যুদ্ধ, যুদ্ধবাজ ও মারণাস্ত্র-এ তিনটিই হচ্ছে শান্তি নষ্টের মূল উপাদান। মারণাস্ত্র তৈরির উপাদান আবিষ্কার ও অস্ত্র ব্যবসা করে এক সময় মানবজাতির জন্য অশান্তির কারণ হয়ে উঠেছিলেন যিনি, সেই ব্যক্তিই চালু করেছেন বিশ্বের সবচেয়ে নামী ও দামি পুরস্কার, যার মধ্যে শান্তির জন্যও পুরস্কারও রয়েছে। এই কাজটি করেছিলেন আলফ্রেড নোবেল, যিনি একজন সুইডিশ রসায়নবিদ, প্রকৌশলী, উদ্ভাবক এবং অস্ত্র নির্মাতা।
ডিনামাইটসহ আলফ্রেড নোবেলের অধিকাংশ আবিষ্কারই ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। কথিত আছে যে, এক ফরাসি পত্রিকায় আলফ্রেড নোবেলকে ‘মৃত্যুর সওদাগর’ হিসেবে অভিহিত করে। আলফ্রেড মানুষ হত্যার বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করে প্রচুর টাকা উপার্জন করেছেন, কিন্তু সেই টাকা পুরো মানব জাতির কল্যাণের কোনো কাজে ব্যয় করেননি বলে তার প্রচণ্ড নিন্দা করে। পত্রিকার এই লেখাটি আলফ্রেড নোবেল পাঠ করে বেশ কষ্ট পান। অনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেন তাঁর উপার্জিত অর্থ মানবকল্যাণের কাজে ব্যয় করবেন। তিনি ভাবলেন, এমন একটি ভালো কাজ করে যাবেন, যা দিয়ে পৃথিবীর মানুষের চোখে চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে থাকতে পারেন। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ১৯০১ সাল থেকে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সফলতা এবং অনন্য সাধারণ গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং মানবকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।
প্রথম দিকে এই পুরস্কারের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও পরে তা সমালোচিত হতে থাকে। বিশেষ করে সাহিত্য ও শান্তির জন্য নোবেল নিয়ে সৃষ্টি হয় নানা বিতর্ক। সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয় শান্তি নিয়ে।
এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অনেকেই মনে করেছিলেন, এবার নোবেল শান্তি পুরস্কার যাবে জার্মানিতে। সেখানে আঙ্গেলা ম্যার্কেল পুরো ইউরোপীয় মনোভাবের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সিরীয় শরণার্থীদের জন্য যে দরদ দেখিয়েছেন, তাতে শান্তির নোবেলটা তাঁর প্রাপ্যই ছিল। আবার মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক ও সাহসী ভূমিকার কারণে অনেকে এমনটাও রটিয়েছিলেন যে, নোবেল এবার বাংলাদেশের ঘরেই আসছে। কিন্তু নোবেল কমিটি পুরস্কার তুলে দিয়েছে পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত একটি সংস্থাকে। পৃথিবী থেকে ‘পরমাণু অস্ত্রের নাম-নিশানা মুছে দেওয়ার অঙ্গীকার’ নিয়ে শতাধিক দেশে গণআন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে ‘আইক্যান’-নামক সংস্থাটি। নোবেল শান্তি পুরস্কার এবার তাদের জন্যই বরাদ্দ হয়েছে। সাধারণ মানুষ সব সময়ই যুদ্ধের বিরুদ্ধে, পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে। নোবেল কমিটিও এই জনমতকেই শ্রদ্ধা জানিয়েছে।
কিন্তু তাতে বড় বেশি ‘স্বস্তি’ মেলেনি! যুদ্ধ-অশান্তি গোটা বিশ্ববাসীর ঘাড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। উত্তর কোরিয়ার শাসক সকাল-বিকাল হুঙ্কার ছাড়ছে। বাচ্চাদের খেলনার মতো ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র নিয়ে কসরৎ তাঁর। পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় সামিল হওয়ার অদম্য আগ্রহ ইরানে। পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগ করে ভারতকে রোখার হুমকি পাকিস্তানের। ভারতও প্রতিনিয়ত চীন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিজের শক্তি প্রদর্শনে উন্মত্ত। এই সবক’টি শাসানির পাল্টা হুমকি-হুঁশিয়ারি-হুঙ্কারও জন্ম নিচ্ছে স্বাভাবিক ভাবেই। আর নোবেল কমিটির সদস্যরা স্লোগান-সর্বস্ব এক সংস্থার হাতে শান্তি পুরস্কার তুলে দিয়ে নিজেদের দায় শেষ করছেন!
