এতো রাতে আপনাকে বিরক্ত করার কোন ইচ্ছে ছিল না। আমি সত্যিই দুঃখিত স্যার।
শাড়ির আঁচল টেনে কিছুটা জড়সড় হয়ে শুধু যে দুঃখিত বলল তা কিন্তু নয়। কথার ষোলআনা সত্যতা মেয়েটির চোখে মুখে ফুটে উঠলো।
মমতা আরো বলল, কলেজের একটি ছাত্রীকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিতে আসবেন এটা ভাবতেও পারিনি।
পূরবীকে ফোন করেছিলাম। সে পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু তার মাথায় চট করে আপনার নাম চলে এলো।
আমাকে বলল, কেউ যদি এই মুহূর্তে সাহায্য করতে পারে সেটা হলেন আপনি। জানেন, আমি কিছু বলার আগেই সে ফোন কেটে দিল।
জানি না সেই-কি আপনাকে ফোন করেছিল কিনা?
শ্রী শ্যামল কুমার ব্যানার্জি একজন বাংলার অধ্যাপক। খুবই স্বল্পভাষী মধ্য বয়সী একজন লোক, যাকে মমতা তার কলেজ জীবনের প্রথম দিনেই দেখেছিল। কিছুটা ধরা গলায় তিনি বললেন, তুমি একটা অসুবিধার মধ্যে পড়েছ। এতো রাতে পুলিশ স্টেশনে একটা মেয়েকে মানায় না।
আমার আসতে কোন অসুবিধা হয়নি। জানতো আমার কোন গাড়ি নেই।
কলেজের অধ্যাপকদের কি সেটা মানায়? তাছাড়া মাসের শেষ। নাহলে একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসতাম। ট্রামে এলাম তাই একটু দেরি হয়ে গেল আর কি।
মমতাকে যে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে আসা হয়েছে সেটার ইন-চার্জ হলেন একজন মহিলা। তার দয়াতেই মমতা দু’চারটা ফোন করতে পেরেছিল। সেই মহিলার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে মমতা পুলিশ ফাঁড়ির সিঁড়িতে এসে ভাবছে ছাড়া তো পেলাম এখন যাবো কোথায়!
কই এসো। অনেক দূর যেতে হবে। তাও পুরোটাই হেঁটে। রাত দশটার পর এ মহল্লায় বাস ট্রাম কিছুই ঢুকে না। বল, তোমার ভালবাসার কথা বল। পথে নেমে যদি দেখি পথ আর ফুরাচ্ছে না তখন না হয় অন্যকিছু শুনবো। আপাতত তুমি তোমার ভালবাসার গল্প বলো।
আচ্ছা তোমাকে থানায় আসতে হল কেন? ও মনে পড়েছে, ছেলেটির বাবা তোমাকে জব্দ করেছে।
কী যেন নাম বললে?
ওহ হ্যাঁ মনে পড়েছে, রাহুল। তা রাহুলের বাবা মা তোমাকে মেনে নিতে রাজি হল না কেন?
কী যে হয়েছে আমার। সবকিছু ভুলে যাই। থাক তোমাকে বলতে হবে না। মনে পড়েছে। উঁচু নিচু ভেদ। তাছাড়া ধর্মটাও ভিন্ন। তুমি কালো, সেটাও মেনে নিতে পারেনি। তোমার বড় ভাই জেল খাটছে। রাহুলের বাবা ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসের বড় অফিসার। ঘুষ খেতে খেতে ডিস্ট্রিক মাজিস্ট্রেটের চেয়ে বড় বাড়ি বানিয়েছে। তোমার ভাইকে তিনি জেলে পাঠিয়েছেন। ইচ্ছে করলে তোমার বাবাকেও জেলে দিতে পারে উৎকোচের অভিযোগ তুলে, তাই না?
