ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পর্যালোচনা ও অবিলম্বে সংস্কার দরকার বলে জানিয়েছেন তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু।
বৃহস্পতিবার ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে বেসরকারি গণমাধ্যম উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান সমষ্টি আয়োজিত ‘সাংবাদিকতা ও নীতি-কাঠামো: প্রবণতা ও সুপারিশ’ বিষয়ক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দী অবস্থায় মারা যান সাংবাদিক ও লেখক মুশতাক আহমেদ। আমি জজকে বলেছিলাম আপনি তাকে কেন জামিন দেন নি। উনিতো সাংবাদিকতাই করেন, উনিতো পালিয়ে যাবেন না। এই আইনে সর্বশেষ পরীমনিকেও জজকোর্ট জামিন না দিলেও পরে হাইকোর্ট জামিন দিয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে অজামিনযোগ্য ধারাগুলো আছে সেটা কিন্তু আদালতের জামিন দেওয়ার এখতিয়ারও আছে। শুধু জজ কোর্ট না অনেক ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টও জামিন দিয়েছে সে তথ্য আমার কাছে রয়েছে।
জাসদ সভাপতি ইনু বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের জন্য নয়, যে কোন সাধারণ নাগরিকের জন্য আইন। এই আইনে দেশের সাধারণ মানুষও গ্রেপ্তার হয়েছে। আইনমন্ত্রী নিজেও বলেছেন কোন সাংবাদিকের ওপর এই আইনে মামলা হলে আগে তদন্ত করে দেখবো পরে গ্রেপ্তার করব। এখন যদি আমি বলি তাহলে দেশের সাধারণ নাগরিকরা কি রাস্তা থেকে ভেসে এসেছেন। তারা দেশের সম্মানিত ভোটার। তাহলে সবার ক্ষেত্রে এই আইন এক কেন হবে না? কেন বৈষম্যমূলক হবে?
তিনি বলেন, দেশের ডিজিটাল জগতের নিরাপত্তার জন্য আইন। ডিজিটাল আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে অনেক ক্রুটি বিচ্যুতি ধরা পড়েছে, এখন এর পর্যালোচনা করে যেখানে ক্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে সেটা সংশোধন করতে হবে। একই অপরাধে অন্য আইনে সাজা তিন বছর আর ডিজিটাল আইনে সাজা পাঁচ বছর। অন্য আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডিজিটাল আইনের পর্যালোচনা করা দরকার ও সংস্কার করা দরকার।
হাসানুল হক ইনু বলেন, আইনটি সংস্কার করতে এতো সময় তো লাগে না, দ্রুত কাজ করে এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সরকারকে আপনারা (সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়) প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। আমি মনে করি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অবিলম্বে সংস্কার করেন, হালনাগাদ করেন ও আধুনিক করেন।
হাসানুল হক বলেন, অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংস্কার ও অফিসিয়াল সিক্রেটস্ অ্যাক্ট বাতিল করতে হবে। প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট হালনাগাদ করে কার্যকর করারও আহ্বান জানান তিনি।
হাসানুল হক ইনু বলেন, গণমাধ্যমকর্মী আইন ও সম্প্রচার আইন দীর্ঘদিন ধরে খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। এগুলো দ্রুত পাশ করা হলে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা আরো সুরক্ষা পাবে। সাংবাদিকদের দক্ষতা উন্নয়নের উপর গুরুত্বারোপ করে সাবেক এই তথ্য মন্ত্রী, সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের সাংবাদিকতার গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বার্ষিক রিপোর্ট প্রণয়নের আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, এ ধরনের রিপোর্ট সরকারকে সাংবাদিকতা বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করবে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুললের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. মফিজুর রহমান ও আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমান। গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সমষ্টি’র পরিচালক (গবেষণা) রেজাউল হক। স্বাগত বক্তৃতা করেন পরিচালক ও সাংবাদিক মীর মাসরুর জামান এবং মীর সাহিদুল আলম।
সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমান বলেন, স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইনগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রস্তাব তিনি গুরুত্বের সাথে জাতীয় সংসদে তুলে ধরবেন।
সমষ্টি’র গবেষণায়, সাংবাদিকতার উন্নয়নগত দিক, প্রভাবক উপাদান এবং নীতি-কাঠামোর প্রবণতাগুলো তুলে ধরা হয়। দলীয় আলোচনা, মতামত জরিপ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে।
এতে দেখা যায়, জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪৬১ জন সাংবাদিকের ৭৯ শতাংশ মনে করেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্বাধীন সাংবাদিকতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। উত্তরদাতা সাংবাদিকদের ৯৪% সাংবাদিক আইনটি সংস্কার অথবা রহিত করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তাদের ৬৫% মনে করেন আইনটিকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করে তথ্য ও মতামত প্রকাশ এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য নেতিবাচক উপাদানগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনমাফিক সংস্কার করা প্রয়োজন, অন্যদিকে ২৯% সাংবাদিক আইনটি সম্পূর্ণ বাতিল করার পক্ষে মত দিয়েছেন। জরিপে অংশগ্রহণকারী সাংবাদিকরা সংসদ সদস্য, সাংবাদিক সংগঠন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ নিয়ে উদ্যোগ নিতে পারে বলে মনে করেন।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সংবাদ প্রতিবেদন থেকে ২৫০টি মামলার তথ্যে দেখা যায়, মাত্র ১৮% মামলায় সাইবার অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। বাকি ৮২% মামলায় অনলাইন মাধ্যম বা সংবাদপত্রে তথ্য বা মতামত প্রকাশের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে। তথ্য ও মতামত প্রকাশ সংক্রান্ত মামলাগুলোতে বেশি অভিযোগ আনা হয়েছে ২৫ ধারায় (৪৮%)। পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে ২৮ ও ২৯ ধারা (যথাক্রমে ১৭.৩১% ও ১২.১৮%)। এছাড়া বহুল ব্যবহৃত অন্য দুটি ধারাগুলো হচ্ছে ২৯ ও ৩১। রাজনীতিক বা রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের নেতারা ৪৬% মামলা করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ২৩% মামলায় বাদী হয়েছেন। অন্যান্য বাদী ছিলেন বিভিন্ন পেশাজীবী যেমন, সাংবাদিক, আইনজীবী, সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, শিল্পী, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, বেসরকারি চাকরিজীবী, ধর্মীয় নেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও বিচারক। মামলাগুলোতে ২০ জন নারীসহ অন্তত ৫৫৪ জনকে আসামি করা হয়। ১৫৩টি মামলায় প্রধান আসামিসহ একাধিক আসামিকে মামলার পরপরই গ্রেপ্তার করা হয়। মামলার বিবাদীদের মধ্যে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি ৩৬%, সাংবাদিক ২৯%, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক ১৪%। বাকিরা ছিলেন বেসরকারি চাকুরে, ধর্মীয় নেতা, ব্যবসায়ী, শিল্পী, আইনজীবী, সরকারি কর্মচারী। অর্থাৎ মোট মামলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মামলায় সাংবাদিকরা অভিযুক্ত হয়েছেন।