আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা
তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা।
আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি
তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।
উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু সব তোমাদের জানা
আমরা শুনেছি সেখানে রয়েছে জিন, পরী, দেও, দানা।
পাতালপুরীর অজানা কাহিনী তোমরা শোনাও সবে
মেরুতে মেরুতে জানা পরিচয় কেমন করিয়া হবে।
তোমাদের ঘরে আলোর অভাব কভূ নাহি হবে আর
আকাশ-আলোক বাঁধি আনি দূর করিবে অন্ধকার।
আজ ২০ জুন। বেগম সুফিয়া কামাল এর জন্মদিন। তাঁরই রচিত ‘আজিকার শিশু’ কবিতার ছন্দে জন্মদিনে স্মরণ করছি কবিকে।
বেগম সুফিয়া কামাল একটি নাম। একটি ইতিহাস। প্রথিতযশা কবি, লেখিকা এবং নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি ছিলেন মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে এক আপোষহীন নারী। তাঁর কণ্ঠ অন্যায়, দুর্নীতি এবং অমানবিকতার বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার ছিলো।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাজনীতিক, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি কর্মীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। একজন রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়েও শৃঙ্খল ভেঙেছেন তিনি। নারীদের এনেছেন মুক্ত আলোর সন্ধানে। তিনি বলেছেন, ‘তোমার আকাশে দাও মোর মুক্ত বিচরণ-ভূমি,
শিখাও আমারে গান। গাহিব, শুনিবে শুধু তুমি।
মুক্তপক্ষ-বিহগী তোমার বক্ষেতে বাঁধি নীড়
যাপিবে সকল ক্ষণ স্থির হয়ে, চঞ্চল অধীর।’ [ সূত্র: কবিতা-আমার নিশীথ ]
সেকালের সামন্ত জমিদার পরিবারে ‘পুণ্যাহ’ বলে একটা উৎসব অনুষ্ঠান হতো। বেগম সুফিয়া কামালের জন্মও হয়েছিল তেমন একটি উৎসবের দিনে বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদে নানার বাড়িতে ১৯১১ সালের ২০ জুন (সোমবার, ১০ আষাঢ় ১৩১৮ বঙ্গাব্দ, বেলা ৩টায়)।
কবির পৈতৃক নিবাস ছিলো ত্রিপুরা জেলার শিলাউর গ্রামে। মা সাবেরা বানু এবং বাবা সৈয়দ আব্দুল বারি। ডাকনাম ছিল হাসনা বানু। নানী রেখেছিলেন এই নাম আরব্য উপন্যাসের হাতেম তাইয়ের কাহিনী শুনে। সুফিয়া খাতুন নাম রেখেছিলো দরবেশ নানা। তিনিই পরবর্তী কালে সুফিয়া কামাল।
‘একালে আমাদের কাল’ শীর্ষক লেখায় সুফিয়া কামাল তাঁর জন্ম প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মাটিকে বাদ দিয়ে ফুল গাছের যেমন কোনো অস্তিত্ব নেই, আমার মাকে বাদ দিয়ে আমারও তেমন কোনো কথা নেই। আমি জন্ম নেবার আগেই মায়ের মুখে ‘হাতেম তাইয়ের কেচ্ছা’ শুনে আমার নানী আম্মা আমার নাম রেখেছিলেন হাসনা বানু। আমার নানা প্রথম বয়সে সদর আলা থেকে জজগিরি পর্যন্ত সারা করে শেষ বয়সে সাধক-‘দরবেশ’ নাম অর্জন করেছিলেন। শুনেছি যেদিন আমি হলাম, নিজের হাতে আমার মুখে মধু দিয়ে তিনি আমার নাম রেখেছিলেন সুফিয়া খাতুন। কিন্তু আমার ডাকনাম হাসনা বানুটাই আমাদের পরিবারে প্রচলিত। সুফিয়া বললে এখনো কেউ কেউ আমাকে হঠাৎ চিনতে পারেন না। আমার ভাইয়া ছোটবেলায় আমাকে ডাকতেন ‘হাচুবানু’ বলে; কেউ কেউ বলত ‘হাসুবানু’।’
