছিল হাতেগোণা। ছিল নানারকম সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। এ বিরুপ সামাজিক অবস্থার মধ্যে থেকে থেকে রওশনারা তার সন্তানদেরকে তুলে এনেছেন। এজন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাকে।
সেসময় এত বড় সংসার সামলিয়ে সাত সন্তানকে বড় করে তোলা ছিল সত্যিই এক দুঃসাধ্য বিষয়। স্বল্পশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজের নেতিবাচক প্রভাব থেকে সন্তানদের মুক্ত করে ধারা পরিবর্তনের কৃতিত্ব এই নারীর।
মায়ের স্মৃতিচারণ করে রওশনারার মেজ ছেলে মৌলভীবাজার জেলা জজ আদালতের জেলা ও দায়রা জজ মোঃ সফিকুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমার মা আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু, কড়া প্রশাসক। অনেক ব্যক্তিত্ত্বসম্পন্ন একজন নারী। পড়াশোনার বিষয়ে মা কখনোই আমাদেরকে কোন ছাড় দিতেন না। এই পড়ার কারণে মায়ের কাছে মার খেয়েছি অনেক।
শৈশবের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “একদিন মা চুলার পাশে বসে পড়াচ্ছিলেন। তখন আমি ক্লাস ওয়ানের ছাত্র। মা তরকারি নাড়ছিলেন আর আমাকে পড়াচ্ছিলেন। এমন সময় আমি কিছুটা আনমনা হয়ে পড়লে মা খুন্তি উঁচু করে আমাকে মারার ভয় দেখান। মায়ের একথায় আমি অনেক ভয় পেয়ে যাই। নড়ে উঠি আর এতেই খুন্তির চোখা অংশ এসে লাগে আমার বুকের বাম পাঁজরে। সঙ্গে সঙ্গেই সেখান থেকে মাংস উঠে যায়। সেই দাগ আমি এখনো আমার শরীরে বহন করে চলেছি। আর এ কারণেই মনে হয় আজ এ অবস্থানে আসতে পেরেছি। এখন মায়ের বয়স অাশি বছর। এরপরও মা যতবারই আমাকে দেখেন ততবারই ওইপোড়া দাগটা দেখে কেঁদে ওঠেন।”
ভোর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করা এই মা এতটাই ক্লান্ত থাকতেন যে, মাঝে মাঝে এশার নামাযে বসে সেজদায় যেয়ে প্রায়ই ঘুমিয়ে যেতেন। তিনিই আবার সন্তানরা যখন রাত জেগে পড়াশোনা করত তখন তাদের সাহস যোগাতে সারারাত বসে থাকতেন।
রওশনারার বড় সন্তান বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী পরিচালক সুলতান আহাম্মদ চ্যানেল আই অনলাইকে বলেন, ‘আমার মা মানুষ গড়ার কারিগর। মা ছিলেন সুশাসন, শিক্ষা ও নিয়মানুবর্তিতায় কঠোর। ছোটবেলায় কেউ মারলে মায়ের কাছে এসে নালিশ করলে মা উল্টো মারতেন অার বলতেন ওখানে গিয়েছিলি কেন? এভাবেই আমার মা আমাদের নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শের শিক্ষা দিয়ে বড় করে তুলেছেন।’
মা দিবসে চ্যানেল আই অনলাইনের মাধ্যমে ভবিষ্যত মায়েদের কাছে রওশন অারার আবেদন, প্রতিটি মা-ই যেন সন্তানদেরকে নৈতিক মূল্যবোধসহ সুশিক্ষা প্রদান করেন।