১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যার হুকুমে শহীদদের রক্তে লাল হয়েছিল বাংলাভাষীদের উদার জমিন সেই খুনীর নামে কিভাবে বিদ্যালয়টি চালু রয়েছে? তার নাম রেখেই সেটিকে কেন জাতীয়করণের ঘোষনা দিল সরকার? মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় পৃথিবীর ইতিহাসে আত্মদানের এক বিরল নজীর স্থাপন করেছিল বাংলা মায়ের দামাল সন্তানেরা। তাদের সেই আত্মবলিদানের স্মৃতি রক্ষায় একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
কোমলমতি শিশু কিশোররা প্রভাতফেরীর গানে গানে স্মরন করে শহীদদের। নেত্রকোনার মদনে পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের ও তার স্ত্রী তহুরার নামে প্রতিষ্ঠিত টি-আমিন উচ্চবিদ্যালয়টিকে নামকরণ ঠিক রেখেই জাতীয়করণের ঘোষনা দিল সরকার। এই পাকিস্তান প্রেমিক নূরুল আমিনের বাড়ি ছিল নান্দাইল জেলায়। পড়াশোনা করতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মামার বাড়িতে। ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের বোর্ডিং সংলগ্ন তার একটি বাড়ি ছিল বলে জানা যায়। এই বাড়িটি কিভাবে ও কার অধীনে আছে এখন তা অজানা।
কুখ্যাত নূরুল আমিনের শ্বশুর বাড়ি নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার কদমশ্রী গ্রামে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পাকিস্তান চলে যান। জনশ্রুতি রয়েছে নূরুল আমিন এতবেশি পাকিস্তান প্রেমিক ছিলেন যে, তিনি বলতেন- আমার মৃত্যু যেন বাংলাদেশে না হয়। তাই তার সাধের পাকিস্তানে মরতেই তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করে পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছিলেন। এমন একজন পাক-প্রেমিকের নামে বাংলাদেশে বিদ্যালয় থাকা বিস্ময়কর নয় কি?
ময়মনসিংহে অন্বেষা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা যেভাবে কুখ্যাত রাজাকার মোনায়েম খানকে শহীদ ভাবতে শুরু করেছিল। টি, আমিনের ছাত্র-ছাত্রীরা তা ভাবছেনা তার কি নিশ্চয়তা? উল্লেখ্য টি, আমিন উচ্চ বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ১৯৪৬ সালে। টি মানে তহুরা আর আমিন মানে নূরুল আমিনের আমিন। টি-আমিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, তহুরা মারা যাওয়ার পর তার মামারা ভাগ্নীর স্মৃতি রক্ষায় বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। তহুরার স্বামী হিসাবে নামকরণে নূরুল আমিনের আমিন সংযুক্ত হয়েছে।
এলাকার অনেকের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, বিদ্যালয়টি নূরুল আমিনই প্রতিষ্ঠা করেছে। সুতরাং যে ছাত্র ছাত্রীটি বিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই শুনবে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন নূরুল আমিন। এতে কি তার প্রতি মহান ব্যক্তি ভাবার মোহ সৃষ্টি হবে না? প্রতিষ্ঠানেই নামাকরণ ধারীদের নাম সম্মান সহকারে উল্লেখ করা হয়। তার ছবি সংরক্ষন করা হয়। প্রকাশিত সংকলনে ও স্মরণিকায় তাদের কীর্তিগাঁথা প্রচার হয়। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সম্মানসহকারে তাদের নাম উল্লেখের নজির রয়েছে।
মদন, মোহন গঞ্জ, খালিয়াজুরী এই তিনটি উপজেলা নিয়ে নেত্রকোনা – ৪ সংসদীয় এলাকা গঠিত। এখানকার বর্তমান সংসদ সদস্য রেবেকা মমিন। তিনি বঙ্গবন্ধু আমলের মন্ত্রী ও ১৯৫২ সালের ভাষা সংগ্রামীদের মধ্যে অন্যতম একজন আব্দুল মমিনের স্ত্রী। ভাষা আন্দোলনে আব্দুল মমিনের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। আবুল মনসুর আহমেদের আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর গ্রন্থে ভাষা আন্দোলনের ১১জন নেতার নাম উল্লেখ রয়েছে। এই ১১ নেতাই নূরুল আমিনের জারীকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের নেতৃত্ব প্রদান করেন। ১১ নেতার অন্যতম ১জন আব্দুল মমিন। তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার কাজিয়াটি গ্রামে। আব্দুল মমিন স্মৃতি পরিষদের একটি প্রকাশনায় প্রচারিত ১১জন ভাষা সৈনিকের নামের তালিকা নিম্নরূপ:
(১) জনাব গাজীউল হক (বিশিষ্ট আইনজীবী)
(২) জনাব হাবিবুর রহমান শেলী (সাবেক বিচারপতি)
(৩) জনাব মোহাম্মদ সুলতান (বামপন্থী নেতা)
(৪) জনাব এম,আর আক্তার মুকুল (লেখক)
(৫) জনাব জিল্লুর রহমান (সাবেক প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ)
(৬) জনাব আব্দুল মমিন (আওয়ামী লীগের আমলে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী)
(৭) জনাব এস,এ বারী এটি (বিএনপির সাবেক উপপ্রধান মন্ত্রী)
(৮) জনাব সৈয়দ কমরুদ্দীন হোসেইন শহুদ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক)
(৯) জনাব আনোয়ারুল হক খান (মুজিব নগরের তথ্যসচিব)
(১০) জনাব মঞ্জুর হোসেন (চিকিৎসক)
(১১) জনাব আনোয়ার হোসেন (পরিচয় অজ্ঞাত)