পারিবারিক পরিমণ্ডলে সাহিত্য-পত্রিকা ও গল্প পড়তে-পড়তেই সাহিত্যচর্চার অনুপ্রাণিত হন সুফিয়া কামাল । মাত্র ১৪ বছর বয়সে বরিশাল থেকে ‘তরুণ’ পত্রিকায় ‘সৈনিক বধূ’ গল্পটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। লেখালেখির কাজ সুফিয়াকে লুকিয়ে করতে হয়েছে-বিশেষ করে বাংলা ভাষার চর্চা ছিলো না। সীমাবদ্ধ ছিল আরবি, ফারসি, উর্দুতে। মায়ের ঐকান্তিক সহযোগিতায় সুফিয়া বাংলা বলতে, পড়তে ও লিখতে শেখেন। লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা রচনা করতে-করতেই সওগাতে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ যা সাথে-সাথেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথম গ্রন্থ রচয়িতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যসমগ্র প্রকাশের মাঝে।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে দীর্ঘ চিঠি লিখে কাব্যচর্চায় উৎসাহিত করেন। প্রকৃতপক্ষে ‘সাঁঝের মায়া’ গ্রন্থের ভূমিকাটি তাঁরই লেখা। ১৯৩৮ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতা পড়ে তাঁকে আর্শীবাণী পাঠিয়েছিলেন এই বলে- ‘তোমার কবিত্ব আমাকে বিস্মিত করে। বাংলা সাহিত্যে তোমার স্থান উদ্ধ্বে এবং ধ্রুব তোমার প্রতিষ্ঠা, আমার আশির্বাদ গ্রহণ করো।’
সুফিয়া কামাল মহাত্মা গান্ধীর হাতে তুলে দেন নিজ হাতে চরকায় কাটা সুতা (১৯২৫)। ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলো প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ (১৯২৬)। সামাজিক, পারিবারিক বাধা ভেঙে বাঙালি পাইলট চালিত বিমানে চড়লেন (১৯২৮)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন প্রমুখের প্রভাব ও সহযোগিতায় তাঁর জীবন বিকশিত হয়েছে কৈশোর থেকে তারুণ্যে।
কাজী নজরুল ইসলাম তখন কৃষ্ণনগরে থাকতেন। ইতিমধ্যেই ‘অভিযান’ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি সুফিয়া কামাল সম্পর্কে জেনেছেন এবং পত্রালাপের মাধ্যমে পরিচয়ও হয়েছে। তবে সরাসরি দেখা হয়নি। নজরুল যখন শুনলেন সুফিয়া কামাল কলকাতায় এসে বসবাস করতে শুরু করেছেন, তখন তিনি নিজেই এসে তাঁর সাথে সাক্ষাত করেন। এভাবেই কবি সুফিয়া কামাল কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ লাভ করেন। নজরুলের মাধ্যমেই এক সময় ‘সওগাত’ পত্রিকা ও তার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সময় থেকেই তিনি কবি খান মোহাম্মদ মইনুদ্দিন ও কবি বেনজীর আহমদের সঙ্গেও পরিচিত হন। কবি বেনজীর আহমদের সহযোগিতা ও উত্সাহেই বেগম সুফিয়া কামালের প্রথম কবিতার বই ‘সাঁঝের মায়া’ এবং পরে আরো একটি গ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’ প্রকাশিত হয়।
সুফিয়া কামালের জীবনের আরেকটি স্মরণীয় ঘটনা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য লাভ। তিনি বিশ্বকবির জন্মদিনে একটি কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। এর কিছুদিন পরই পত্রের উত্তর এলো তেমনি আরেকটি কবিতার মাধ্যমে। বিশ্বকবির কবিতা পাওয়া এবং তাঁর সঙ্গে দেখা করার আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি খুবই খুশি হলেন। তারপর একদিন সত্যি সত্যি বিশ্বকবির সঙ্গে তাঁর দেখা হলো। কবিগুরু তাঁকে ‘গোরা’ উপন্যাসটি উপহার দেন। এরপরও তিনি রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাত সান্নিধ্য পেয়েছিলেন একাধিকবার।