স্যার, আপনিতো জানেন আমার বাবা নেই। আমি যখন ছোট ছিলাম নৌকা ডুবিতে হারিয়ে যান। মা এখন নতুন সংসার করছে কলকাতার বাইরে। দাদা জেলে যাবার পর থেকে আমি কাকার কাছে আছি। কলেজে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কিছু পার্ট টাইম কাজ করি তাতেই চলে যায়। বাকিটা কাকা দেন।
শাড়ির আঁচল টেনে চটি পড়া পায়ে টুকটুক করে হাঁটছে মমতা। কখনো কিছুটা আগে কখনো খানিকক্ষণ পাশাপাশি হেঁটে চলছেন শ্যামল কুমার ব্যানার্জি।
রাহুলের সাথে আজ আমার অনেক দূরে চলে যাবার কথা ছিল। সীমান্ত পেড়িয়ে বাংলাদেশের যশোর জেলার কোন এক গ্রামে। আমি মুসলমান। ওখানে গেলে কিছু একটা করে বেঁচে থাকতে পারতাম। ও যে কোলকাতায় কিছুই করতে পারবে না তা ভালো করেই জানতাম। ভীষণ ভীরু প্রকৃতির ছেলে। তবুও আমাকে হারাতে চায় না।
ওই জিদ করলো। আমাকেও শেষ পর্যন্ত রাজি করাল। অথচ যা ভেবেছিলাম তাই হলো।
সে বাস স্ট্যান্ডে আসার আগেই ওর বাব মা টের পেয়ে যায়। বাসস্ট্যান্ডে তাই ওর সাথে এলো ওর বাবা। শুধু ওর বাবাই নয় একজন পুলিশও নিয়ে এসেছিলেন তিনি।
আমি কিন্তু স্যার ওকে অনেক বুঝিয়েছি। আমরা গরীব। তার উপর বাঙ্গাল। ওদের চৌদ্দ পুরুষ ইন্ডিয়ান। অনেক বুঝিয়েও তাকে সরাতে পারছিলাম না। সে বলতো বড়লোক আমার বাবা। আমি এখনো ছাত্র। যদি বাবার টাকা পয়সা না ধরি তবু কি হাত ছেড়ে দিবে? ওর ভালোবাসার কথাগুলো খুব ভালো লাগত, তারপরও বুঝেছিলাম নিজস্ব শক্তি বলে ওর কিছু নেই।
মনে হতে পারে মমতা নামের মেয়েটি অনেক বেশি কথা বলে। আসলে তা ঠিক নয়। সেও খুব স্বল্পভাষী। এই যে এতগুলো কথা হলো তা কিন্তু সে গড়গড় করে বলেনি। বলেছে নিঃশ্বাস নিয়ে নিয়ে। অনেকগুলো কদম ফেলেছে আনমনে। কখনো শহরের দিকে তাকিয়ে, কখনো পথের উপর পড়ে থাকা আবর্জনাকে পাশ কাটিয়ে। আবার কখনো আড় চোখে তার শিক্ষক শ্যামল কুমার ব্যানার্জির দিকে তাকিয়ে। যেমন, ছোট্ট একটা রাস্তা পার হতে যতটুকু সময় দাঁড়াতে হয় ওরা এখন সেরকম একটা ফুটপাথের উপর দাঁড়িয়ে আছে।
কোন মেয়েকে নিয়ে ওর নামে গল্প নেই। মেয়ে পটানো স্বভাবের না। তবে খুবই ভীরু।
স্বাধীনভাবে চলতে পারে না। বাবার পয়সা ছোবে না শুধু মুখেই বলে কিন্তু সংসারের বাইরে কিছুই চেনে না। আমি নাকি তার কাছে স্বর্গের পরী।
বয়সে আমার সমান। অথচ কথা বলে বাচ্চাদের মত। দিনের বেলায় জ্যোৎস্নার কবিতা শোনায়। যখন তখন আইসক্রিম খেতে চায়। মেরুদণ্ড সোজা হতে অনেক দেরি। কোনকিছু বুঝতে চাইতো না।
অনবরত গাড়ির বহর আসছে। মনে হয় এইমাত্র আশেপাশের কোন লাল বাতি নিভে সবুজ হয়েছে। তাই ওরা রিস্ক নিয়ে পথের অন্যপাশে আসতে সাহস পাচ্ছে না। এমনি একটি সময়ে শ্যামল কুমার ব্যানার্জি বলেন, আচ্ছা বলতো তোমাকে যে ওর বাবা পুলিশে ধরিয়ে দিল তাতে কি তুমি অবাক হয়েছ?
