আজ ১২ জানুয়ারি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫ তম প্রতিষ্ঠা দিবস। অনিন্দ্য সুন্দরী এ বিদ্যাজননীর মায়াক্রোড়ে যারা পুনর্জন্ম লাভ করেছেন বা নতুন করে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের সবার জন্য এ দিনটি বিশেষ আবেগও আবেদনের। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ বিদ্যা পীঠের আলো বাতাসে কতজন ঋদ্ধ হয়েছেন তার হিসেব রাখবে মহাকাল। আজ এই শুভলগ্নে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হয়েও সবার সাথে কিছু কথা, অনুভূতি ও পর্যবেক্ষণ শেয়ার করতে চাই।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছাত্র থাকাকালীন যত না বইয়ের পড়া পড়েছি তার চেয়ে বেশি কাজ করেছি ইউএনবি’র হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টারের কাজ। বেপরোয়া কর্মব্যস্ততা আর ভবিষ্যতের ভাবনাহীন বর্তমানমুখর জীবন কেটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। আওয়ামিলীগ বিট এবং সর্বশেষ বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’র প্রেস উইংয়ে বছর তিনেক কাজ করার পর ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে যোগদান করি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে।
রিপোটিং গিয়ে নতুন করে অতীতের মোটামুটি অভিজ্ঞতার আয়নায় প্রতিনিয়ত আমি শিখছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গিয়ে আমি পড়ানো ও পড়াশুনার পাশাপাশি সহকর্মী, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কথাবার্তা, আচরণ ও কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে চলেছি; উদ্দেশ্য নিজেকে দিন দিন একজন কার্যকর শিক্ষককে পরিণত করা। ভেতরের একজন হয়ে অন্যদের মূল্যায়ন করা বা তিন/চার বছরের প্রত্যক্ষ দর্শন দিয়ে পুরো অস্তিত্বকে স্পর্শ ও ধারণ করার প্রয়াস দুঃসাহস ছাড়া কিছু নয়। তারপরও আমি আমার কথা বলতে চাই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এমন একটি সময়ে যখন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিরা একান্তই নিজেদের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শেষ করে এনেছে। পকিস্তান সরকার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি মুসলিম অর্ডিন্যান্স’ ১৯৭০ এর অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করে। পূর্ব-পাকিস্তানের পরিচয় ঘুচিয়ে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু রাজনৈতিক ম্যান্ডেটও এদেশের বাঙালিরা পেয়েছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনেই। ১৯৭০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রসায়নের অধ্যাপক ড. মফিউজ উদ্দিন আহমদ (পিএইচডি, ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়, শিকাগো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত হন।
প্রথম দুই বছর একটি প্রজেক্ট হিসেবে পরিচালিত হওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় চারটি ডিপার্টমেন্ট- অর্থনীতি, ভুগোল, গণিত এবং পরিসংখ্যান নিয়ে যাত্রা শুরু করে। ছাত্র সংখ্যা ছিলো ১৫০ জন। ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর রিয়ার এডমিরাল এস এম আহসান চ্যান্সেলর হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। যতটুকু শুনেছি, মার্চ মাসের ২৫ তারিখ রাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ঢাকার ঘুমন্ত বাঙালি জনগণের উপর ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা শুরু করলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়ের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ও নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে দেশ স্বাধীন হলে পুরো দেশের মত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যায়লও নতুন স্বপ্ন আর উদ্যম নিয়ে অগ্রযাত্রা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর একান্ত আন্তরিক স্নেহে প্রজেক্ট-পর্ব কাটিয়ে উঠে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যায়ল স্বায়ত্বশাসন লাভ করে। পুরনো অধ্যাদেশ বাতিল হয়ে ১৯৭৩ সালে বলবৎ হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আইন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে এ ছায়া সুনিবিড় বিশ্ববিদ্যালয়টি।