সুফিয়া কামাল পর্দানশিন পরিবারের মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে বাল্যকালে তিনি মুক্তাঙ্গনের কোনো বিদ্যাপীঠে গমন করার সুযোগ পাননি। ঘরের মধ্যেই আরবির পাশাপাশি শিখতে শুরু করেন বাংলাভাষা। আর তখন থেকেই শুরু হয়েছিল কবিতা লেখা ও পড়ার ঝোঁক। এ সম্পর্কে তিনি তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন- ‘এমনি কোনো বর্ষণমুখর দিনে মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘হেনা’ পড়ছিলাম বানান করে। প্রেম, বিরহ, মিলন এসবের মানে কি তখন বুঝি? তবু যে কী ভালো, কী ব্যথা লেগেছিল তা প্রকাশের ভাষা কি আজ আর আছে? গদ্য লেখার সেই নেশা। এরপর প্রবাসী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়তে পড়তে অদ্ভুত এক মোহগ্রস্ত ভাব এসে মনকে যে কোন অজানা রাজ্যে নিয়ে যেতো। এরপর দেখতাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন লিখছেন, লিখছেন বেগম সারা তাইফুর। কবিতা লিখছেন বেগম মোতাহেরা বানু। মনে হলো ওরা লিখছেন আমিও কি লিখতে পারি না? শুরু হলো লেখা লেখা খেলা। কী গোপনে, কত কুণ্ঠায়, ভীষণ লজ্জার সেই হিজিবিজি লেখা ছড়া গল্প। কিন্তু কোনোটাই কি মনের মতো হয়! কেউ জানবে, কেউ দেখে ফেলবে বলে ভয়ে ভাবনায় সে লেখা কত লুকিয়ে রেখে আবার দেখে দেখে নিজেই
শরমে সংকুচিত হয়ে উঠি।’
মাত্র সাত বছর বয়সে ১৯১৮ সালে কবির বিয়ে হয় তাঁরই জ্ঞাতিভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অকালেই নেহাল হোসেন মৃত্যুবরণ করলে ১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম জেলার চুনতি গ্রামের কামালউদ্দিনের সঙ্গে কবির দ্বিতীয় বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন।
সুফিয়া কামাল সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি সমাজসেবা ও বিভিন্ন সংগঠনের কর্মকান্ডের সাথে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী জানা যায়- ‘চৌদ্দ বছর বয়সে বরিশালে প্রথমে সমাজসেবার সুযোগ পাই। বাসন্তী দেবী ছিলেন অশ্বিনীকুমার দত্তের ভাইয়ের ছেলের বৌ। তার সঙ্গে দুস্থ মেয়েদের বিশেষ করে মা ও শিশুদের জন্য মাতৃসদনে আমি কাজ শুরু করি।’
সুফিয়া কামাল এই সংগ্রামের বাইরেও নারীদের জন্য চিন্তা করেছেন। খুঁজেছেন নারী জীবনের পরিণতি। এমন কী, প্রকৃতির অকৃপণ সম্পদের প্রকাশ দেখে যখন তিনি মুগ্ধ হন, তখন তাঁর চোখে ভাসে দুটি সত্তার মিলনের স্বপ্ন।
তিনি বলেন, ‘সাঙ্গ হলে সব কর্ম, কোলাহল হলে অবসান, দীপ-নাহি-স্বালা গৃহে এমনি সন্ধ্যায় যেন তোমার আহ্বান
গোধূলি লিখতে আসে। নিঃশব্দ নীরব গানে গানে,
পূরবীর সুরে সুরে অনুভবি তার প্রাণে প্রাণে।
মুক্তি লভে বন্দী আত্মা-সুন্দরের স্বপ্নে, আয়োজনে।
নিঃশ্বাস নিঃশেষ হোক পুষ্প-বিকাশের প্রয়োজন।’ [ সূত্র: সাঁঝের মায়ায় ]
