চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

কলাকোপা-বান্দুরার ঐতিহ্যের পাশে ‘মিনি কক্সবাজার’ মৈনট ঘাট

রাজধানী থেকে বেশ কাছে ‘মৈনট ঘাট’ ভ্রমণপিপাসুদের হালের ক্রেজ। কক্সবাজারের দুধের স্বাদ মৈনটের ঘোলে মেটাতে দল বেঁধে ঘুরতে যান অনেকে। ইতিমধ্যে ‘মিনি কক্সবাজার’ নামে পরিচিতি পেয়েছে মৈনট ঘাট। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ না থাকলেও পদ্মার যে ঢেউ আছে, তা মন ভরিয়ে দেয়।

যারা মৈনট ঘাট ঘুরতে যান, তারা সাধারণত ঢাকা থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে ইছামতীর তীরে নবাবগঞ্জ উপজেলার কলাকোপা, বান্দুরা ও হাসনাবাদ ঘুরে আসেন। প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিশাল সাক্ষী হয়ে কলাকোপা-বান্দুরার স্থাপনাগুলো এখনও দাড়িয়ে আছে।

নদীমাতৃক দেশে নদীর পাশেই ছিল সব ব্যবসা-বাণিজ্যের তীর্থস্থান, ইছামতী নদীর পাড়ে ওই জনপদ সে কথাই যেনো জানান দেয় পর্যটকদের।

দিনে গিয়ে দিনে ঘুরে আসার সুবিধার কারণে ছুটির দিনসহ অন্যান্য দিনগুলোতে মৈনটমুখী পর্যটকদের ভিড় থাকে কলাকোপা, বান্দুরা, হাসনাবাদ আর কার্তিকপুরে অবস্থিত মৈনট ঘাটে। দিনে দিনে সব জায়গা দেখতে চাইলে ঢাকা থেকে সকাল ৭টার মধ্যে বের হওয়া উচিত। কারণ বাবুবাজার ব্রিজের জ্যাম ও জিঞ্জিরা-নবাবগঞ্জের লোকালয় পেরোতে যে সময় লাগবে, তা মাথায় রাখা দরকার।

মৈনট ঘাট

যারা ঢাকা থেকে রওয়ানা হবেন, তারা গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজার পেরিয়ে ১০০ গজ সামনে সরাসরি মৈনট ঘাটগামী ‘যমুনা ডিলাক্স’ ও কলাকোপা-বান্দুরাগামী ‘এন মল্লিক’ পরিবহনের বাস সার্ভিস পেয়ে যাবেন। যারা সরাসরি মৈনট ঘাটে যাবেন তাদের যমুনা পরিবহনেই উঠতে হবে। কলাকোপা-বান্দুরা নামতে হলে ওই দুই পরিবহনের যেকোনো গাড়িতে উঠলেই হবে। গাড়ির স্টাফদের বলে রাখলে তারা জায়গামতো নামিয়ে দেবে।

কলাকোপা

কোকিল প্যারি জমিদার বাড়ি
কোকিল প্যারি জমিদার বাড়ি

কলাকোপার দর্শনীয় স্থানগুলো খুবই কাছে কাছে। পর্যটকদের বাস থেকে কোকিল প্যারি স্কুলের সামনে নামিয়ে দেয়া হয়ে থাকে। নেমেই রাস্তার ওপারে এক সারিতে কোকিল প্যারি জমিদার বাড়ি, উকিল বাড়ি ও জজ বাড়ি (জমিদার ব্রজেন সাহার ব্রজ নিকেতন)।গাছের ছায়ায় ভাঙ্গা বৌদ্ধ মন্দির

কোকিল প্যারি জমিদার বাড়ির সামনের মাঠে প্রচুর গাছ লাগানো হয়েছে। গাছের ছায়ায় ভাঙ্গা বৌদ্ধ মন্দির পেরিয়ে কোকিল প্যারি জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়িতে কোকিল প্যারি হাইস্কুলের শিক্ষকদের বসবাস।

কোকিল প্যারি জমিদার বাড়ি
কোকিল প্যারি জমিদার বাড়ি

উঁচু বারান্দায় উঠে ছবি তুলতে কোনো সমস্যা নেই, তবে দোতলায় উঠতে ও ভেতরে যেতে অবশ্যই অনুমতি নিতে হয়। যেহেতু শিক্ষকগণ পরিবার নিয়ে বাস করছেন, তাই যথাসম্ভব ভেতরে যাওয়া এড়িয়ে চলেন দর্শনার্থীরা।