শান্তি পুরস্কারে তাই নেই কোনো ‘শান্তি’র অঙ্গীকার। বরং দিন দিন যুদ্ধের শঙ্কা বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আসন্ন যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়ে চলেছেন। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে অনেক আলোচনা হয়েছে বলে তিনি মনে করছেন। বিপুল অর্থ অনর্থক খরচ হয়ে গিয়েছে বলে তাঁর ধারণা। একের পর এক চুক্তি বা সমঝোতার নামে আমেরিকাকে বোকা বানানো হয়েছে বলে তাঁর বিশ্বাস। তাই উত্তর কোরিয়াকে বাগে আনতে একটাই মাত্র পথ কার্যকরী হবে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
উত্তর কোরিয়ার সর্বময় শাসক কিম জং উনও পিছিয়ে থাকার পাত্র নন। অন্য যে বিষয়েই তিনি পিছিয়ে থাকুন, হুমকি-হুঙ্কারে অন্য সকলের চেয়ে এগিয়ে থাকতেই পছন্দ করেন। স্বাভাবিক ভাবেই ফের উঁচু গলায় পরমাণু আক্রমণের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছেন কিম। আমেরিকা বার বার যুদ্ধের প্ররোচনা দিচ্ছে এবং এই প্ররোচনার জবাব একমাত্র পরমাণু বোমাতেই দেওয়া সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
অর্থাৎ দুই রাষ্ট্রপ্রধানই একমত হয়েছেন যে, এই টানাপড়েনের ‘সুরাহা’র পথ মাত্র একটাই। একজন খোলাখুলি বলে দিয়েছেন, পথটা হল পরমাণু হামলা। আর একজন শব্দগুলো স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেননি। কিন্তু খুব দরাজ ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কী বলতে চাইছেন।
এ বাস্তবতায় সব ক্ষোভ গিয়ে পড়ছে নোবেল শান্তি পুরস্কারের ওপর। সবাই বলছেন, শান্তির নোবেল আসলে কতটা শান্তির জন্য? যথারীতি শান্তির নোবেল নিয়ে এবারও শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক!
আসলে শান্তির নোবেলটা বড়ই গোলমেলে। বরাবরই বড্ড অশান্তির। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুচির নোবেল কেড়ে নেয়ার দাবিতে সোচ্চার মানুষের সংখ্যা দুনিয়ায় একেবারে কম নয়! গত বছরেও কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জুয়ান ম্যানুয়েল স্যান্টোসের নোবেল শান্তি পুরস্কার যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। অভিযোগ আছে, নোবেল শান্তি পুরস্কার নাকি রাষ্ট্রপ্রধান আর রাজনীতিবিদদের একচেটিয়া হয়ে উঠেছে। আজ পর্যন্ত অন্তত ১৬ জন রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থাকাকালীন নোবেল পেয়েছেন। এছাড়াও পাঁচজন প্রাক্তন আর ছয়জন ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রপ্রধানও পেয়েছেন শান্তির নোবেল। সেই ১৯০৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টকে দিয়ে এই ট্র্যাডিশনের শুরু। নিউইয়র্ক টাইমসের মতে এই রুজভেল্ট ছিলেন আমেরিকার সব চাইতে যুদ্ধবাজ নাগরিক। কিউবা আর ক্যারেবিয়ানে মার্কিন শক্তির আস্ফালন দেখিয়েছেন তিনি। তাই রুজভেল্টকে শান্তির দূত হিসেবে দেখে সেই যুগেও অবাকই হয়েছে বিশ্ববাসী। অনেক পরে ১৯৭৩-এ হেনরি কিসিঞ্জারের নোবেল প্রাইজ বিরাট বিতর্কের সৃষ্টি করে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে থাকা নোবেল কমিটির দু’জন সদস্য পদত্যাগ পর্যন্ত করেন। ১৯৯৪-তে ইয়াসির আরাফাতের নোবেল নিয়েও বিতর্ক ছিল। সেমন পেরেজ আর আইজাক রবিনের পাশে দাঁড় করিয়ে অবশ্য বিতর্ক খানিকটা চাপা দেওয়া গিয়েছিল। জাতিসংঘ স্থাপনের জন্যে ১৯৪৫-এ কর্ডেল হাল নোবেল পেলেও তার ছ’বছর আগে প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের সেক্রেটারি অব স্টেট হিসাবে ৯৫০ জন ইহুদিকে আমেরিকায় ঢুকতে না দিয়ে ইউরোপে ফেরত পাঠানোর নজির আছে তার। এদের অনেকেই পরে হন হলোকাস্টের শিকার। ওবামা প্রেসিডেন্ট হবার মাত্র ১২ দিন পরে ২০০৯-তে হয় তার নমিনেশন। নিউ ইয়র্ক টাইমস ওবামার নোবেলকে ‘অত্যাশ্চার্য বিস্ময়’ বলে বর্ণনা করেছে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার দিয়ে নরওয়ের অ্যাকাডেমি বহুবার বিব্রত করছে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রকে। ১৯৩৫-এ কার্ল ভন ওসিয়েটস্কি নামে এক জার্মান বন্দিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। জার্মানি ফেটে পড়ে প্রতিবাদে। ওসিয়েটস্কি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে এসেছে জার্মানিতে। দেশের আইনকে তোয়াক্কা না করেই। হিটলারের উত্থানের আগে থেকেই। ওদিকে ২০১০-এ নোবেল পাওয়া চীনা অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক সমালোচক লিউ জিয়োবো ছিলেন জেলবন্দি। একইভাবে দালাই লামার নোবেল শান্তি পুরস্কারও নিশ্চয়ই নরওয়ে-চীনের বন্ধুত্ব বাড়াতে সাহায্য করেনি। ঠিক যেমন সেই ১৯৭৫ সালে শাখারভের শান্তি পুরস্কার নরওয়ে-সোভিয়েতের সম্পর্ককে তিক্তই করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো করেও নোবেল পেয়েছিলেন গর্বাচেভ।
আসলে রীতিমতো যুদ্ধ করেছে এমন রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজনীতিক শান্তির নোবেল পেলে বিস্মিত হতে হয় বইকি! মালালার নোবেলে অনেকে বিস্মিত হয়েছিল। সন্ত্রাসবাদীদের গুলিতে বিদ্ধ হওয়াটা আর যাই হোক নোবেল পাওয়ার যোগ্যতামান বলে মনে হয়নি। মনে হয়েছিল যে এক্ষেত্রে যদি কাউকে নোবেল দিতেই হোত তা দেওয়া উচিত ছিল মালালার বাবাকে। কী শত-সহস্র প্রতিকূলতার মধ্যে তিনি মেয়েকে পাঠিয়েছেন ইস্কুলে।
ডিনামাইট-মারণাস্ত্র আবিষ্কার করে, অস্ত্র ব্যবসা করে অশান্তির উপকরণ থেকে যে টাকা নোবেল সাহেব উপার্জন করেছিলেন, সেই টাকায় প্রদত্ত ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ তাই শান্তি প্রতিষ্ঠায় কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না! উল্টো বরং অনেক ক্ষেত্রে এটা প্রহসনে পরিণত হচ্ছে!
নোবেল সাহেব পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, সাহিত্যের সঙ্গে অকস্মাৎ ‘শান্তি’কে পুরস্কারযোগ্য ক্ষেত্র হিসাবে নির্বাচন কেন করলেন, তা এক অপার বিস্ময়। একটি শাস্ত্রে কৃতবিদ্য হওয়া আর জগতে শান্তি প্রসার করবার মধ্যে এতখানিই পার্থক্য, এই দুটিকে একই বর্গে গণ্য করা প্রায় অসম্ভব। বিদ্যাচর্চা বা জ্ঞানভিত্তিক কর্মের জন্য যে পুরস্কার, তা শান্তিপ্রয়াসের জন্য দেওয়া হবে কেন? তার জন্য পৃথক, এমনকী বৃহত্তর পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকতেই পারে। কিন্তু সকল প্রকার নৈপুণ্যকেই পাশাপাশি বসালে, মেসি-রোনালদোরাও আক্ষেপ করে বলতে পারেন, আমি নোবেল পেলাম না কেন? কিছু নিন্দুক বলেন, নোবেল ডিনামাইট ও ব্যালিস্টাইট আবিষ্কার করেছিলেন, উভয়েই হিংসার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত, তাই তিনি শান্তিকেও নিক্তিতে তুলে দাঁড়িপাল্লা সমান করতে চেয়েছিলেন। নোবেলের সম্ভাব্য অপরাধবোধের কারণে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অকারণে বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছেন কি না সেই প্রকাণ্ড প্রহসনের উত্তর কে দেবে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)