জীবনের পরবর্তী সময়ে সমাজসেবা ও সংগঠনমূলক কাজের বিবরণ সুফিয়া কামাল এভাবে বর্ণনা করেন- ‘প্রথম জীবনে কাজ করার পর আঠার থেকে বিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিষ্ঠিত কলকাতার ‘আঞ্জুমান মাওয়াতিনে’ কাজ করি। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিলো কলকাতার বস্তি এলাকার মুসলমান মেয়েদের মনোভাবে একটু শিক্ষিত করে তোলা। মিসেস হামিদা মোমেন, মিসেস শামসুন্নাহার মাহমুদ, সরলা রায়, জগদীশ বাবুর স্ত্রী অবলা বসু, ব্রহ্মকুমারী দেবী এরা সকলেই ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানে। আমার স্বামী ছিলেন উদার প্রকৃতির মানুষ, এসব কাজে তার কাছ থেকে প্রচুর উৎসাহ পেয়েছি আমি। এরপর ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় বর্ধমানে এবং ‘৪৬-এর ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর বিপন্ন এবং আহতদের মধ্যে কাজ করেছি। এ সময়ই তো হাজেরা মাহমুদ, রোকেয়া কবীর, হোসনা রশীদ ও নূরজাহান মুরশিদ এর সঙ্গে আমার পরিচয় হল। ১৯৪৭-এর পরই ঢাকায় এলাম। প্রথমে ওয়ারি মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠিত করি এবং এ সমিতির মাধ্যমেই কাজ শুরু করি। প্রখ্যাত নেত্রী লীলা রায় আমাকে সমাজকল্যাণের কাজে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানান। এরপর পর্যায়ক্রমে ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে আমি বিশেষভাবে জড়িয়ে পড়ি।’
১৯৩১ সালে সুফিয়া মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রথম ‘ভারতীয় মহিলা ফেডারেশন’-এর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৩-৪১ পর্যন্ত তিনি কলকাতা করপোরেশন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এ স্কুলেই তার পরিচয় হয় প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির এবং কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে। ১৯৪৮ সালে সুফিয়া ব্যাপকভাবে সমাজসেবা ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষার উদ্দেশ্যে শান্তি কমিটিতে যোগ দেন। এ বছরই তাকে সভানেত্রী করে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি’ গঠিত হয়।
১৯৪৯ সালে তার যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সুলতানা’ পত্রিকা, যার নামকরণ করা হয় বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গ্রন্থের প্রধান চরিত্রের নামানুসারে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সুফিয়া কামাল সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর দমননীতির অংশ হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তিনি তার বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানান।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তিনি ‘সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন’ পরিচালনা করেন। ১৯৬৯ সালে ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ (বর্তমানে- ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’) গঠিত হলে তিনি তার প্রতিষ্ঠাতা-প্রধান নির্বাচিত হন এবং আজীবন এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্বাধীনতার পরও সুফিয়া কামাল অনেক সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। তিনি যেসব সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা-প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন সেগুলো হলো; বাংলাদেশ মহিলা পুনর্বাসন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন কমিটি এবং দুস্থ পুনর্বাসন সংস্থা। এ ছাড়াও তিনি ছায়ানট, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন ও নারীকল্যাণ সংস্থার সভানেত্রী ছিলেন।
