ভালোবাসা শব্দটির মধ্যেই কেমন যেন অন্যরকম এক অনুভূতি লুকিয়ে থাকে। মানব হৃদয় নাড়িয়ে দেয়া এ শব্দটি নিয়ে সারা পৃথিবীতে জন্ম হয়েছে অসংখ্য সব ঘটনার। তবে ছোট্ট একটি দিঘিকে নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে গড়ে উঠা ভালোবাসার ঘটনা বিরল। যে দিঘির জল পান করে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের বহু মানুষ বেঁচে থাকে। তা নিয়ে হয় না কোনো লড়াই, কিংবা কোনো সংঘাত।
না, এটা কোনো গল্প নয়, বাস্তব ঘটনা নিয়ে তৈরি হওয়া স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ঝলমলিয়া’র কাহিনী। চ্যানেল আই অনলাইনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে ‘ঝলমলিয়া’ নির্মাণের অভিজ্ঞতা জানালেন চলচ্চিত্রটির পরিচালক সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল।
এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ ঘুরে আসা চলচ্চিত্রটি আগামী ৪ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় পাবলিক লাইব্রেরীকে প্রদর্শন করা হবে।
চ্যানেল আই অনলাইন: বাংলাদেশে ৪ ডিসেম্বর চলচ্চিত্রটি প্রদর্শন হচ্ছে জেনে কেমন লাগছে?
হেলাল: অসাধরণ এক অনুভূতি। অপেক্ষায় ছিলাম নিজের দেশে কবে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হবে সেটি যখন হয়ে গেলো সত্যিই মনের মধ্যে একটি ভালোলাগার কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। আমি আশা করি সবার চলচ্চিত্রটি ভালো লাগবে।
চ্যানেল আই অনলাইন: ‘ঝলমলিয়া’ নির্মাণের জার্নিটা কিভাবে শুরু হয়?
হেলাল: প্রথমে বলতে চাই আমি এটাকে জার্নি হিসেবে নেইনি বরং আমার জীবনের অন্যতম সময় হিসেবে নিয়েছি। তার একটিই কারণ, ছোটবেলা থেকে অামি শহরে বসবাস করেছি কখনো গ্রামে যাইনি। বহু বছর কানাডায় ছিলাম। যখন কানাডা থেকে ফিরে আসি তখন আমার কিছু বন্ধুরা মিলে মংলা বন্দরের দূরে দক্ষিণাঞ্চলের একটি গ্রামে যাই। আমার সঙ্গে ছিলো ক্যামেরা। ওই অঞ্চলে যাওয়ার পর মানুষের সঙ্গে থাকতে শুরু করলাম। সেখানে যা দেখলাম তা এই শহুরে জীবনে দেখা সম্ভব না। আমাদের সে জীবন খুবই যন্ত্রিক, স্বার্থ ছাড়া আমরা একমুহূর্ত কারো কাজে লাগি না। অথচ এই অঞ্চলের মানুষগুলো একটি শাপলা ফোটা দিঘিকে কেন্দ্র করে একে অন্যকে ভালোবেসে বেঁচে আছেন। সেই শাপলা দিঘিকে নিয়েই মূলত ‘ঝলমলিয়া’ নির্মাণ করা।
চ্যানেল আই অনলাইন: ‘ঝলমলিয়া’ নিয়ে দীর্ঘ ছয় বছর ছিলেন, কেমন ছিলো সেই সময়টা?
হেলাল: ঘূর্ণিঝড় আইলার পরবর্তী ছয়টি বছর সময় নিয়ে আমরা চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছি। আইলার পরবর্তী ছয়টি বছর ওই অঞ্চলের মানুষ কিভাবে বেঁচে আছেন, কত কষ্ট করেছেন সেটি তো একসপ্তাহ চিত্রধারণ করে সম্ভব না। আমরা ওখানে দিনের পর দিন থেকেছি দরিদ্র সেই মানুষগুলোর সঙ্গে মিশিছে। এরপর ‘ঝলমলিয়া’ নির্মাণ করেছি। চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় আমরা একটি শূন্য ভিটায় থাকতাম ভাঙ্গা চুলা, খাঁ খাঁ করা চারদিক। সেখানেই নতুন করে সংসার শুরু করেছিলাম। সত্যিই বলতে ওই শূন্য ভিটায় থেকে আমার মন কতটা শান্তি পেয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। শুধু বলতে পারি ওই শূন্য ভিটাকে আমার ভিটে হয়েছে।
চ্যানেল আই অনলাইন: চলচ্চিত্রের নাম ‘ঝলমলিয়া’ হলো কেন?
হেলাল: শাপলা ফোটানো জল খেয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসা হতে পারে তার অন্যতম উদাহরণ ‘ঝলমলিয়া’ দিঘি। এই দিঘিটি ওই অঞ্চলের কোনো এক জমিদারের ছিলো যা অনেক দিন ব্যবহার হয়নি। আইলার পরবর্তী সময় দিঘিতে যখন শাপলা ফুটতো তখন ওই দিঘির পানি ছিলো শুধু মাত্র খাওয়ার উপযোগী। ওই মিষ্টি পানি নিতে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসত। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই এই পানি খেয়ে বেঁচে থাকে। তাদের মধ্যে কখনো ধর্ম নিয়ে লড়াই হয় না, হয় না কোনো সংঘাত। সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে ভালোবাসার বন্ধনে বেঁচে থাকে। তাই দিঘির নাম ছাড়া অন্যকোনো কাল্পনিক নাম আমার চলচ্চিত্রে হতে পারে না।
চ্যানেল অাই অনলাইন: স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিটির মাধ্যমে কোনো বার্তা দিতে চেয়েছেন?
হেলাল: সব পরিচালকরা ছবি নির্মাণ করেন সাধারণ মানুষকে কিছু বার্তা বা শেখানোর জন্য। আমার ছবিটি একটু ব্যতিক্রম তার কারণ আমি ছবিতে কাউকে কিছু শেখানোর জন্য কিছু রাখেনি। বরং ছবিটি করতে যেয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছে। যা আমার পরবর্তী জীবনে অনেক কাজে লাগবে। তবে আমরা শহরে বসে যারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বলে চিৎকার করি তাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে দেখতে হলে ‘ঝলমলিয়া’য় ফিরে যেতে হবে।
উল্লেখ্য, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ঝলমলিয়া ’ The Sacred Water’ আগামী ৩ ডিসেম্বর ১৪তম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রতিযোগীতায় প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
এর আগে আমেরিকার নিউইয়র্কের রাজধানী আলবেনিতে ক্যাপিটাল সিনেমা ফিল্ম ল্যব ফাইনালিষ্ট হয়ে উৎসবে প্রদর্শিত হয় ‘ঝলমলিয়া’। ইউরোপের সবচেয়ে পুরোনো পরিবেশ বিষয়ক ৪২তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ‘ইকোফিল্ম ২০১৬’ প্রতিযোগীতা বিভাগেও প্রদর্শিত হয়েছে সিনেমাটি।
এছাড়া সম্প্রতি কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে ঝলমলিয়া বাংলাদেশের একমাত্র প্রামাণ্যচলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়ে প্রদর্শিত ও প্রশংসিত হয়।