আক্রান্ত বাড়ছে। বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। সাধারণ ছুটির এই পর্যায়ে এসে দেশের করোনা পরিস্থিতি যথেষ্ট অস্থির। যদিও সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরছেন প্রচুর রোগী। কিছু অব্যবস্থাপনা সত্ত্বেও চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রম এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে এরই পাশাপাশি নতুন নতুন এলাকায় সংক্রমণও থেমে নেই। ফলে উদ্বেগের নিরসন সহজে হচ্ছে না। প্রশাসন অভয় দিলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে শঙ্কা কাটছে না।
এ কথা ঠিক, কোনও বৃহৎ কাজে সব কিছু নিখুঁত, পরিপাটি হওয়া এক প্রকার অসম্ভব। করোনা নিধনের বিশাল যজ্ঞেও এটা প্রযোজ্য। সর্বোপরি এ রকম পরিস্থিতি মোকাবিলার কোনও অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রস্তুতির সুযোগও ছিল না। এটা শুধু আমাদের দেশ নয়, কম-বেশি সব দেশের ক্ষেত্রেই সত্যি।
কিন্তু খোদ রাজধানীতে সরকারি ও বেসরকারি করোনা-হাসপাতালে কোভিড পরীক্ষা, পরীক্ষার ফল জানানো, ভর্তির ডামাডোল থেকে শুরু করে রোগীদের পরিচর্যার বিষয়গুলো নিয়ে কিছু কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, অভিযোগ ও সমালোচনা ক্রমশ যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, প্রশাসনের পক্ষে তা স্বাস্থ্যকর নয়। ফলে সরকারের সব রকম প্রয়াস ও সদিচ্ছা ছাপিয়ে একটা নেতিবাচক ধারণা সমান্তরালভাবে কাজ করে চলেছে।
সাধারণভাবে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ চিরকালীন। দুর্নীতি, দলবাজি, এক শ্রেণির চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর কাজে গাফিলতি, রোগী বা পরিজনদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা থেকে শুরু করে নানা ধরনের অভিযোগ হাসপাতালগুলোর ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরেই ছিল, এখনও আছে। কোথাও তার প্রকাশ বেশি, কোথাও কম। পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোর একাংশের বিরুদ্ধেও অতিরিক্ত ‘ব্যবসায়িক’ মনোবৃত্তি, চিকিৎসায় অবহেলা, ঔদ্ধত্য প্রদর্শন, পরীক্ষার যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ে থাকা প্রভৃতি অভিযোগ দীর্ঘ দিন ধরে প্রায় রোজনামচা হয়ে উঠেছে। সেই সবের সংখ্যাও খুব নগণ্য নয়। এ সব মিলিয়েই আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা!
যদিও সম্প্রতি সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা বেশ কয়েকটি বেড়েছে। বাইরের হতশ্রী চেহারাগুলোতেও প্রলেপ পড়েছে। চিকিৎসার খরচ কমানো, সুলভে ঔষধ জোগানো, রোগীদের যথাযথ সেবা পাওয়ার সুযোগ কি বেড়েছে? বেশবাস বদলালেই কি স্বভাব রাতারাতি বদলায়? আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় মুশকিলটা মূলত হয়েছে এইখানে।
বছরের পর বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে যে ধরনের সমস্যা বা অভিযোগের কথা শোনা যায়, এখনকার অভিযোগগুলো তার থেকে চরিত্রে খুব কিছু আলাদা নয়। রোগী জায়গা পেতে নাকাল হবেন, শয্যার পাশে কারও বাড়ানো হাত থাকবে না, দশ বার ডাকলে এক বার এক জনের দায়সারা উত্তর মিলবে বা মিলবেই না, ডাক্তাররা পাশ কাটিয়ে কিংবা নিজেদের আড়ালে রেখে কর্তব্য সারবেন- এ সব কি খুব অচেনা? ঘটনা হলো, সর্বত্র সমান না হলেও বহু ক্ষেত্রে এটাই আজও পরিচিত ছবি। হঠাৎ জাদুমন্ত্রে সব পাল্টে যেতে পারে না।
তবে করোনা-সঙ্কটে হাসপাতাল-নির্ভরতা এখন এক নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। আতঙ্কময় পরিস্থিতিতে হাসপাতালগুলোর উপর চাপ যেমন কয়েক গুণ বেড়েছে, তেমনই মানুষের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত হয়েছে স্বাস্থ্য অবকাঠামোর উপর। মরণ-বাঁচন যাদের হাতে এবং যে রোগ থেকে মুক্তির নির্দিষ্ট পথ এখনও অজানা, সেখানে হাসপাতালগুলোকেই তো সাধারণ মানুষ আঁকড়ে ধরবে। এটাই স্বাভাবিক।
আবার এটাও সঙ্গত, এই পরিস্থিতিতে সেখানে যে কোনও ধরনের অব্যবস্থা, অবহেলা, বিচ্যুতি, ভুলভ্রান্তি সাধারণ সময়ের তুলনায় অনেক গুণ বড় হয়ে দেখা দেবেই। সেটা রোগীদের বেলাতেই হোক বা রণাঙ্গনে যুদ্ধরত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের ক্ষেত্রেই হোক। মূল বিষয়টি আলাদা নয়। করোনা চিকিৎসার হাসপাতালগুলোতে ধরা পড়া যে কোনও ছিদ্র সেই কারণেই এক-একটি গহ্বরের চেহারা নিচ্ছে। যদিও ছিদ্র নয়, আমাদের হাসপাতালগুলোতে গহ্বরের খোঁজই মিলছে!