সুফিয়া কামাল কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত কিন্তু গদ্যলেখক হিসেবেও তাঁর অবদান রয়েছে। বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী ও সচেতন নাগরিক হিসেবে তাঁর ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উজ্জ্বল। তার সময়কালে পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজের একজন মহিলা হিসেবে সীমাবদ্ধ গন্ডি পেরিয়ে ভূমিকা রাখা ছিল শুধু গৌরবের নয়, বিশেষভাবে অসাধারণ বিষয়। সুফিয়া কামাল এক সাক্ষাৎকারে তাঁর বেড়ে ওঠা সময়কালের সামাজিক অবস্থা এভাবে বর্ণনা করেন- ‘তখনকার সময়টাতে শ্রেণীভেদ একটা বড়ো ব্যাপার ছিল। বড়োলোক, ছোটলোক, সম্ভ্রান্ত লোক, চাষী-কৃষক, কামার-কুমার ইত্যাদি সমাজে বিভিন্ন ধরনের বংশ ছিল এবং এইসব বংশে শ্রেণীবিভেদ ছিল। সেই শ্রেণীভেদ অনুসারে বলা যায়, তখন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের ঘরের মেয়েরা পড়ালেখা বেশি জানতো না। তারা বড়োজোর কুরআন শরিফ পড়া শিখতো। আর হয়তো বাবা-মায়ের কাছে দোয়া-দরুদ নামাজ পড়া শিখতো। এই ছিল তাদের শিক্ষা। স্কুল-কলেজের বালাই তো ছিলই না। তবে ধর্মীয় শাসনের একটি প্রক্রিয়া ছিল। সেটা ছেলে-মেয়ে সকলের ওপরই কার্যকর থাকতো।
শোষিত মানুষের সংগ্রামকে তিনি নিজে উপলদ্ধি করেছেন। লড়েছেন অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে। সুফিয়া কামালের কবিতায় তারই চিত্র উঠে এসেছে। তিনি লিখেছেন, ‘এ বাংলার বুকে আজি ফের
তেমনি হত্যার লীলা চলে,
সন্তানের রক্তধারা বাংলা আর সবুজ অঞ্চলে
মুছাইতে পারেনাকো, বয়ে চলে নদী স্রোতধারে
নদী হতে সাগরে সাগরে।
সেই স্রোতধার নিখিল মানবজনে দেয় উপহার।’ [ সূত্র : একত্রিশে চৈত্র, ১৩৭৭ ]
সুফিয়া কামাল পর্দাযুগের মেয়েদের সঙ্গে এখনকার সময়কালের মেয়েদের তুলনা করেন এভাবে, যাতে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও বিবেচনা লক্ষ্য করা যায়- ‘আগে মেয়েরা ষোলআনা নির্ভরশীল ছিল পুরুষের ওপর। স্ত্রী-কন্যার কি প্রয়োজন না প্রয়োজন তা স্বামী বা পিতাই নির্ধারণ করতেন। যেখানে পুরুষ মানুষটি এসব ব্যাপার তেমন মাথা ঘামাতো না সেখানে স্ত্রী-কন্যা নীরবে কষ্ট সহ্য করতো এবং সেই পরিস্থিতিতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতো। এখন আবার যে সব মেয়েদের রোজগার আছে- স্বামীরা তাদের রোজগার কেমন করে খরচ হবে তাও বলে দিতে চায়। আর টাকা পয়সার ব্যাপারে দেখা গেছে মেয়েরা নিজের টাকা যত খরচ করে স্বামীরা ততই হাত গুটোয়। পুরুষদের সম্পর্কে উক্তি আছে ‘তারা হাতে মারে, ভাতে মারে, দাঁতে মারে’ এই অবস্থায় একজন মানুষ সুখী কেমন করে হবে? আর মেয়েদের ক্ষেত্রে কত স্তরের দুঃখ যে আছে তার ঠিক নেই।
