জীবন চলার পথে সারাক্ষণ হাসতে থাকা এক ‘পাগল’কে হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উত্তরে হতভম্ব করে বলেছিলো- ‘হাসতে ভুলে গেলে জীবনের প্রতিটি ক্ষণ আমাকে বিষাদক্রান্ত করে। তাই আমি হাসি।’ পরক্ষণে হাসতে হাসতেই মান্না দে’র একটি গান শোনালো – ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে, তার প্রতিবাদ করি আমি, যখন তুমি আমায় পাগল বলো, ধন্য হয় যে সে পাগলামি, ধন্য আমি ধন্য হে, পাগল তোমার জন্য যে’।
বলাবাহুল্য, এই লেখকের জন্য কেউ আদৌ পাগল হয়েছিলেন কিনা, সেটি গভীর গবেষণার বিষয়! তবে মান্না দে’র জন্য লেখক নিজেই পাগল। পহেলা মে এলেই মনে পড়ে- বাঙালির প্রেমেও মান্না, বিরহেও মান্না; আড্ডায় মান্না, নস্টালজিয়ায়ও মান্না। শুভ জন্মদিন মান্না। আজ তাঁর একশ একতম জন্মদিন। পৃথিবীজুড়ে করোনাক্রান্তির গৃহবন্দীত্ব জীবনে তাই আজ ঘুরে ফিরে এসেছে মান্নার স্বর। এই করোনাকাল, যখন মান্না দে’র সুর বাজে মনে। চোখে দেখি না যাকে বা যাদের, প্রতিটি ক্ষণ মনে হয়- ‘আবার হবে তো দেখা’। আর যদি করোনা শেষে বদলে যাওয়া মানুষের বদলে যাওয়া রূপ দেখি? তখনকার গানও গেয়েছেন মান্না- ‘তুমি নিজের মুখে বললে যেদিন সবেই তোমার অভিনয়’। তাই আজ লকডাউন ‘আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে’ অরুন্ধতী দেখে দেখে বিরহ ভর করেছে মনে- ‘কতদিন দেখিনি তোমায়’! কলকাতা বইমেলা থেকে সাংবাদিক রূপায়ন ভট্টাচার্যের ‘হৃদয়ে লেখো নাম’ বইটি কিনে নতুন এক মান্না ধরা দিয়েছে আমার কাছে। এই বইটি না পড়লে মান্না থাকতো অচেনা, অজানা। রূপায়ণ ভট্টাচার্য’র এক-একটা লাইন কেমন যেন বুকের মধ্যে গেঁথে যায়। তিনি বলেন- ভালোবেসে রাজা বা ফকির দুই হওয়া যায়, হৃদয় আছে যার সেই তো ভালোবাসে! মান্নার রোমান্টিক বাংলা গান তিনটি সিংহদরজা খুলে দিয়েছেন মান্না দে- স্মার্টনেস, নাটকীয়তা ও বৈচিত্র্যে।
মান্না আসলে এক জন নয়। বাঙালি যতদিন প্রেমে পড়বে, পড়ে ব্যাথা পাবে, ব্যাথায় আহা-উহু করবে, ততবারই মান্নার খোঁজ নেবে। মান্না দে হাজার হাজার, লাখ লাখ। বাংলা সঙ্গীত অনুসারীরা ‘জীবনে কী পাবো না’ বলে যখন উঁকি দিয়ে দেখে যে ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’ আর নেই, তখন কোথাও না কোথাও হাহাকার উঠে যে ভালোবাসার জন্য ‘ক’ফোঁটা চোখের জল’ ফেলছি আমরা? মান্না এমন এক সুরের জাদুকর যিনি আফসোস রেখে বলেন- ‘আবার হবে তো দেখা’? কিংবা যদি কাগজে লেখা নাম ছিড়ে যায়, তবে হৃদয়ে লিখতে বলে তিনি দেখাতে পারেন বিহারের গয়ায় মাটির নিচে নীরব অভিশাপ নিয়ে বয়ে চলা ফল্গু নদীর যাতনা। করোনাক্রান্তি, তাই ‘খুব জানতে ইচ্ছে করে, তুমি কি সেই আগের মতো আছো?’