আজ ৪৫ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে লিখতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছে, আমি কি মূল্যায়ন করতে বসেছি? নিজের কাছে পরিষ্কার হয়ে নিয়েছি; আমি মূল্যায়ন করছিনা। অম্লমধুর অতীতকে জেনে, স্থিতিশীল বর্তমানকে দেখে ভবিষ্যতের মসৃণতা নিশ্চিত করণে কিছু অনুরোধ করার অধিকার নিশ্চয়ই শিক্ষক হিসেবে আমার আছে।
২০১১ সালের ডিসেম্বরে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার শুরুর অনুভূতির সঙ্গে বর্তমানকে মেলাতে গিয়ে অবাক হই। নতুন পেশা, ছাত্র-ছাত্রী, এত সুন্দর ক্যাম্পাস সব মিলিয়ে দারুণ এক ভালো লাগা। প্রথম দুই/তিন মাস একাডেমিক কাজের বাইরে ক্যাম্পাসের অনেক ছবি তুলেছি। নতুন কলাভবনে নীচতলায় একটি রুমে অফিস। চারজন শিক্ষকের ও চেয়ারপার্সনের অফিস।
ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাসকরে দুপুর ২টার পরে! কারণ এতবড় কলাভবনে তাদের জন্য কোনো ক্লাসরুম নেই। ৬ মাস তারা ক্লাস করেছে দুপুর থেকে। তৎকালীন ভিসি প্রফেসর শরীফ এনামুল কবীর স্যারকেও আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের কথা বলব সেই সুযোগ বা সাহস ছিলনা । নতুন জয়েন্ট করেছি; ভিসির সাথে যে আর্গুমেন্টে যাওয়া যায়, সেটাতো ভাবনায়ই ছিলনা। অন্যান্য বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা চলে গেলে আমার বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়; ছেলে-মেয়েরা ঢাকা থেকে এসে এতিমের মত ঘুরে বেড়ায়। বিভাগের এই অবস্থা; অন্যদিকে দেখি ক্যাম্পাসে একদল ছাত্র ও শিক্ষক ভিসি বিরোধী আন্দোলন করে।
এখানে যোগদানের আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শুনেছিলাম, ভিসি মহোদয় একাডেমিক্যালি খুবই স্ট্রং একজন রসায়নবিদ। শক্ত হাতে প্রশাসন পরিচালনা করে সাফল্য দেখাচ্ছেন। আসার পর জানলাম; আইন অনুষদ, বিজনেস অনুষদ, বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন ও আইটি অনুষদও তার উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত। ভাবতে অবাক লাগে, এত বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে এই গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ বা ইন্সটিটিউটগুলো ছিলনা। যাই হোক, ক্লাসরুম ছাড়া, অফিস ছাড়াই বিভাগের কর্মকাণ্ড এগিয়ে যেতে থাকে। শরীফ এনামুল কবীর বিরোধী আন্দোলনের কারণ, ধরণ, মিডিয়া কাভারেজ সব দেখে আমার বিস্ময় ক্রমশ বেড়েছে।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র জুবায়েরকে হত্যা করে সন্ত্রাসী ছাত্রদের একটি গ্রুপ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যায়ল প্রশাসন সর্বোচ্চ কর্মতৎপরতা দেখিয়ে খুনী ছাত্রদের বিচারের ব্যবস্থা করলেও ভিসি মহোদয়ের তখন শেষ রক্ষা হয়নি। কারণ আমার মতে, কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম। এমনও দেখেছি, ভিসি মহোদয়ের পক্ষে কোনো মানববন্ধন ও মৌন মিছিল হয়েছে; দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক সেই ছবি ভিসির পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলন বলে চালিয়ে দিয়েছে।
