তসলিমা নাসরিনকে বেশি ভালো লাগার কারণ হচ্ছে, তিনি অকপটে সত্য বলেন। সত্য যতই নির্মম হোক এর থেকে সুন্দর দ্বিতীয়টি আর নেই। তার প্রতি একরকম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা কাজ করে সেই ৯৮ সাল থেকে। যার ফলশ্রুতিতে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘বাই সাইকেল’ তাকে উৎসর্গ করেছিলাম। তার সাথে আরও দুজন প্রিয় লেখকও ছিল। আরজ আলী মাতুব্বর ও হুমায়ূন আজাদ। এই তিনজনের প্রতি আমার অনুরাগ অনেক।
তসলিমা নাসরিনের পক্ষ নিয়ে এ যাবতকাল অসংখ্য মানুষের সাথে বাদানুবাদ হয়েছে। আজও হচ্ছে। কেউ কেউ মনে করেন আমি তার অন্ধভক্ত! অন্ধভক্ত বলতে যা বোঝায় আসলে আমি তা নই। তার অনেক চিন্তা ভাবনা, বক্তব্যের সাথেও দ্বিমত পোষণ করি। এটা নিশ্চয় অন্ধভক্তর পর্যায় পড়ে না? অনেকে তাকে নারীবাদ আন্দোলনের অন্যতম নিদর্শন বলেও দাবি করে থাকেন। আমি সেটা মনে করি না। তবে বাংলা ভাষাভাষি নারীর জাগরণে তার ভূমিকা অনেক, এটা অস্বীকার করছি না। তাই বলে তিনি যে নারীবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন সেটা সঠিক (?) বলেও মনে করছি না।
নারীবাদ আন্দোলনটা হতে হবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এই সমাজ ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সমতার সমাজ তৈরিতে জনমত সৃষ্টি করতে হবে। এই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে নারীবাদ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকা প্রতিটি মানুষের। কিন্তু তার লড়াইটা ঘুরে ফিরে পুরুষের বিরুদ্ধে গিয়েই দাঁড়াচ্ছে! যা অনেকটাই ব্যক্তি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। অথচ এই তিনিই স্বীকার করেছিলেন ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’। তার এই কথার রেশ ধরে যদি বলি, তবে বলতে হবে এই দেশে কেবল পুরুষরাই নারী স্বাধীনতার অন্তরায় নয়; পাশাপাশি নারীরাও আছেন। এরা পুরুষতন্ত্রের ধারক বাহক।
শুধুমাত্র পুরুষের বিরুদ্ধে লড়াই করলেই নারীবাদ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। ভাঙতে হবে পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা। আঘাত হানতে হবে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার প্রতি। পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনা যে সঠিক নয়; সেটি ভুল প্রমাণ করে সকলের মাঝে সাম্যতার ঢেউ তুলতে হবে। অন্যথায় নারীবাদ আন্দোলন তথা সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার যে আশা আমরা করছি, সেটি অধরাই থেকে যাবে।
আমি বরাবরই মনে করি নারী-পুরুষের মধ্যে লিঙ্গগত পার্থক্য ছাড়া বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। প্রকৃতির কিছু নিয়ম আমাদের মেনে নিতেই হবে। মেনে নেয়াটাও উচিত। কেননা, প্রকৃতি তার নিজস্ব গতিতেই চলে। তাকে উল্টো রথে ঠেলে দেয়ার শক্তি এখনও আমরা অর্জন করতে পারিনি। সম্ভবও নয়। একইভাবে নারী-পুরুষের মধ্যে লিঙ্গগত যে পার্থক্য সেটি নিশ্চয় আমরা অস্বীকার করতে পারি না।