লাজুক অধ্যাপক এখন মনে অনেক শক্তি নিয়ে কথা বলছেন। তিনি যে এতো কিছু জানেন সে কথা মমতা কেন অন্য অনেকেই হয়ত বিশ্বাস করবে না। তা নাহলে কি করে বললেন এই ভেদাভেদের জগতে আরো অনেক কিছুই সম্ভব। তোমাকে বাসে তুলে দিয়ে বাস কন্ডাকটরকে বলতে পারতো তোদের ফূর্তি শেষ হয়ে গেলে গলা টিপে ডোবায় ফেলে দিস। তুমি এ যাত্রায় বেঁচে গেলে।
তা তুমি তোমার বান্ধবীকে বুদ্ধি করে ফোন করেছিলে বলেই আমাকে এই বিপদের সময় কাছে পেলে। কী মনে করে যেন একদিন আমার ফোন নম্বরটা চেয়ে নিলো সে। বলেছিল রবীন্দ্রনাথ বুঝতে একদিন ফোন করবে।
চল, রাস্তাটা পার হয়ে নেই। একটু জোরে পা ফেল। এটাই সর্বশেষ বড় পথ। ও হ্যাঁ, তোমার এই বান্ধবীই আমাকে বলেছিল রাহুল এবং তোমার কথা। কেন বলেছে তা বুঝতে পারিনি। হয়তো আমার কিছু কথাও শুনতে চেয়েছিল।
আমি কী বলবো বলো। না তাকেও কিছু বলিনি। তবুও মনে হল সে সবকিছু বুঝে ফেলেছে।
কোন কিছু না বলতেই যে মেয়ে সবকিছু বুঝে ফেলে সে কেন রবীন্দ্রনাথ বুঝবে না! কথাটি বিশ্বাস হল না। তবু সে ফোন নম্বরটা নিয়ে গেল। বলেছিল খুব দরকার না হলে কাউকে নম্বরটা দেবে না। বোধ হয় তোমাকেই ইঙ্গিত করেছিল।
ধুতিটা উঁচু করে হাঁটছিলেন অধ্যাপক শ্যামল ব্যানার্জি। সেটাকে এবার ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তা পূরবী তোমাকে ছুটিয়ে নিতে এলোনা কেন? আমাকে ফোন না করে নিজে এলেই পারতো। মনে পড়েছে। তুমি একটু আগেই বলেছিলে সে পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত।
একটু দেখে চল। পথে অনেক কাদা। কতদিন হয়ে গেল, কত দরখাস্ত গেল বিধান সভাতে। হয়তো বছর দশের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো ইহ জনমে আর ঠিক হবার নয়।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে একটা লাইট পোস্টের নিচে এসে দাঁড়ালো। এই পোস্টের উপর অনেকগুলো বাতি জ্বলছে। স্বচ্ছ আলো। মমতাকে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখতে গিয়ে আর চোখ সরাতে পারছিলেন না শ্রী শ্যামল কুমার ব্যানার্জি। কী মলিন চেহারা। হতাশা আর লজ্জায় মাথা কাঁটা গেলে যেমন দেখতে হয় ঠিক তেমনি লাগছে ওকে। কত স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশে গিয়ে নতুন সংসার গড়বে। আয়ের সাথে ব্যয়ের অসঙ্গতি নিয়ে আজীবন যুদ্ধ করে সংসার চালাবে। অথচ হাত ছেড়ে ছেলেটা ওকে পথে রেখে গেল।
মমতা লক্ষ্য করলো শ্যামল বাবুর অপলক দৃষ্টি। কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে আঁচল নিয়ে জোরাজুরি করলো। মমতাকে সবসময় শাড়িতেই দেখেছেন অধ্যাপক শ্যামল ব্যানার্জি। আজকাল মেয়েরা অনেক ধরনের পোশাক পরে কিন্তু বাংলার এই অধ্যাপক সব মেয়েদের দেখেন রবীন্দ্রনাথের নায়িকাদের মত করে।
আচ্ছা কলেজের প্রথম দিনের কথা তোমার মনে আছে? আমি চক দিয়ে ব্লাকবোর্ডের উপর কী যেন লিখছিলাম। সবুজ পাড়ের সাদা শাড়ি সাথে হাত খোপা করে তুমি ক্লাসে এসে ঠুকলে। আমকে প্রণাম করলে। আমি উত্তর দিতে ভুলে গেলাম। আমার হাত থেকে চক পড়ে গেলে সকলে হেসে দিল। তুমিও বাদ গেলে না। আমি ভুল করে আঙ্গুল দিয়ে ব্ল্যাক বোর্ডের উপর লিখতে শুরু করে দিলাম। আবার সকলে হেসে দিল।
মনে পড়ে সেদিনের কথা? তারপর থেকেই দেখছি ওই ছেলেটির সাথে তোমার বন্ধুত্ব। ওর সাথে চকচকে গাড়িতে উঠে যেতে ক্লাসের পর। সকলে বলেছিল তোমাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যাবে। ধর্ম ভেদ বলে নয়। ছেলেটির বাবা বেশ বদ এবং ক্ষমতা রাখে। আমি বলতাম ভেঙ্গে যাবে, সে কবে?
