যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা উপলব্ধি করেছিলেন যে কিছু অঙ্গরাজ্যের ভঙ্গুর জোট যারা প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্র গঠন করেছিল তাদের টিকিয়ে রাখা সম্ভব শুধুমাত্র এর বৈচিত্র্যপূর্ণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং সময়ে সময়ে বিবদমান ধর্মীয় এবং আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোকে একটি নতুন ও সমষ্টিগত জাতীয় পরিচয়ে একত্রিত করার মাধ্যমে। সৃজনশীল ও সর্বসম্মত সমাধান ছাড়া এই ভঙ্গুর জাতিটি সহজেই দলীয় বিভাজনের মুখে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে।
প্রতিষ্ঠাতারা যে সৃজনশীল সমাধান খুঁজে বের করেন তা হলো এমন একটি সংবিধান প্রণয়ন যা ব্যক্তির ধর্ম চর্চার ও চিন্তার স্বাধীনতার অধিকারকে সবার ওপরে স্থাপন করবে। স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি দেশের জন্য এটাই সবচাইতে উপযুক্ত যে এই দেশটি শুরুই হবে অন্তরের ও ব্যক্তির চিন্তার স্বাধীনতা দিয়ে।
প্রায় দুইশ’ পঞ্চাশ বছর আগে এটি ছিল একটি বৈপ্লবিক ধারণা — একটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রয়াস যার সামনে কোন আধুনিক নজির ছিল না। কিন্তু অতীতের পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ধর্মীয় উপাসনার ও চিন্তার স্বাধীনতার আইনানুগ নিশ্চয়তা একটি ধর্মীয় বৈচিত্র্যপূর্ণ ও প্রাণবন্ত সমাজের উত্থান ঘটাবে।
অসম মানুষদের আমেরিকান হয়ে ওঠার গল্পটা সবসময় বিয়োগান্তক ঘটনা থেকে মুক্ত নয় বরং, আমেরিকার চলমান উপাখ্যানটি হল বৈচিত্র্যের মাধ্যমে ঐক্যের ধারাবাহিক উন্মোচন।
জারা আফ্রিদি (ডান দিকের কেন্দ্রে), নিউইয়র্কের কুইন্সে অবস্থিত সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ অ্যাকশন ভবনের বাইরে বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করছে।
এ দেশটির মৌলিক অকপটতাকে ধন্যবাদ যার জন্য যুক্তরাষ্ট্র আজকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়ভাবে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে, শুধু তাই নয়, আগামী ত্রিশ বছরে এদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এখানকার সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীকে ছাড়িয়ে যাবে।
কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের মোকাবেলা করা ছাড়াই আমেরিকান নাগরিকেরা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম চর্চা করতে পারেন, তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন এবং তাদের ব্যক্তিগত আকাঙ্খা পূরণ করার জন্য তাদের সৃজনশীল শক্তিকে কাজে লাগাতে পারেন।
যার ফলে সেখানে একটি প্রাণবন্ত মতপ্রকাশের বাজার সৃষ্টি হয়েছে যেখানে সবারই স্বাধীনভাবে নিজেদের প্রকাশ করার অধিকার আছে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
আমেরিকান জীবনধারার অন্যান্য বিষয়ের মতো, যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় উপাসনাও অন্তর্ভুক্তির চেতনা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের দ্বারা পূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, রমজান মাসে ইফতারের সমর মসজিদ বা উপাসনালয়গুলো নিয়মিতভাবে অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের জন্যও তাদের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়।
বছর দুই আগে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ওয়াশিংটনের সবচাইতে পুরনো একটি ইহুদী উপাসনালয়ে ইফতার করার। সকল প্রধান ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী এবং ধর্মগুরুরা ঐ ইফতারে অংশ নিয়েছিলেন। এইসব দৃশ্য সারা যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে এখন নিয়মিতই দেখা যায়। বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকজন একত্রিত হয়ে তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেয় কারণ আমেরিকান বলতে তা-ই বোঝায়।
যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম সম্প্রদায় তাদের গোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবদান রেখে থাকে। তারা এই দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত ও সর্বোচ্চ উপার্জনকারী গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম এবং শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবী, নির্বাচিত সরকারী প্রতিনিধিসহ সমাজের সকল ক্ষেত্রেই তারা অংশগ্রহণ করে থাকে।
আসলে, যেদিন আমি লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের গম্বুজের দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলাম, সেদিনই আমি এই লাইব্রেরিতে রাখা আরও একটি মুল্যবান সম্পদ আবিষ্কার করলাম। প্রথম আমেরিকান মুসলিম কংগ্রেসম্যান কিথ এলিসন ২০০৭ সালে শপথ গ্রহণ করার সময় একটি কোরান শরীফ ব্যবহার করেছিলেন যে কোরান শরীফটি ছিল রাষ্ট্রপতি থমাস জেফারসনের। ঐ কোরান শরীফের ওপর হাতে লেখা ছিল “টি জে” অক্ষর দুটি। লাইব্রেরীতে রাষ্ট্রপতি জেফারসনের ওল্ড টেস্টামেন্টের কপিটির পাশে কোরান শরীফটিও সংরক্ষিত রয়েছে।
ধর্মীয় স্বাধীনতার গল্পের সাথেই শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের গল্প। সরকারি ভবন থেকে শুরু করে ইতিহাসের সংগ্রহশালা পর্যন্ত এই গল্পগাঁথাটি বারংবার দৃঢ়তার সাথে পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। এটি এমন একটি গল্প যা আজও এই জাতি গঠনে ভূমিকা রেখে চলেছে।
এমন একটি বিশ্ব যেখানে বিশ্বায়ন, প্রযুক্তি এবং ভ্রমণের তিন শক্তি দ্বারা সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান বৈচিত্র্যের সাথে বহু দেশকে মানিয়ে নিতে হয়, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা ও আমেরিকান স্বকীয়তা গড়ে তোলার মধ্যে অনেক শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে। এই শিক্ষনীয় বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সীলমোহরে খোদাই করা লাতিন অক্ষরে। আর এটাই তুলে ধরে আমেরিকান পরিচিতির মূল প্রতিপাদ্যকে — “এ প্লুরিবাস ইউনুম” -– অর্থাৎ “অনেকের মধ্যে এক।”
সামির মনসুর: “লাইভসেফ” নামক একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের প্রতিষ্ঠাতা।