ফেসবুকে দেওয়া একটি স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে প্রায় দুই বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক শিশুকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। উদ্ধার হওয়া ওই শিশুর নাম সজীব। তার বর্তমান বয়স ১১ বছর।
দুই বছর আগে দোকান থেকে মশার কয়েল আনতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া ওই শিশুকে উদ্ধারের এ ঘটনা জানিয়েছেন পুলিশের তেজগাঁও জোনের এসি সালমান হাসান।
তিনি জানান: ‘‘উদ্ধার হওয়া ওই শিশুর বাবার নাম ফারুক হোসেন। বয়স ৪০ এর কাছাকাছি। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন বেগুনবাড়ি এলাকায় তাদের বসবাস। স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে ছোট সংসার। টীনশেডের দুই রুমের ভাড়া বাসা। বাসার সামনে ছোট্ট একটু ফাঁকা জায়গা। সেখানে পুরাতন লোহা-লক্কড় ও প্লাস্টিকের ভাংগা ও পরিত্যক্ত জিনিসের স্তূপ। পুরাতন লোহা-লক্কড় ও প্লাস্টিকের ভাঙ্গা ও পরিত্যক্ত জিনিস সংগ্রহ ও বিক্রি করেই চলে তার সংসার।
দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে সজীব বড়। বয়সের তুলনায় তার মানসিক গ্রোথ কম। তার সমবয়সী অন্য ছেলেমেয়েদের তুলনায় কোনকিছু বুঝতে বা আত্মস্থ করতে তার অনেক বেশি সময় লাগে। কোনকিছু মনে রাখতে পারে না। তবু ফারুক হোসেনের খুব ইচ্ছা ছেলে পড়াশুনা করবে। মানুষের মতো মানুষ হয়ে দূর করবে সংসারের অনটন। হাসি ফুটাবে মা-বাবার মুখে।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৯ তারিখ। বিকেল আনুমানিক সাড়ে চারটার দিকে সজীবকে মশার কয়েল কিনে আনতে দোকানে পাঠায় তার বাবা। বাসা থেকে মিনিট দূরত্বে ৭-৮ টি দোকান। প্রায় আধা ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও সজীবের কোন খবর নেই।
তার বাবা ছুটে যায় আশেপাশের দোকানগুলোতে। দোকানদাররা সজীবকে কেউ দোকানে আসতে দেখেনি বলে জানায়। হতবিহবল ফারুক হোসেন চষে বেড়ায় পুরো বেগুনবাড়ি এলাকা। কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না না সজীবকে।
ফারুক ও তার স্ত্রীর তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো বাসার চারপাশ। বাসা পেরিয়ে আশেপাশের দোকান, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ, পরিচিতদের বাড়িঘর। খবর শুনে ছুটে এলো ফারুকের বন্ধু-বান্ধব ও আশেপাশে অবস্থানরত আত্নীয়-স্বজন। আলাদা আলাদাভাবে খোঁজা হলো পুরো এলাকা। হাতিরঝিল, কুনিপাড়া, নাখালপাড়া, সাত রাস্তা, মহাখালী, রেলওয়ে স্টেশন, মধুবাগ, বিজয় স্বরণী, তেজগাঁও এলাকা।
আত্নীয়-স্বজনরা চলে গেল ডিএমপির সব থানায়। হাসপাতালে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলার থানাগুলোতে। সজীবের কোনো সন্ধান নেই।
রাতেই তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সাধারণ ডায়েরি করে তার বাবা। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার এসআই মার্গুব তৌহিদ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সব থানা, হাসপাতাল ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলার থানাগুলোতে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ায় সজীবকে। মাইকিং করা হলো। সজীবের ছবি সংবলিত ‘নিখোঁজ সংবাদ’ পোস্টার ছাপিয়ে তাতে এসআই মার্গুব তৌহিদের মোবাইল নম্বর দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হলো তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, হাতিরঝিল, তেজগাঁও এলাকার প্রতিটি অলিগলিতে। পোস্টার লাগানো হলো বাস স্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশন, মসজিদ, মন্দিরের দেয়ালে। ঢাকা শহরের অভ্যন্তরীণ রুট ও দূরপাল্লার বাস ও ট্রেনে। সজীবের কোন সন্ধান নেই। সজীবের মা-বাবা, আত্নীয়-স্বজন এবং তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশের দিগ্বিদিক ছুটোছুটিতেও কাজ হলো না।
সপ্তাহ গেল, মাস গেল, পেরিয়ে গেল বছর। ছেলেকে হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে মা-বাবার। হতাশ আত্নীয়-স্বজনরাও হাঁপিয়ে উঠলো। সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের কাছে সজীবকে খুঁজে না পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠলো এসআই মার্গুব তৌহিদ। একপর্যায়ে নিখোঁজ সজীবকে প্রায় ভুলেই গেল সবাই।
প্রাত্যহিক কাজের মধ্যেই পত্র-পত্রিকা, ফেসবুকে নিয়মিত সজীবকে খুঁজে ফেরে এসআই মার্গুব তৌহিদ। প্রতীক্ষায় থাকে একটা ফোন কলের।
গত বছরের ৮ নভেম্বর তেজগাঁও বিভাগের এডিসি হাফিজ আল ফারুক, এসি সালমান হাসান ও আরো কয়েকজন তদন্তাধীন মামলার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আলোচনার ফাঁকে এসি সালমান হাসানের চোখ আটকে যায় একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে। রেললাইনের প্ল্যাটফর্মের পাশে বসে ভিক্ষার থালা হাতে বসে আছে এমন একজনের অস্পষ্ট ছবি পোস্ট করে কাশেম মিয়া নামের একজন স্ট্যাটাস দিয়েছে, ‘ছেলেটার বাপ মা কই আল্লাহ জানে। খুব কষ্টে আছে সে’।
মুহূর্তের মধ্যে এসআই মার্গুব তৌহিদ ফোন করে ডেকে আনলেন সজীবের মা-বাবাকে। রেললাইনের প্ল্যাটফর্মের পাশে বসে ভিক্ষার থালা নিয়ে বসে থাকা যে ছেলেটির ছবি ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে, তাকে সজীব বলে সনাক্ত করলেন।
কাশেম মিয়া নামের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়া সেই ব্যক্তির সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ করলেন এসি সালমান হাসান। সজীবের ছবি তুলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছিল সেটা কোন জায়গা ছিল জানতে চাওয়া হলো তার কাছে।
কাশেম মিয়া প্রথমে স্বীকারই করলেন না এরকম কোনো স্ট্যাটাস তিনি দিয়েছেন। পরে সেই স্ট্যাটাস ডিলিট করলেন। পুলিশ পরিচয়ে কথা বলার পর ডিএকটিভ করলেন ফেসবুক আইডি। প্রায় দুবছর পর ছেলেকে ফিরে পাওয়ার যে স্বপ্ন দেখছিল তার মা-বাবা, নিমিষেই ভেঙ্গে গেল।
কাশেম মিয়ার ফেসবুক আইডি থেকে তার ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা ফেসবুক ফ্রেন্ডদের কাছে তার ফেসবুক আইডিতে দেওয়া ছবি, ডিটেইলস পাঠিয়ে জানতে চাওয়া হলো তার পরিচয়। কেউ তেমন কিছু বলতে পারলো না।
রেললাইনের প্ল্যাটফরমের পাশে ভিক্ষার থালা নিয়ে বসে আছে সজীব- কাশেম মিয়ার পোস্ট করা এই ছবি নিয়ে এসি সালমান হাসান এসআই মার্গুব তৌহিদকে পাঠালেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারের কাছে। ছবি দেখে স্টেশন মাস্টার জানালেন, ‘এটি জামালপুর রেলওয়ে স্টেশনের ছবি’।
তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের নির্দেশে এসআই মার্গুব তৌহিদ ও এসআই নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার একটি টিম পাঠানো হলো জামালপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায়।
দুদিন ধরে তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো পুরো রেলওয়ে স্টেশন ও আশেপাশের এলাকা। দোকানদার, কুলি ও ভিক্ষুকদের দেখানো হলো সজীবের ছবি। কেউ কোনো তথ্য দিতে পারলো না। প্রধান সড়কের পাশে রেলগেট এলাকার প্রায় ষাট বছর বয়সী এক মহিলা ভিক্ষুক সজীবের ছবি দেখে জানালো, ‘এই পোলাডা সারাদিন চিক্কুর দিয়া কানতো। মাসখানেক আগে কাগজ কুড়ানি এক দাড়িওয়ালা বুইড়া ব্যাটার লগে গ্যাছে’।
বৃদ্ধা ভিক্ষুককে নিয়ে রেলওয়ে স্টেশন ও তার আশেপাশের এলাকায় কাগজ কুড়ায় ও বিক্রি করে এমন ছেলেমেয়ে ও লোকজনদের খোঁজ করা হলো। ৩-৪ জন বৃদ্ধা ভিক্ষুকের বক্তব্যকে সমর্থন করলো সজীবকে মাসখানেক আগে দাড়িওয়ালা কাগজ কুড়ায় এমন এক বৃদ্ধের সাথে দেখা গেছে। রাসেল নামের ১০-১১ বছর বয়সী এক শিশু এসআই মার্গুব তৌহিদ ও এসআই নজরুলকে জামালপুর শহরের সরকারি জাহেদা শফির মহিলা কলেজ গেট এলাকায় পুরাতন কাগজ ক্রেতা সালাম মোল্লার কাছে নিয়ে গেল। সালাম মোল্লা সজীবের ছবি দেখে চিনতে পারে।
সালাম মোল্লা জানায়, কাগজ আলী নামের একজন কুড়ানো ও পুরাতন কাগজপত্র বিক্রি করে তার দোকানে। মাসখানেক আগে সজীবও তার সাথে আসতো। বেশ কিছুদিন থেকে কাগজ আলীকে আর দেখা যাচ্ছে না এলাকায়।
কাগজ আলী মূলত রেলওয়ে স্টেশনে যারা কাগজ কুড়ায়, তাদের কাছ থেকে কুড়ানো কাগজপত্র কিনে সালাম মোল্লার দোকানে বিক্রি করতো। সালাম মোল্লা অনেক কাগজ পত্র ঘেঁটে কাগজ আলীর মোবাইল নম্বর দেয় এসআই মার্গুব তৌহিদকে। তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় কাগজ আলীর ব্যবহৃত মোবাইলের অবস্থান পাওয়া যায় গাজীপুরের এরশাদনগর বস্তি এলাকায়। তাৎক্ষণিকভাবে এসআই মার্গুব তৌহিদ ও এসআই নজরুল তাদের টীম নিয়ে চলে যায় গাজীপুর এরশাদনগর বস্তি এলাকায়।
এসআই নজরুল নিজেকে পুরাতন কাগজ ক্রেতা হিসেবে পরিচয় দিয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলে কাগজ আলীর সাথে। কাগজ আলী এখন আর পুরাতন কাগজ কেনাবেচার কাজ করে না জানালেও বেশি দামে কাগজ বিক্রির অফার পেয়ে দেখা করে এসআই নজরুল ও তৌহিদের সাথে। গাজীপুরের এরশাদনগর বস্তিতে কাগজ আলীর ভাড়া করা কক্ষে ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় সজীবকে, যে প্রায় দুই বছর আগে মশার কয়েল কিনতে বাসা থেকে বের হয়ে নিঁখোজ হয়েছিল। কাগজ আলীর বয়স ষাটের কাছাকাছি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাঁচার জন্য বিয়ে করেনি আর। ১০ বছর বয়সী ছেলের মৃত্যু হয় ট্রেনে কাটা পড়ে।
এরপর কাগজ কুড়িয়েই পার করতে চেয়েছিল বাকি জীবন। জামালপুর রেলওয়ে স্টেশনে ভিক্ষার থালা হাতে কাঁদতে থাকা সজীবকে দেখে পিতৃস্নেহ জাগ্রত হয় কাগজ আলীর। একপর্যায়ে সজীবকে নিয়ে পালিয়ে আসে গাজীপুরে পিতৃস্নেহে তাকে বড় করার জন্য।
মশার কয়েল কেনার জন্য বাসা থেকে বের হওয়ার পর কেউ একজন সজীবকে কম দামে বেশি কয়েল দেওয়ার কথা বলে অন্যদিকে নিয়ে যায়। আর কিছু বলতে পারে না সে। সজীবকে জামালপুরসহ বিভিন্ন স্পটে ভিক্ষার থালা হাতে বসিয়ে দেওয়া হতো। সমবয়সী ছেলেমেয়েদের তুলনায় মানসিক গ্রোথ তুলনাূলকভাবে কম হওয়ায় বাবা-মার নাম ছাড়া অন্যকিছু বলতে পারতো না সজীব।’’