এবার শিক্ষকের সাথে ছাত্রীর চোখাচোখি হল। ওদের একজন গলা পরিষ্কার করল। মৃদু একটা কাশি দিল। অন্যজন অপলক চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। এরা একসাথে কেউ কোন কথা বলেনি। একজন বলে তো অন্যজন শোনে। মাঝে বিস্তর এক বিরতি। সেই বিরতিতে রাতের নির্জনতা ওদের দুজনের মধ্যে ঠুকে যায়। সাথে সাথে হেটে চলে পথ।
আকাশে যেমন মাঝে মাঝে কিছু মেঘ উড়ে আসে তার থেকেও অনেক ধীরে ওরা এগিয়ে আসে অনেকটা পথ। বেশির ভাগ সময় পুরো পথে দুজনেই চুপ অথবা অন্ধকার দেখলে খুঁজে নেয় কোন ল্যাম্পপোস্টের আলো।
কলিকাতার অখ্যাত এক মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক শ্রী শ্যামল কুমার ব্যানার্জি তার ছাত্রীকে বললেন, ওই যে দেখছ জানালার পাশে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন তিনি আমার মা।
দেখতে দেখতে কতটা পথ এসে গেলাম কিছুই টের পেলাম না। মা হয়তো প্রতিদিনের মত তার খেদের কথা তুলবেন না আজ। আজ হয়তো তিনি অনেক খুশি হবেন। ভুল করে তোমাকে আশীর্বাদ করেও দিতে পারেন। হয়ত ধান দূর্বা দিয়ে ঘরে তুলে নেবেন। তা তুমি দেখ আর নাইবা দেখ।
এমনও বলতে পারেন, শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে বউ নিয়ে এলি বাবা! হয়তো সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই চাবির গোছাটা তোমার আঁচলে তুলে দেবেন। তুমি সে সবের কিছুই দেখবে কিনা জানি না।
অধ্যাপক শ্যামল কুমারের ছাত্রী চোখ তুলে সামনের জানলাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। কোথাও কোন ছায়া দেখতে পেল না। সবই পুরানো দালান কোঠা। ইংরেজ আমলে গড়া। মনে হয় একজন মিস্ত্রীই সবগুলো বাড়ি বানিয়েছে। হাতে হাত ধরে বাড়িগুলো যৌবন কাটিয়ে এখন পড়ন্ত বেলায় এসে দাঁড়িয়েছে। ওরা হয়ত ধ্বংস হবে একই সাথে। পুরানো বলে রঙও মুছে গেছে। এখন ওদের সব রঙ একই রকম লাগে।
আবার কথা ভেসে আসে খুব কাছ থেকে। মমতা শুনতে চেষ্টা করে তার শিক্ষকের কথা। কিন্তু এবার ওর চোখ থাকে পথের উঁচু নিচু ডোবার দিকে। একবার পা পড়ে গেলে সাড়ে সর্বনাশ। এক শাড়িতে বেড়িয়ে এসেছে। শেষে সেটাও পরবার অযোগ্য না হয়ে যায়।
জান মমতা! আমার মা তোমার নামও জানতেন। আমার মুখে শুনেছেন চৌদ্দবার। গেল চৌদ্দ মাস ধরে তার হাতে মাইনে তুলে দিতেই তিনি আমার বিয়ের কথা বলতেন। তুমি যেদিন আমার ক্লাসে এলে, আশ্চর্য লাগে জান! সেই প্রথম তিনি বিয়ের কথা তুলছিলেন।
কি করে জানলো যে আমার একটি নতুন ছাত্রী এসেছে। যে মেয়ে সাদা শাড়ি পরে এবং হাত খোঁপা করে। তিন কখনো কলেজে যাননি। কেউ কখনো কলেজ থেকে বাড়িতেও আসেনি। শুধু কার্তিক ছাড়া।
তুমি মুসলিম ঘরের মেয়ে তাই কার্তিক সাহস করে মাকে কিছু বলতে পারেনি। কি যেন বললে ছেলেটির নাম। মনে পড়েছে রাহুল।