আনসার ক্যাম্পের ভেতরে জমিদার বাড়ি
আনসার ক্যাম্পের ভেতরে জমিদার বাড়ি

কোকিল প্যারি জমিদার বাড়ির পাশ দিয়ে যে গ্রাম্য পথ চলে গেছে, তার শেষ প্রান্তে আনসার ব্যাটেলিয়ানের অফিস। সেখানে দেখতে পাবেন আরও কয়েকটি জমিদার বাড়ি, যদিও তা সংরক্ষিত এলাকা। ইছামতীর তীরে দাড়িয়ে দূর থেকে ওই জমিদার বাড়ির সঙ্গে ছবি তুলে স্বাদ মেটাতে হবে। আশেপাশে আছে লোকনাথ সাহার বাড়ি, তেলিবাড়ি, পাইন্না বাড়ি, পোদ্দার বাড়ি, কালীবাড়ি।

আনসার ক্যাম্পের ভেতরে জমিদার বাড়ির পাশে বসার জায়গা
আনসার ক্যাম্পের ভেতরে জমিদার বাড়ির পাশে বসার জায়গা

এর বাইরেও অনেক পুরোনো ভবন ও মঠ চোখে পড়বে কলাকোপা-বান্দুরায়। কলাকোপার কাছে সামসাবাদ তাঁতপল্লি, এর একটু দূরে আলানপুর তাঁতপল্লি।

ইছামতি নদীর তীড়ে ধ্বংসপ্রায় ঘাট
ইছামতি নদীর তীড়ে ধ্বংসপ্রায় ঘাট

আনসার ক্যাম্পের ভেতরের স্থাপনাগুলো দেখে একদম শেষপ্রান্তে ইছামতি নদী। নদীর পাড়েই আনসারদের একটি রেস্তরা আছে। ওখানে গাছের ছায়ার নদীর তীড়ে বসার জায়গা আছে। অনেকে জমিদার বাড়ির ভাঙ্গা ঘাটে গোসলও করেন। ভ্রমণ ক্লান্তি এড়াতে রেস্তরায় চা-নাস্তা শেষ করে অন্যান্য দর্শনীয় স্থান দেখতে বের হয়ে গেলে ২/৩ ঘন্টার মধ্যে কলাকোপা-বান্দুরা ও হাসনাবাদের পুরোটা দেখা হয়ে যাবে।

উকিল বাড়ি
উকিল বাড়ি

ক্যাম্প থেকে বের হয়ে কোকিল প্যারি জমিদার বাড়ির পাশে উকিল বাড়ি, হইকোর্টের একজন উকিল ওই বাড়ির মালিক। ভেতরে ঢুকতে টিকেট কাটতে হবে। বিরাট পুকুর পেরিয়ে উকিল বাড়ি।

উকিল বাড়ি
উকিল বাড়ি

পুরাতন বাড়ির চারপাশে নতুন কিছু স্থাপনা তৈরি করে ছোট আকারের পিকনিক স্পট বানানো হয়েছে। একসঙ্গে ১০০ থেকে ১৫০ লোকের পিকনিকের ব্যবস্থা আছে।

উকিল বাড়ির পরেই জজ বাড়ি, যা আগে ব্রজ নিকেতন নামে পরিচিত ছিল। ওই বাড়ি সাধারণত বন্ধ থাকে, তবে দরজার ফাঁক দিয়ে ছবি তুলতে কোনো বাধা নেই। ভেতরে ছোট আকারের চিড়িয়াখানা টাইপ কিছু পশুপাখি রাখার জায়গা আছে।

উকিল বাড়ির পরেই জজ বাড়ি, যা আগে ব্রজ নিকেতন নামে পরিচিত
উকিল বাড়ির পরেই জজ বাড়ি

জজ বাড়ির সামনে অনেক ব্যাটারি চালিত অটো-রিক্সা দাড়িয়ে থাকে। তাদের কাউকে দরদাম করে ভাড়া নিয়ে খেলারাম দাতার আন্ধারকোঠা, পুরাতন স্থাপনাগুলো দেখে কলাকোপা থেকে বান্দুরা-হাসনাবাদের পথে বেরিয়ে যান দর্শনার্থীরা।

