সিলেটের মেয়ে খাদিজাকে প্রকাশ্য দিবালোকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে প্রায় মেরে ফেলার ঘটনায় বাংলাদেশের বিবেকবান কিংবা বিবেকহীন সব মানুষের মধ্যেই ভিন্ন হলেও বিশেষ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কেউ চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছেন, কেউ দৃশ্য দেখে সহ্য করতে না পেরে দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন, কেউ আবার দ্রুত রিমোট চালিয়ে অন্য কোন বিনোদন চ্যানেলে শান্তি খুঁজেছেন।
যারা বেশী সক্রিয় তারা বাস্তবের রাস্তায় মিছিল মিটিং, মানববন্ধন করে সন্ত্রাসী বদরুলের কড়া শাস্তি দাবি করেছেন। আওয়ামের একটা অংশ আবার রাষ্ট্রীয় কিংবা পরলোকীয় আদালতের বিচারের অপেক্ষায় না থেকে নিজেরাই ডেভিল বদরুলের প্রাপ্য আঘাত কিঞ্চিৎ ফিরিয়ে দিয়েছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সচেতনতা প্রকাশের সুযোগ নিয়ে আমাদের মত কিছু লোক বদনকিতাবে পোস্ট দিয়ে নিজের কর্তব্য সাড়া হয়ে গেছে ভেবে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছেন। সমাজবিজ্ঞানীরা টেলিভিশন টক শো, ক্লাশরুমে লেকচার দিয়ে সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব সেরেছেন।
নাগরিক সাংবাদিকের কল্যাণে কোপানোর ভিডিও থাকায় প্রমাণ সংগ্রহের কাজে খুব কষ্ট করতে হবে না বলে পুলিশও বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছে, বদরুলের বিচার হবেই হবে। নাগরিক সাংবাদিকতার শক্তিতে এমন ভিডিও পেয়ে মূলধারার গণমাধ্যমও বেশ বাহাদুরি দেখাচ্ছে।
ওদিকে হাসপাতালে বাঁচার এবং বাঁচানোর লড়াই জারি রেখেছেন আমাদের দুঃখিনী খাদিজা আর তাঁর চিকিৎসকরা। আঘাতের গভীরতা এবং ভয়াবহতা দেখে ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন, খাদিজার বাঁচার সম্ভাবনা ৫ থেকে ১০ শতাংশ। খাদিজা সুস্থ হয়ে তাঁর বাবা-মা, ভাইবোন, বন্ধুদের মাঝে ফিরে যাক, এই দোয়া চলছে সব জায়গায়।
সব আঘাত, পাল্টা আঘাত, রক্তপাত, রক্ত প্রদান, মরা-বাঁচাকে ছাপিয়ে যেন একটা প্রত্যয় আমাদের মাঝে প্রধান হয়ে উঠেছে। সেটি হল “ছাত্রলীগ”। নিউজ হচ্ছে, ‘ছাত্রলীগ’ প্রত্যয়কে ফোকাস করে। বদরুলের নৃশংসতা, তার মগজ, মনন, দুই হাতে ধরা চাপাতি, খাদিজার অসহায়ত্ব, ভয়াবহ আঘাতসমূহ, রক্তে ভেসে যাওয়া, দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাওয়া স্বার্থপর মানবকূল, খাদিজার বাঁচা-মরা, ডাক্তারদের প্রাণান্ত চেষ্টা সব যেন গুরুত্ব হারিয়ে গৌণ হয়েছে একটা শব্দের কাছে। সেটি হল ‘ছাত্রলীগ’।
বদরুলের সব পরিচয় যেন তার ‘রাজনৈতিক পরিচয়’র কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে। আর এক্ষেত্রে মুখ্য ভুমিকা পালন করেছে “সমাজের দর্পণ” কিংবা রাষ্ট্রের “চতুর্থ” স্তম্ভ হিসেবে বিশেষ স্থান অধিকার করে রাখা প্রতিষ্ঠান গণমাধ্যম।
‘সংবাদ রসায়ন’ বলে একটা বিষয় আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ ক্লাসে পড়িয়েছেন। শিক্ষকগণের মুখে আমরা আরও কিছু প্রত্যয় বারবার শুনে থাকি। যেমন- বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা, বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি। আদতে অনেকক্ষেত্রে প্রচারমাধ্যমের কাজ করে চললেও আমাদের ‘সংবাদ মাধ্যম’গুলো নিজেদের গণমাধ্যমের পরিচয় দিতে গৌরববোধ করে। কিন্তু পরিচয় তো প্রতিষ্ঠিত হবে কর্ম দিয়ে। একটা ঘটনা তার নিজস্ব উপাদানের শক্তিতে সংবাদ হয়ে উঠার কথা। অন্তত আমাদের স্যারেরা এটাই আমাদের শিখিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে একটা ঘটনা আদৌ সংবাদ হয়ে উঠবে কিনা, সংবাদ হয়ে প্রকাশ পেলেও কতখানি বড় বা ছোট হয়ে প্রকাশ পাবে, এই সংবাদ কাহিনীর শব্দ, ভাষা, ছবি কী হবে তার পুরোটাই নির্ধারণ করেন একজন রক্তমাংসের তৈরি মানুষ। এই মানুষটি একটা পরিবার, সমাজ থেকে উঠে আসা। যার রাজনৈতিক দলীয় পরিচয় হয়তো নাই, কিন্তু নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন, অনুরাগ, বিরাগ বা নেতিবাচক ভাবে বললে পক্ষপাতদুষ্টতা থাকতে পারে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের “পক্ষের” কিংবা মুক্তিযুদ্ধের “বিপক্ষের” থাকতে পারেন। সাংবাদিক যেহেতু চূড়ান্ত বিচারে একজন মানুষ, তারও দেখার বা বোঝার ভুল থাকতে পারে। প্রতিদিন না দেখেই কত সাংবাদিক নিউজ করে দিচ্ছেন!