একটু দেখে চল, এই যে আমার বাড়ি। মানে এখানেই আমি থাকি। দয়া করে আজ রাতে মায়ের ধান দূর্বা নিয়ে আর প্রশ্ন তুলোনা। যা বললাম মনে কর তার কিছুই বলিনি। মায়ের জায়গায় মা থাকবেন। তার ব্যাপারে উৎসুক না হলেই চলবে।
শুধু একটি রাত বইতো নয়। আগামীকাল তুমি চলে যাবে। কাল থেকে তিনি আবার জানালার পাশে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। ওটাই তার নিয়তির লেখা। বলতে পার আমিও প্রতিদিনের মত আগামীকাল কলেজের ক্লাস শেষ করে যাব টালিগঞ্জে টিউশনি করতে।
একটু হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি। তবুও বলেই চলছেন, তারপর পত্রিকা অফিসের প্রুফ দেখার কাজ। রাতে যখন বাড়ি ফিরবো ঠিক দশটায়। তখন তিনি কি বলবেন জান! বলবেন, মানুষ ভালবাসবে মানুষকে। জাত ধর্ম কি আজকাল কেউ মানে। মমতা মুসলিম ঘরের মেয়ে তাতে কি হয়েছে। মেয়েটাকে নিয়ে আয় গিয়ে। সবসময় তার মুখে এই একই কথা।
হাঁটতে হাঁটতে এই পর্যায়ে ওদের আবারো চোখাচোখি হল। হঠাৎ চলা থেমে গেল। নীরবতা ভেঙ্গে অধ্যাপক তার ছাত্রীকে বললেন- এই, একটু দেখে চল। সিঁড়িগুলো বেশ উঁচু।
মমতা ভেবেছিল সিঁড়ির গোঁড়ায় কেউ এসে হয়ত অপেক্ষা করবেন। মমতা কাউকে না দেখে বলে, কাউকে তো দেখছি না। মা দুয়ার খুলে দেবেন ভেবেছিলাম, মা কোথায়? প্রশ্নটি না করলেই ভাল হতো। শ্রী শ্যামল কুমার ব্যানার্জির ঘোর কেটে গেল। খুব ধীর লয়ে বললেন, তিনি স্বর্গলাভ করেছেন দু’সপ্তাহ হল। এ নিয়ে আর কোন কথা না বললেই ভালো।
পুরানো দিনের ঘোরানো সিঁড়ি। ধাপে ধাপে যেন মোড় বদলে যায়। নিচুতে তাকালে অনেক বেশি প্যাঁচানো, সমনে তাকালে অনেকগুলো শুষ্ক কাঠের দরজা। সব ঘরের বাতি নেভানো। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে খুব সকালে উঠবে বলে। দুএকটা ঘর থেকে গানের সুর ভেসে আসছে। রেডিও টিভি হবে হয়ত। ওরা তখন উপড়ের তলায় চলে এসেছে। নিচের তলার শেষ ঘরটি থেকে একটি বাচ্চার কান্না ভেসে এলো। এই শিশুটি প্রতিদিন রাতে কাঁদে। একবার থামে আবার শুরু করে। হয়ত পেটে বড় রকমের অসুখ আছে ওর।
তুমি ভেতরে গিয়ে বস, আমি কার্তিকের বউকে ডেকে আনি। আজ রাতে সে তোমার সাথে ঘুমবে। আর আমি কার্তিকের ঘরে। বড় রাস্তার ওপারের তিনটি বাড়ির পরের বাড়িটাতে কার্তিকরা থাকে। ওকে তো চেন তাই না? তোমাদের সাইকোলজির শিক্ষক।
মমতা তিনতালার একটি ফ্ল্যাটের ভেতর একা একা দাঁড়িয়ে থাকে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে অগোছালো একটি ঘর। ধুলার স্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে ছোটোখাটো বইয়ের সমুদ্র। ঘরের দেয়ালে অন্য কোন ছবি নেই শুধু মালা জড়ানো একটি ছবি। সম্ভবত ওটাই মা হবেন।