এই প্রকাশনাটিতে লিখেছে, ১৯৫২ এর ২০ ফেব্রুয়ারী, বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ন। কারন ঐ দিনেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভবিষ্যতৎ গতিধারা নির্ধারিত হয়ে যায়। ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারী বেলা তিনটায় পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশন হওয়ার কথা। সেজন্য সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহন করে যে, একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস উপলক্ষে প্রদেশ ব্যাপী হরতাল পালিত হবে।
কিন্তু আকস্মিকভাবে ১৪৪ ধারা জারী হওয়ায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ ভাবল-পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হলে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটবে এবং নূরুল আমিন সরকার এ অজুহাতে আসন্ন প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন স্থগিত করতে পারে। তাই বিরোধী দলগুলো ভাষা আন্দোলনের চেয়ে নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি মনে করে ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়।
এ কাপুরুষোচিত সিদ্ধান্ত তখন সংগ্রামী ছাত্রসমাজের নিকট অসহায়ের আর্তনাদ মনে হচ্ছিল। ২০ ফেব্রুয়ারি শীতের গভীর রাতে যখন দুর থেকে মাইকের আওয়াজে ভেসে আসছিল, হরতাল প্রত্যাহার করা হয়েছে, তখন ফজলুল হক হলের এক কামরায় গুটিকয়েক ছাত্রের অটল সিদ্ধান্ত, ‘১৪৪ ধারা ভাঙ্গবই, ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল করবই।’ সর্বদলীয় কর্ম পরিষদের সদস্য নন এমন কিছু সংখ্যক ছাত্রনেতা রাত ১২ টায় ঢাকা হলের পুকুরের পূর্ব পাশের সিঁড়িতে জরুরী গোপন বৈঠক করেন। তারা হলেন উপরে উল্লেখিত ১১ জন নেতা। এ তথ্য প্রকাশ করেছে আব্দুল মমিন স্মৃতি পরিষদ, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা।
টি-আমিন উচ্চ বিদ্যালয় জাতীয়করণের আগে কি উচিত ছিলনা ভাষা শহীদদের খুনীর নাম পরিবর্তন করে একজন ভাষা সৈনিকের নাম সংযোজন করা? শিক্ষা মন্ত্রনালয় কি টি, আমিন সম্পর্কে অবগত নন? শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ একসময় ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। নুরুল আমিন সম্পর্কে তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। তিনি কেন জাতীয়করণ ঘোষনার আগে নূরুল আমিনের নামের অংশটা বাদ দিতে প্রয়াসী হলেন না?
বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধায় ফুল দিতে যাবে আবার ভাষা শহীদদের খুনীকেও শ্রদ্ধাভরে স্মরন করবে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দিনে! যে ভাষার জন্য জীবন দিলো সালাম, বরকত রফিক, জব্বার। সে ভাষাতেই সম্মান সহকারে নাম ফলকে জ্বলজ্বল করে লেখা রয়েছে কুখ্যাত খুনী নূরুল আমিন ও তার স্ত্রীর নাম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মদনের একজন সচেতন নাগরিক বলেন, ‘আসলে তহুরার মামারা নয় নূরুল আমিনের টাকায়ই এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে নূরুল আমিনকে মহান লোক হিসেবেই ভেবে চলছে।’
তাদের মুখের ভাষা কেড়ে নেয়ার বিরোধিতাকারী বীর সৈনিকরা বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়েছিল যে নূরুল আমিনের হুকুমে। এত বছর ধরে তার নামাকরণে এটি বহাল তবিয়তে চালু থাকল কিভাবে।দেশে কত প্রতিষ্ঠানের নাম বদল হল এটি হলনা কেন? ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে বইয়ের পাতায় নূরুল আমিনের নাম শুনেছে অনেকেই কিন্তু টি,আমিনের নূরুল আমিনই যে সেই নূরুল আমিন তা অনেকেই জানেনা।শিক্ষকরা তা চেপে যায় বলে জানা যায়।
এখন পাকিস্তানপন্থী দল ক্ষমতায় নয়। তবু সরকার কেন এটা দেখেও দেখলনা? শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি ইচ্ছে করেই জেগে ঘুমাচ্ছে? নইলে ভাষা সংগ্রামীদের খুনী রাজাকার নূরুল আমিনের ‘আমিন’বহাল রেখেই কিভাবে বিদ্যালয়টিকে জাতীয়করণের ঘোষনা দেয়া হল? এনিয়ে এলাকায় রয়েছে ব্যাপক ক্ষোভ ও গুঞ্জন। মদনের ছাত্র তরুন ও সচেতন ব্যক্তিবর্গ এনিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই নামাকরনের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে চলেছেন।তাদের বক্তব্য, বিদ্যালয়টি জাতীয় করণ হোক সেটিতো সকলেরই চাওয়া। কিন্তু নূরুল আমিনের কুখ্যাতি ঢেকে রাখায় সহায়ক এই নামাকরণ বদল হোক।
একজন ভাষা সৈনিকের এলাকায় একজন ভাষা শহীদদের খুনীর নামে বিদ্যালয়ের নামাকরন বহাল থাকতে পারেনা। আরও বিস্ময়ের বিষয় হল ভাষা সৈনিকের স্ত্রী বর্তমানে সাংসদ ও ক্ষমতায় বঙ্গবন্ধুর গড়া আওয়ামী লীগের সরকার। ভাষা সৈনিকের এলাকায় ভাষা শহীদদের খুনীর নামে বিদ্যালয় জাতীয় করন কেন। কেন নামাকরণটি বদল করা হলনা? বর্তমানে ক্ষমতায়তো পাকপন্থী সরকার নয়, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের সরকার। কেন এই পাক প্রেমিকের সম্মানজনক উপস্থিতি? এ প্রশ্ন বেশ জোরেশোরে জাগছে সর্বত্র।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)