একজন নাগরিক সাংবাদিক যদি খাদিজাকে কোপানোর দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ না করতেন, ফেসবুক বা ইউটিউবে না দিতেন, তাহলে সাংবাদিক পরিচয়ে যারা সমাজের “বিবেক” বলে সমাজ এবং রাষ্ট্রে বিশেষ সুবিধা নিয়ে আছেন, তারা কতখানি বস্তুনিষ্ঠতার স্লোগান দিতে পারতেন? আবার স্ব স্ব হাউজের রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে সংবাদ রসায়ন চর্চা করতে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন উপাদানকে একসাথে করে চালিয়ে দেয়ার যে ‘কৌশল’ সাংবাদিকদের রপ্ত করতে হয়, সেখানেই বা বস্তুনিষ্ঠতার দাবি কতখানি যুক্তিযুক্ত।
মিডিয়া যে নানা কৌশলে একটি ভাবাদর্শকে আন্ডারমাইন করে আরেকটি বিশেষ ভাবাদর্শকে ইতিবাচকতার মোড়কে বারংবার উপস্থাপন করে মানুষের মগজ ধোলাই করতে পারে, সেই শক্তিও আজ অনেকের কাছে অজানা নয়। মিডিয়া এতই শক্তিশালী যে, সে নিজেই একটা বাস্তবতা ক্রিয়েট করতে পারে। যে বাস্তবতায় আমরা পুরো আফ্রিকা’কেই আমরা বলে দিচ্ছি, “অন্ধকার” মহাদেশ বলে। কিংবা টুপি, দাড়িওয়ালা সবাইকেই “জঙ্গি” বলতে আমাদের অসুবিধা হচ্ছে না। সন্ত্রাস করছে একজন মানুষ বা সংগঠন, কিন্তু মিডিয়া আমাদের সামনে পুরো দর্শনকেই “সন্ত্রাসী”, ‘জঙ্গিবাদী’ বলে চালিয়ে দিচ্ছে।
ফলে আমাদের চেতনা বা জ্ঞান যে অনেকাংশে ‘মিথ্যা চৈতন্য’ হিসেবেই থেকে যাচ্ছে সেটি আমাদের জনপ্রিয় সংস্কৃতির মানুষ বুঝতে পারছে না। যার জন্য আমাদের তথাকথিত “ভালো” ছেলে-মেয়েরা ফেসবুকে অবলীলায় লিখতে পারছে, “আই হেইট পলিটিক্স”। ছাত্র রাজনীতির সুফল ভোগ করেও আমরা অবলীলায় বলে দিচ্ছি, ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে হবে, শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্ররা মারামারি করে রাস্তাঘাটে আর অতি বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদ বা বুদ্ধিজীবীরা মারামারি করে সংবাদপত্রে, জার্নালে বা টেলিভিশনের টক শো’তে। ছাত্রলীগের পরিচয়ধারী কোন সন্ত্রাসী বা অপরাধীর সাথে ‘ছাত্রলীগ’ প্রত্যয় কে অবলীলায় সুকৌশলে ট্যাগ করে দেয়ার এই বিশেষ কৌশল “ভাবাদর্শীক” আধিপত্যবাদ বিস্তারের কৌশল ছাড়া কিছু হতে পারেনা।
ছাত্রলীগের সবাই “ফেরেশতা” নয়, আবার ছাত্রলীগের সবাই “শয়তান”ও নয়। বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজের একটা বড় অংশই যেখানে ভোগবাদ ও দুর্নীতিপরায়ণতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে আরাম আয়েশের তালে আছে, সেখানে শুধু “ছাত্রলীগ” সব ভালো’র আধার হবে সেটা ভাবা কি একটা নৈতিক অপরাধ নয়?