ঘর দেখা শেষ করে এক সময় দুজনে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আবার জোড়া ভেঙ্গে মমতা একটু এদিক ওদিক হাটে। জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে কিছু একটা খুঁজতে চেষ্টা করে। হয়তো লুকিয়ে থাকা কোন ছায়া। আবার চলে আসে সেই আগের যায়গায়। শ্যামল কুমার মোটেও নড়েন নি তাই দুজনে আবারো খুব কাছাকাছি। মুখোমুখি।
মমতা বলল এই ফ্ল্যাটের নাম কেন মমতা ভিলা রেখেছেন? তাও আবার বড় বড় অক্ষরে বাইরে টানানো।
ও কিছু না, সব বাড়িরই একটি নাম থাকে। ভাবলাম আমার ফ্ল্যাটটাও তো একটা বাড়ি। কী নাম দেই কি নাম দেই বলতেই মা বললেন ‘মমতা ভিলা’।
আমি বললাম মানে কী? তিনি বলেছিলেন দেখ আমার ছেলের বুদ্ধি। কলেজের মাস্টার তাও মমতা নামের মানে বুঝে না। এরপর হা হা হা করে হেসেছিলেন। সেটাই তার শেষ হাসি। এরপর তাকে আর হাসতে দেখিনি।
মমতা খালি পায়ে আর একবার পায়চারি করে দেখতে লাগল। মনে হল যেন কত দিনের চেনা ঘর। কিছু জিনিস হাত দিয়ে স্পর্শ করলো।
শ্যামল কুমার জিজ্ঞেস করলেন, কী যেন নাম ছেলেটির? মমতা কাছে এসে এক হাত দিয়ে মুখ চেপে বলল আর একবারও ওর নাম মুখে আনবেন না।
ঠিক আছে আনবো না। তুমি বস। আমি কার্তিকের বউকে…
না, এতো রাতে আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। এখানে এসে বসুন। এই বলে যেখানে ধুলোর পাহাড় সেখানেই বসিয়ে দিল তাকে। মনে হল এক গাদা ধুলো উড়ে গেল পায়রা ডানায় চড়ে।
মমতা ভিলার দরজার চাবি এরপর থেকে ভেতরেই থাকে। ঘরের চাবি বাইরে নিয়ে যেতে হয় না। রবীন্দ্র ভক্ত একজন শিক্ষক অনেকগুলো প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন শুষ্ক কাঠের দরোজার সামনে। শুধু হাত স্পর্শে খুলে যেতে তা ভেতর থেকে। সেই ভেতর ঘরে সাজানো বইয়ের পাহাড় আর কিছু চরণ স্পর্শ।
এরপর অনেকগুলো মাস পেরিয়ে গেল। দশটার আগে শ্রী শ্যামল কুমার ব্যানার্জির তখনো বাড়ি ফেরা হয় না। তবে বড় রাস্তা পেরিয়ে এলে তার কোন ক্লান্তিও থাকে না। জানালার পাশে ছিপছিপে একটি কাল ছায়া দেখে তার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। তখন চোখের ওপর বসে থাকা গোল চশমাটার অস্তিত্ব সন্ধান করে একগাল মিষ্টি হাসি নিয়ে চলে আসেন বাকীটা পথ।
ওর জানালার ভেতরকার ছায়াটি অনেক বছরের চেনা তবে পূর্বের থেকে ভিন্ন। মমতা ভিলার দক্ষিণ দিকের জানালাতে ড্যাফোডিলের মত যাকে হেলে দুলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় সে দাঁড়িয়ে থাকে রাত দশটার অনেক আগের থেকে। কিংবা ওখানে থেকে সে কখনো নড়েচড়ে না। একটি ছিপছিপে ছায়া স্থায়ী হয়ে যায় মমতা ভিলায়।
তবে অনেকে বলেছে ওখানে কোন ছায়া দাঁড়িয়ে থাকে না। সবটাই প্রফেসরের বাড়াবাড়ি। সাইকোলজির শিক্ষক কার্তিক এ ব্যাপারে কিছুই বলে না। সে তার বন্ধুর খুশিতেই খুশি। সেই ছোটবেলার বন্ধু ওরা। বলা যেতে পারে জানের জান বন্ধু।