একথা হয়তো ঠিক যে, কোনও সরকারই চায় না তার শাসনামলে দলে দলে লোক ভুগে মরুক, বিনা চিকিৎসায় বা অবহেলায় মরুক! এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টির সরকারে খুব একটা প্রভেদ নেই। তাই রোগী মোকাবেলার পরিকাঠামো যার যতটা আছে, তিনি প্রাণপণে ততটাই কাজে লাগাতে চাইবেন। কিন্তু সিস্টেমের ভিতরে যদি নানাবিধ ফাঁক, গলদ, অদক্ষতা, অপারগতা জমাট বেঁধে থাকে, সদিচ্ছা বা নীতি তখন কোথাও এসে ধাক্কা খেতে বাধ্য। সরকারের প্রায়োরিটি বদল হলেও মন্ত্রী-আমলাদের চাওয়া, না-চাওয়া সেখানে হার মেনে যায়।
তবে ক্ষমতায় থাকলে দায় বইতে হয়। বর্তমান সরকারকেও বইতে হচ্ছে। ক্ষোভ, অভিযোগ অনুযায়ী অবস্থা সামলানোর চেষ্টা যে একেবারে নেই, তা বলা যাবে না। সঙ্গে আছে রাজনীতিও, যা এই প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য অঙ্গ। শাসক, বিরোধী সবাই এর অংশীদার এবং জনগণ তার নিরুপায় ভুক্তভোগী!
যদিও ‘জনগণ’ অর্থাৎ আমাদের ভূমিকা এই অবসরে একটু ভেবে দেখার মতো! বিরোধিতা এবং পারস্পরিক সমালোচনায় আমরা যতটা সরব ও সক্রিয়, নিজেদের করণীয়টুকু পালনের ক্ষেত্রে কি ততটা সচেতন আমরা? করোনা যুদ্ধে আমাদের দায়িত্ব আমরা ঠিকঠাক পালন করছি তো? বিপদ বাড়িয়ে তোলার মতো কোনও কাজ আমরা করছি না তো? এই আত্মসমীক্ষাটিও আজ খুব জরুরি।
হাসপাতালের বেহাল দশা আমাদের বাকরুদ্ধ করছে। সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে কাজ করে চলা চিকিৎসক, নার্সদের অভাব-অভিযোগের কথা জেনে আমরা প্রতিবাদ করছি। একদম উচিত কাজ। কিন্তু পরিহাস হলো, নিজেদের বেলায় কর্তব্যের প্রাথমিক পাঠগুলোই আমরা ভুলতে অভ্যস্ত! তাই ‘লকডাউন’-কে কার্যত বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, সামাজিক দূরত্বের বিধিনিয়ম পায়ে মাড়িয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে দলে দলে বেরিয়ে পড়ি আমরাই। বাড়ি যাবার জন্য, একটু সুখের সামগ্রী সংগ্রহের জন্য, ঘরের বাইরে বের হবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি আমরাই।গাড়ি নিয়ে রাস্তায় দুটো চক্কর দিতে, একটু হাওয়া খেতে অনেকেই বেড়িয়ে পড়ি। পুলিশ আটকালে মিথ্যাচার ও ছলের আশ্রয় নিতে আমরা একটুও পিছপা হই না। কে আমাদের রুখবে!