মিডিয়া যে বাস্তবতাকে তুলে না ধরে নিজেই একটি বাস্তবতা সৃষ্টি করতে পারে, তার উদাহরণ পরবর্তী ভিসি’র আন্দোলনের সময়ও দেখেছি। ভিসি হিসেবে প্রফেসর আনোয়ার হোসেনের পতনের পর নতুন দায়িত্ব পান প্রফেসর ড. ফারজানা ইসলাম। প্রধানমন্ত্রীসহ পুরো দেশকে সত্য পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করবে গণমাধ্যম। সেই গণমাধ্যমের যদি নিজস্ব এজেন্ডা থাকে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতারা যদি সঠিক খবর মূল অফিসে না প্রেরণ করে তাহলে ক্ষতিগ্রস্থ হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী তথা পুরো বিশ্ববিদ্যালয়। আর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলে ক্ষতি হয় পুরো দেশের।
এমনও হয় যে, ঢাকার কোনো একটি পত্রিকা অফিসে গুরুত্বপূর্ণ পদে এমন অনেকে আছেন যারা ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পুরোনো পক্ষ-বিপক্ষের রেশ ধরে ভিসিদের হয় সহযোগিতা করেন অথবা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সংবাদকে নিয়ন্ত্রণ করেন কিংবা অতিরঞ্জিত করেন। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্যই হোক, ভিসিদের ব্যক্তিগত অপকর্মের জন্যই হোক, একটা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলে পুরো চাপটা চূড়ান্তভাবে গিয়ে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দফতর যদি বিশেষ সেলের মাধ্যমে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আগে থেকে নজর রাখে, তাহলে মনে হয় সংকট সৃষ্টির আগেই সমাধান করা যায়। চার বছরে জাহাঙ্গীরনগরে আমরা তিনজন ভিসি পেয়েছি!
পাকিস্তানের ক্রিকেট টিমের কোচও এত দ্রুত বদলাতে দেখা যায়না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা আজ আর নাই বললাম। এই নেতিবাচক ঘটনাগুলোর বিপরীতে জাহাঙ্গীরনগরে দেখেছি আকাশচুম্বী সম্ভাবনা। সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষার্থীদের মেধা, শিক্ষকদের গবেষণা ইত্যাদি প্রেক্ষিতে আমি এমন কিছু উদাহরণ দিতে পারব যা পুরো জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে। পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আমীর হোসেন ভুঁইয়া ২০১৪ সালের ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্স এর তরুণ বিজ্ঞানী পুরষ্কার জিতেছেন। সার্চ ইঞ্জিন গুগলের গুরুত্বপুর্ণ পদে কাজ করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
গণমাধ্যম, আমলাতন্ত্র, রাজনীতি, খেলাধুূলা হেনো কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরা পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করছেননা। এমন নিরবতা, শান্তি, সৌম্য, বাংলাদেশে আর কোথায় আছে জানিনা। স্থিতিশীলতার পাশাপাশি যদি অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করা যায়, তাহলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা জাহাঙ্গীরনগরকে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের মধ্যেই নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারবে। তিন ভিসিকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি; আন্তরিকতা, পেশাদারিত্ব ও সৃজনশীলতায় তারা স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। সমস্যা তৈরি করে শিক্ষকদের মধ্যেই একটা অংশ।
তারা সংখ্যায় বেশি নন, ৪/৫ জন। শিক্ষকের নাম পাল্টায়, কিন্তু সংখ্যা ও চরিত্র একই রকম থাকে। এরা সারাক্ষণ ভিসিদের সাথে থেকে পুরো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। এ বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নেয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী অথবা এমন কিছু ঘটনা ঘটে যারা পরিণতি হয় চরম অনাকাঙ্খিত। ভিসিরা যদি সবাইকে প্রাপ্য সম্মান দেন, চোখকান খোলা রেখে সাবধানতা বজায় রেখে, উন্নয়নমূলক কাজ অব্যাহত রাখেন তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেজ এবং একাডেমিক কার্যক্রমের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এখন চলুন সবাই মিলে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করি। ব্যক্তিগত, বিচ্ছিন্ন স্বার্থ একাপাশে রেখে প্রতিষ্ঠান ও পুরো পরিবারের কল্যাণার্থে কাজ করি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)