সরকারি অফিসগুলোতে প্রতিদিন যারা ঘুষের টাকায় টেবিলের গোপন ড্রয়ার পূর্ণ করছেন, তারা কি ছাত্রলীগের কেউ? যে প্রকৌশলীরা অবকাঠামো নির্মাণ/মেরামতের নামে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হচ্ছেন তারা কি ছাত্রলীগ? বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক প্রগতির নামে যৌনাচার করে, যথাযথ ভাবে ক্লাস, পরীক্ষা, গবেষণা না করে পেশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, তিনি কি ছাত্রলীগ? এদেশের নানা খাস জায়গা দখল করে যারা নিজেদের সাম্রাজ্য বাড়িয়ে চলেছেন এরা কি ছাত্রলীগ? সচিবালয়ে যারা প্রতিদিন নানা বাণিজ্য করতে যান, তারা সবাই কি ছাত্রলীগ? ঢাকার যানজট, অব্যবস্থাপনা কি ছাত্রলীগের তৈরি করা? কালো টাকার মালিকদের সাথে থেকে, তাদের কাজ করে দিয়ে যে সাংবাদিক ঢাকা শহরে আজ গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন তিনি কি ছাত্রলীগ?
ওয়ান ইলেভেনের সময় দেখেছি, ছাত্রলীগের মত সংগঠন ক্যাম্পাসে না থাকলে কী হয়? ‘প্রগতিশীল’ নামের বহু সংগঠনের নেতাকর্মী স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে বসে মধুর ক্যান্টিনে চা খেয়েছে, সিগারেট ফুঁকেছে। কিছু বললে শুনতে হয়েছে, “আমরা আদর্শ দিয়ে শিবির কে রুখব।”
স্বাধীনতা বিরোধীরা যখন আপনার হল, মসজিদ, ডিবেট ক্লাব, মধুর ক্যান্টিন দখল করতে এসেছে, তখন এই আদর্শবানদের পালিয়ে যেতে দেখিছি। ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে জয়বাংলা বলে শ্লোগান দেয় বলেই অনেকে “বিপ্লব দীর্ঘজীবী” হোক বলে রাতে হলে ঘুমাতে যেতে পারেন।
আগেই বলেছি, ছাত্রলীগের পরিচয়ে যারা আছেন তাদের সকলে ফেরেশতা নন । এখানে ধান্দাবাজ যেমন আছে বহু, আবার পড়ালেখা করা, প্রজ্ঞাবান, আদর্শবান, সৎ ছেলের সংখ্যাও কম নয়। আমিতো বলব ভালো ছেলেদের সংখ্যাই বেশী, না হলে তো বদরুলদের দিয়েই দেশ ভরে যেত। ছাত্রলীগ করে বলে চাকরি হচ্ছেনা, এমন ছেলের সংখ্যা শত শত। ক্যাম্পাসে, হলে যারা ফাও খায়, তারা সবাই কি ছাত্রলীগ, যারা এখানে সেখানে নেশাদ্রব্য খেয়ে বেড়ান, তারা সবাই কি ছাত্রলীগ।
আমি বহু ছাত্রলীগের ছেলেকে চিনি, যারা টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার খরচ জোগাড় করেন। আমাদের সমাজের সবাই যেমন সাফ নন, ছাত্রলীগেরও সবাই কলঙ্কিত নন। ভালো-মন্দ মিলিয়ে সমাজ, ছাত্রলীগও এই সমাজের, এই দেশের সংগঠন।
আমাদের পূর্বপুরুষদের সবাই যদি, “ভালো ছেলে” সেজে শুধু পড়ালেখা আর চাকরির ধান্দা করে বাঁচার কৌশল নিতেন তাহলে এদেশ তো দূরের কথা, আমাদের ভাষার অস্তিত্বই থাকত কিনা, নিজেকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। শুধু স্টার জলসার নাটকে বুঁদ না থেকে ইতিহাস পড়ুন, দেখবেন ছাত্রলীগ আপনার ভালো লাগবে।
ছাত্রলীগের যারা নেতৃত্বে আছেন, তাদের কাছে অনুরোধ থাকবে, আপনারা বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন সত্য বলে গেছেন। বদরুল বা অন্য কোন বদ ছেলে যদি অন্যায় করে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে এবং এই শয়তানদের কেউ যদি ছাত্রলীগের কেউ হয়ে থাকে, তাহলে আপনারা দায়িত্ব নিবেন এবং দায়িত্ব নিয়ে এদের নির্মূলে কাজ করবেন। মনে রাখবেন, অন্যায় বা ভুল অস্বীকার করে আপনারা শুধু রাজনৈতিক এবং সুশীল প্রতিপক্ষকেই ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ব্যবস্থা করে দিবেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)