তাই বলে তুমি নারী আমি পুরুষ আমার দ্বারা এটা সম্ভব তোমার দ্বারা সম্ভব নয়, আমি মাছের মুড়োটা খাবো তুমি খেতে পারবে না, এই কাজ তোমার নয় আমার, এমন বৈষম্যমূলক আচরণ কাম্য নয়। অনেক ক্ষেত্রে নারী পুরুষের অধিকার প্রশ্নে অনেক বৈষম্য রয়েছে। সেটি ঘর থেকে শুরু করে বাহির পর্যন্ত। কেবলমাত্র নারী বলেই আমরা তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি। সকল কর্তৃত্ব একাই ফলাতে চাই। তাদের সিদ্ধান্ত, তাদের কাজের স্বীকৃতি দিতে চাই না। মূলত এগুলোই হচ্ছে বৈষম্য। আর এই বৈষম্য ঘুচিয়ে সমতার সমাজ তৈরির কথাই বলে নারীবাদ।
ষোড়শ শতকে যখন নারীবাদ আন্দোলন শুরু হয়, তখন এর ধারা ছিল একটা। সপ্তদশ শতকে ধারা ছিল আরেকটা। অষ্টদশ শতকে এসে ধারা পরিবর্তন হয়। বর্তমান যে নারীবাদ আমরা পাচ্ছি সেটি মূলত অনেকটাই বিদ্বেষপূর্ণ। বলা চলে নারীবাদ আন্দোলনের মূল স্তর থেকে সরে এসে ব্যক্তি ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে পুরুষের বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধ ঘোষণায় লিপ্ত সাম্প্রতিক সময়কার নারীবাদ আন্দোলন! আদতে এই ধারায় থেকে কখনোই নারীবাদ আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। হয়তো কিছু নারী গর্জে উঠবে। কথা বলবে। এতে তারা ঠিক কতটা সমতা সৃষ্টিতে অগ্রসর হবে, সেটি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
আমাদের শহরের নারীরা নিজ অধিকার সম্পর্কে এখন অনেকটাই সচেতন। তারা চলতে ফিরতে গিয়ে আরও সচেতন হচ্ছে। এদের কানে কানে মন্ত্রপাঠ করে সচেতন করার দরকার আছে বলে মনে হচ্ছে না। তারপরও নারীবাদ আন্দোলনটা অনেকটাই শহর কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও বিশাল একটি গোষ্ঠী প্রান্তিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত। সেসব স্থানে নারী-পুরুষের বৈষম্য প্রকট। সেখানকার নারীরা মোটেও সচেতন নয়। তারা কেউ কেউ নিজ অধিকার সম্পর্কে কিছু জানলেও সেটা কীভাবে প্রয়োগ করবে, তা ঠিকঠাক মতো বুঝে উঠতে পারে না।
নারীবাদ আন্দোলনের সাথে বর্তমানে যারা সম্পৃক্ত তাদেরকে প্রান্তিক নারীদের নিয়ে কাজ করতে হবে। তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। কী কী অধিকার তাদের, সে সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। তবে সব কিছুর আগে তাদেরকে শিক্ষা ও আর্থিকভাবে সাবলম্বী করার উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা আর আর্থিকভাবে কেউ যদি স্বচ্ছল হতে না পারে, তা হলে সে যতই অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোক, তাকে পরাধীনতা মেনে নিতেই হবে। ফলে এই আন্দোলনের মূল হওয়া উচিত নারীর জন্য উচ্চ শিক্ষা এবং কাজের পরিবেশ তৈরি করা। সেটা কেবল নগর কেন্দ্রিকই নয়, প্রান্তিক পর্যায়েও এই জোয়ার সৃষ্টি করতে হবে। পিছিয়ে পড়া নারীদের সামনের দিকে তুলে নিয়ে আসতে হবে।
আবার শুধু নারী কেন্দ্রিক নারীবাদ আন্দোলন হলেই চলবে না। পুরুষদের নিয়েও কাজ করতে হবে। পারিবারিকভাবে তারা পুরুষতান্ত্রিক যে ভুল শিক্ষায় এতদিন শিক্ষিত হয়েছে, সেখান থেকে তাদের ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে। তাদের মধ্যে ধারণা দিতে হবে, তারা এতদিন যা জেনে এসেছে তা ভুল। আমরা বৈষম্য নয়, সমতা চাই। নারীকে নারী ভেবে তুচ্ছ করার কোনো অবকাশ নেই, এই ধারণা তাদের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে। আর এটা করতে পারলে লিঙ্গবৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করার পথটাও সহজ হয়ে উঠবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)