মান্না দে, তুমি আমার কৈশোর পরিপূর্ণ করেছিলে। হৃদয়ে লেখা আছে তোমারই নাম। সে নাম হয়তো থেকে যাবে আজীবন। বিহারের ফলগু নদীর তীরে গিয়ে শুধু ভেবেছি তোমারই কথা। নীরবে বয়ে যাওয়া ফলগু স্রোতের সাথে মানুষের মনের এমন বিচিত্র উপমা, তোমার পক্ষেই সম্ভব।
নানাবিধ বিবেচনায় তোমার শ্রেষ্ঠ গান আমার কাছে ‘জীবনে কী পাবো না’। কিন্তু যখন শুনি প্রেমের সেই ঐতিহাসিক গাণিতিক হাহাকার, “ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ?” তখন, ক্যালকুলেটরে ফোঁটা গুণতে বসে যাই। ডিজিট ধরে না ওই ক্যালকুলেটর মেশিনে! মান্না দে গেয়েছেন, ‘হৃদয়ে লেখো নাম সে নাম রয়ে যাবে’। সরল প্রেমিকের মতো বিশ্বাস করেছিলাম। তাই কৈশোর থেকে এই যৌবন, প্রিয় সব নাম সব কাগজে বা পাথরে না লিখে হৃদয়ে লিখে রেখেছি। ফলে বহুলব্যবহৃত এবং ঘনপল্লবিত শোভাবেষ্টিত হৃদয়টি মাঝে মাঝে কম্পমান হয়। ভয় হয়, ডাক্তার সাহেব পরীক্ষা করে এই বুঝি জানালেন, আপনার এক হৃদয়ে এত নামের স্থান সংকুলান হবে না! আঁতকে উঠলেও ভাবি, চট্টগ্রামের ছেলে, এনজিওগ্রামে কিসের ভয়?
বিরহী উৎপাদকে ভালোবাসার বিশ্লেষণ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে মান্না দে’র সুর। যিনি প্রেমের বিনিময় বলয়কে ক্রমে ক্রমে বাড়াতে থাকেন, ফলে তৈরি হয় সম্পর্ক নামক উৎপাদকে বিশ্লেষণ জগৎ। এ বড় জটিল জ্যামিতি। অনেক আবেগ, অনেক পদ্ধতি, অনেক টানাপড়েনের বীজগাণিতিক পূর্ণসংখ্যার বলয় মিলেই চলে মান-অভিমানের খেলা। মান্না দে তাই অদ্ভুত। ভালোবাসা, বিরহ, পাগলামি যেন সমকোণী ত্রিভুজ। যে ত্রিভুজ ডেডিকেট প্রেমিককে রাজ্যের যত টেনশন দেয়, প্রেমিকাকে দেয় মৌলিকে আদর্শ উৎপাদক মেনে চলার অদ্ভুত ঘোর লাগা মাদকতা। মান্না দে’র সুরের জ্যামিতিক উৎপাদককে বিশ্লেষণ চাট্টিখানি কথা নয়। তাই জীবনে চলার পথে কখনো কিছু মুহূর্ত আসে, মন খুলে গাইতে ইচ্ছে করে ‘এমন বন্ধু আর কে আছে’? আবার কারো কারো জীবনে আসে অন্যরকম মুহূর্ত ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’ বলে কেঁদে বুক ভাসানোর মতো। ভরসা তখন একটাই। স্মৃতি! তা-ও মান্না গেয়েছিলেন- ‘মিষ্টি একটা গন্ধ রয়েছে ঘরটা জুড়ে’।
লেখাটির শেষ করবো হেঁয়ালি দিয়ে। এইচএমভিতে তাঁর শেষ সিডিতে প্রেমিক মান্না গেয়ে উঠেছিলেন, ‘ও হাসিনা, আমি কি তোর এতই অচেনা’? হ্যাঁ, দেশ ও দশের চারপাশে তাকালে মনে হয়, মান্না দে, ঠিক বলেছেন মাইরি!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)