তবে বলতে দ্বিধা নেই, এখনও প্রতিদিন অন্তত বিশ-ত্রিশ হাজার টেস্ট করতে না পারা, টেস্ট করাতে সীমাহীন ভোগান্তি লাঘব করতে না পারা, করোনা পরীক্ষার ফল সময় মতো জানাতে না পারা, হাসপাতালে রোগী ভর্তির নৈরাজ্য কমাতে না পারা বা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি যেমন চরম ব্যর্থতা, পাশাপাশি আমাদের অপরিণামদর্শী ও বেপরোয়া সব কার্যকলাপ তার চেয়ে কম অন্যায় নয়। কারণ, এভাবেই প্রতি দিন ঝুঁকির বহর বাড়িয়ে তুলছি আমরা অর্থাৎ ‘প্রতিবাদী’ জনগণ।
সাধারণ ছুটি চলাকালীন এই সব খণ্ডচিত্র আগামী দিনে আরও বড় আশঙ্কার ইঙ্গিত। কারণ আগামীতে পর্যায়ক্রমে সব কিছু আবার চালু হবার পরেও সাধারণ কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে আমরা কে কত দূর সতর্ক থাকব, এ সব থেকেই সেটা কিছুটা বোঝা যায়। পুলিশ দিয়ে কত দূর মানানো সম্ভব, সেটিও এক বড় সামাজিক প্রশ্ন। কারণ গত দুই মাসে ‘লকডাউনে’ কোথাও বজ্রআঁটুনি, কোথাও ফস্কা গেরোর উদাহরণ বিস্তর! তাই সবচেয়ে বড় হলো আমাদের সচেতনতা। সেই বোধ আচ্ছন্ন থাকলে কোনও প্রশাসন, কোনও পুলিশ কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না।
আর আস্তে আস্তে কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত সাবধানতা ও নিয়মনীতি মেনে চলাতেই অভ্যস্ত হতে হবে। অনেক রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা যেমন টিকে আছি, করোনার সঙ্গেও সেভাবেই টিকে থাকতে হবে। যেমন- হাইপারটেনশন, ডিসফাইব্রিনোলাইসিস, ডিসলিপিডিমিয়া, টাইপ-টু ডায়াবেটিস, কার্ডিয়োভ্যাস্কুলার ডিজিজ, অ্যাবডোমিনাল ওবেসিটি, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম, কোলেস্টেরল গলস্টোন্স, স্লিপ ডিজঅর্ডারস, কয়েক ধরনের ক্যানসারেরও তেমন প্রতিষেধক নেই। এসব রোগের মুখেও তো আমরা টিকে আছি। করোনার ক্ষেত্রেও তাই-ই হবে।
এখন বরং স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হোক, স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে সক্ষম ও কার্যকর করা হোক। সরকারি স্বাস্থ্য পরিসেবার গলদগুলোকে দূর করা হোক। চিকিৎসক/স্বাস্থ্যকর্মীদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম শ্রেণি নিয়োজিত থাকবেন কেবল কোভিড-১৯ চিকিৎসায়, দ্বিতীয় শ্রেণি অসংক্রামক নানা ব্যাধির চিকিৎসায় আর তৃতীয় শ্রেণিকে ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত রাখা হোক। কোভিড হাসপাতালকে আলাদা করে, বাকি হাসপাতালকে অসংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য খুলে দেওয়া জরুরি। কারণ কোভিডের থেকে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুহার বহুগুণ বেশি। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেছেন, কোভিড চিকিৎসকদের হাতে পোর্টেবল ‘আলট্রাসাউন্ড’ মেশিন তুলে দিলে খুব সহজে তারা ফুসফুসের ‘এ’ আর ‘বি’ লাইনের চলন দেখে রোগীর অবস্থা বুঝে চটপট ব্যবস্থা নিতে পারবেন। তেমন ব্যবস্থা করা হোক। আপাতত ভ্যাকসিনের বাইরেই চিন্তাভাবনা করতে হবে। যেদিন ভ্যাকসিন তৈরি হবে সেদিন আমরা না হয় রাতভর উল্লাস করব!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)