তাই তুলনামূলকভাবে কাউকে কাউকে একটু বেশী সুখী মনে হয়। পর্দার যুগে কোন অবস্থাতেই মেয়েটি বাড়ি ছেড়ে পালাতে পারতো না- আজকাল পারে। মেয়েদের স্বামী পরিত্যাগ করার ঘটনাও বিরল নয়। আজকাল মেয়েদের স্বাধীনতা বেশী এবং সেই অনুপাতে নিশ্চয়ই সুখও বেশী। সুফিয়া কামাল নারীর সামাজিক শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তির দিগন্ত উন্মোচন করার জন্য নিবেদিত ছিলেন। নারীর সামগ্রিক মুক্তির জন্য তাঁর ভূমিকা ছিল সমসময়ের জন্য উদ্দীপনামূলক ও আগ্রহোদ্দীপক। সে কারণে তাঁর অনুভতি দেখে আমার ভালো লাগে যে সত্যিই মেয়েরা আগের তুলনায় এখন অনেক সাহসী হয়েছে। মেয়েরা এখন রাস্তায় বেরিয়ে অন্তত নিজেদের কথা বলতে শিখেছে। আমরা চেয়েছিলাম, মেয়েরা কথা বলতে শিখুক, সাহসী হয়ে উঠুক, নিজেদের অধিকার তারা বুঝতে পারুক। এটা এখন হয়েছে। এটা বড়ো আনন্দের।এভাবে তাঁর লেখায় পথ দেখেছেন নারীরা। তাঁর দেখানো পথে আলো ছড়িয়েছে দেশ থেকে সীমানার বাইরে। তাঁর আলোয় আলোকিত হয়েছে দেশ।
উপমহাদেশের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী কবীর সুমন নিজের গানে কবি সুফিয়া কামালকে স্মরণ করে গেয়ে ওঠেন,
‘ওই তো লক্ষ ছেলেমেয়ে,
নাতি নাতনি দামাল
সবুজ দ্বীপের মতো মাঝখানে
সুফিয়া কামাল।’
তবে নারীর স্বাধীনতা সম্পর্কে সুফিয়া কামালের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধগত বিবেচনা ছিল, এ কারণে তিনি নারী স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে নীতি-আদর্শ-ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন, এমনি প্রতিভাস তার বক্তব্য থেকে জানা যায়- ‘মেয়েরা স্বাধীনতা পেয়েছে। কিন্তু অনেকেই সেই স্বাধীনতার ব্যবহার সবসময় সঠিকভাবে করতে শেখেনি। অনেক সময় অপব্যবহার করছে। এটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগে। এই যে মেয়েরা অপ্রয়োজনে বিদেশের ফ্যাশনের হুজুগে নিজেদের সংস্কৃতিবিরোধী কাপড় পড়ছে, ব্যবসায়ী মহল তাদেরকে ব্যবহার করছে নানাভাবে, মেয়েরা ভাবছে এটাই স্বাধীনতা। এটাই অপব্যবহার। মেয়েরা মডেলিং করুক, অভিনয় করুক, কিন্তু তা যেন মর্যাদা হারাবার মাধ্যম না হয়। অযথা অশালীন অভিনয়, যাত্রা, নাচগানের কোনো দরকার নেই। নারীদের যেন কোনো পণ্য না করা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিজ্ঞাপনে মেয়েদের শরীর প্রদর্শন করিয়ে কোটি কোটি টাকা অর্জন করা হচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে। পর্নো ম্যাগাজিনের পণ্য হওয়া মেয়েদের বন্ধ করতে হবে।’
সুফিয়া কামাল রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির কথা ভেবেছেন, অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার বাসনা অনুভব করেছেন। মানুষে মানুষে ভালোবাসা ও সাম্য তার লেখা ও কর্মকান্ডের ভিত্তিমূল হিসেবে কাজ করেছে। দার্শনিক বিবেচনাবোধ থেকে এভাবে তিনি ইতিহাস ও সমাজ বিশ্লেষণ করে বলেছেন- ‘ইতিহাসে বার বার দেখা গেছে, মূঢ়তা এবং হিংস্রতা যখন সীমা অতিক্রম করেছে তখনই তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠেছে- সে নিজেকেই নিজে ধ্বংস করেছে। হয়তো অনেক সুন্দর ও শুভকে এজন্যে আত্মাহুতি দিতে হয়, কিন্তু ভয় এবং হতাশায় নিষ্কৃতি কোথায়?… আরও একটা কথা মানি, আমাদের দারিদ্র্য এবং হতাশার অন্যতম কারণ; জনসংখ্যার অনুপাতে আমাদের সম্পদের অভাব; মানুষের ক্ষুধায় এবং লোভে প্রকৃতি লুণ্ঠিত, শূন্য হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিকারের পথ একটাই : দুঃখের অন্ন সবাইকে একসাথে ভাগ করতে খেতে হবে, তারপর মানুষ ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্যে বিজ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাই সব সমস্যা দূর করতে সক্ষম।
কবি সুফিয়া কামাল দেশকে ভালোবেসেছেন গভীরভাবে। দেশের প্রতি ছিল তাঁর মমত্ববোধ। রচিত কবিতায় সেই ভালোবাসা উঠে এসেছে বারবার। কবিতায় তিনি বলেছেন,
‘অনেক কথার গুঞ্জন শুনি
অনেক গানের সুর
সবচেয়ে ভালো লাগে যে আমার
‘মাগো’ ডাক সুমধুর।’ [ সূত্র : কবিতা, জন্মেছি এই দেশে ]
শুধু কী তাই? দেশের অবহেলিত, নির্যাতিত, শোষিত নারী সমাজের জন্য অন্তরায় অনেক। তাই প্রয়োজন হয় দীর্ঘ সংগ্রামের। তিনি বলেছেন,
‘এ বিপুল বিশ্বারণ্যে লুমুম্বার শোণিত প্রবাহ
ছড়াইল দীপ্তময় পাবক প্রদাহ
জাগরণ! মানবাধিকারবোধ জ্বালা
শহীদের কণ্ঠে বাজে শোণিতাক্ত অপরাজিতার নীলমালা।
আফ্রিকার রাত্রি শেষ। দিগন্তে প্রদীপ্ত সূর্যকর।
অগ্নিবাহু মেলে দিয়ে উদ্ভাসিয়া তুলিছে প্রহর।’ [ সূত্র : লুমুম্বার আফ্রিকা]
তিনি ছিলেন সকলের ‘সাহসিকা জননী’। সারাজীবন ১৬টি সংগঠনের সভানেত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। পদক পেয়েছেন ৩২টি। তাঁর প্রধান প্রধান কবিতাগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে; সাঁঝের মায়া, মায়া কাজল, মন ও জীবন, দিওয়ান, প্রশান্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী, স্বনির্বাচিত কবিতা সঙ্কলন। গল্পগ্রন্থ: কেয়ার কাঁটা, মোর দাদুদের সমাধির পরে। ভ্রমণকাহিনী: সোভিয়েটের দিনগুলো । স্মৃতিচারণ: একাত্তরের ডায়েরী। শিশু-কিশোর রচনা: ইতলবিতল, নওল কিশোর এবং একমাত্র উপন্যাস অন্তর।
তাঁর প্রাপ্ত ৩২টি পুরস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক, সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিন পদক ও চেকোস্লোভাকিয়ার সংগ্রামী নারী পুরস্কার।
সুফিয়া কামাল এমনই একজন ব্যক্তিত্ব এত অল্প কথায় তাঁর সংগ্রামী জীবন ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। চারিত্রিক শক্তিতে তিনি একক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বি। তিনি সকলের মাঝে ধ্রুবতারা। বিংশ শতাব্দীর বাংলার নারী জাগরণ এবং বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের বিচিত্র ইতিহাসের সঙ্গে কবি সুফিয়া কামালের নাম নিবিড়ভাবে জড়িত। সময়ের দাবিতে ব্যক্তিগত জীবনের মতো তিনি স্বপ্ন দেখতেন সবুজ পৃথিবীর। ৮৯ বছর বয়সে ২০০০ সালের ২০ নভেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সুফিয়া কামালের ১০৪তম জন্মবার্ষিকী ও ১০৫তম জন্মদিনে কবির ’পথ নহে অন্তহীন’ কবিতার দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছি,
প্রসন্ন প্রভাতে আজি যাত্রা শুরু কর হে কাফেলা!
সম্মুখে আলোকদীপ্ত বেলা।
দূর পথ প্রসারিত, দিকে দিকে চঞ্চল জীবন।
আঁধার নির্মোক হতে কর উন্মোচন
গতিময় দৃপ্ত প্রাণাবেগ,
ভেদ করি সংশয়ের মেঘ
চলো চলো যাত্রাপথে, সম্মুখে অনন্ত সম্ভাবনা!
পথে পথে যদি দেয় হানা
খল মুষিকের দল, তবু চলো চলো হে কাফেলা!
তোমারে দেখাবে পথ দীপ্ত রাঙ্গা উদয়ের বেলা।
আবারও নামিবে রাত্রি, তবু দ্বিধা করিয়ো না আর,
রুদ্ধ করিয়ো না গতি, লক্ষ্য দৃঢ় রাখিয়ো তোমার
মনযিল-ই-মোকসেদে তুমি উপনীত হবে একদিন,
দুর্বার রাখিয়ো গতি! পথ কভু নহে অন্তহীন।
লেখক: সালমা আহমেদ, ব্যাংকার, আলোকচিত্রী ও খন্ডকালীন শিক্ষক
Salma.ahmed79@yahoo.com