আন্ধারকোটা
আন্ধারকোটা

অটো-রিক্সা সঙ্গে রেখে ঘোরাঘুরিতে ভাড়া ২০০/২৫০ এর বেশি হয় না।

বান্দুরা-হাসনাবাদ

হাসনাবাদ জপমালা রানির গির্জা
হাসনাবাদ জপমালা রানির গির্জা

কলাকোপা থেকে একটু সামনে এগোলেই নবাবগঞ্জের বান্দুরা গ্রাম। প্রথমেই চোখে পড়বে ঐতিহ্যবাহী হলিক্রস স্কুল। স্কুলের সামনের রাস্তা ধরে লাল-ইটের পথ ধরে যেতে হবে হাসনাবাদ। পুরো এলাকাটি ওই এলাকা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের বসবাস। ছিমছাম ওই পথ পেরিয়ে হাসনাবাদ জপমালা রানির গির্জা।  ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত এই গির্জাটি গথিক শিল্পকর্মের অনন্য নিদর্শন।

হাসনাবাদ জপমালা রানির গির্জা
হাসনাবাদ জপমালা রানির গির্জা

আগে গির্জাতে প্রবেশ করার সুযোগ থাকলেও ইদানিং নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ঢুকতে দেয়া হয় না। তবে হতাশ হবার কিছু নেই, গির্জার পাশেই বিরাট খেলার মাঠ। ওই মাঠের পাশেই গির্জার রেলিংয়ের পাশে দাড়িয়ে গির্জার বাইরের অবকাঠামো পুরোটাই দেখা যায়। দেখা যায় খ্রিষ্টান কবরস্থানের কিছুটা।

মাঠ পেরিয়ে একটু সামনে গেলে রয়েছে আরেকটি ঐতিহ্যবাহী স্কুল, তারপাশেই একটি পরিত্যাক্ত খ্রিষ্টান বাড়ি। বাড়িটি পরিত্যাক্ত হলেও আগাছা ও বটগাছের শেকড় ওই বাড়িতে আঁকড়ে ধরে তৈরি করেছে এক অনন্য শিল্পকর্ম। এখানে দাড়িয়ে অনেক দর্শনার্থী ছবি তুলে স্কুলের সামনের দোকান থেকে চা ও স্থানীয় ফল কিনে থাকেন।

কিছুটা দুরেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী ভাঙ্গা জামে মসজিদ। ওই মসজিদের সৃষ্টি রহস্য নিয়ে নানা ধরণের গল্প চালু আছে। তবে বর্তমানে আধুনিক নির্মাণ সামগ্রীতে সংস্কার করা হয়েছে মসজিদটি।

ভাঙ্গা জামে মসজিদ
ভাঙ্গা জামে মসজিদ

ঘোরাঘুরিতে একটু ক্লান্ত হয়ে বান্দুরার ঐতিহ্যবাহী ‘লরেন্স বেকারি’ থেকে ‘চারা বিস্কুট’ কিনে থাকেন অনেকে। যা ওই বেকারি ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না বলে জানা যায়।

বান্দুরার ঐতিহ্যবাহী 'লরেন্স বেকারি
বান্দুরার ঐতিহ্যবাহী লরেন্স বেকারি

বাকরখানি আর ড্রাই-কেকের সম্মিলিত এক স্বাদের ওই বিস্কুট। বিস্কুট খেতে খেতে এবার মৈনট ঘাটের দিকে যাত্রা।

মৈনট ঘাট

কলাকোপা-বান্দুরা ঘুরে অটোরিক্সা ও সিএনজিচালিত ট্যাক্সিতে করে মৈনট ঘাট যাত্রা করেন থাকেন ভ্রমণার্থীরা। নবাবগঞ্জের দোহারে যেতে কার্তিকপুর বাসস্ট্যান্ড হয়ে যেতে হয় মৈনট ঘাটে। পদ্মা নদীর অপরূপ জলরাশিতে মুগ্ধ হতেই হয় ‘মিনি কক্সবাজার’ নামে পরিচিত পদ্মা পাড়ের এই স্পটে এসে।মৈনট ঘাট

নদী পারাপারের জন্য স্প্রিডবোট, ট্রলার ও খেয়া নৌকাঘাটের দু’পাশে মৈনটের পানিতে গা ভেজাতে নেমে পড়া যাবে সহজেই। একটু খেয়াল রাখতে হবে, মৈনট তীড়ের মাটি কক্সবাজারের মতো না। একটু আঠালো ও হঠাৎ করে পা ঢুকে যায় একটু গভীরে গেলে। দলবেঁধে একসঙ্গে গোসল করাটাই নিরাপদ।মৈনট ঘাট

নারী ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য এখন পর্যন্ত ওই জায়গা বেশ নিরাপদ হলেও গোসল করার পরে কাপড় পরিবর্তনের সুবিধা নেই। একটি মাত্র পাবলিক টয়লেট তাও বেশ অপরিষ্কার।

মৈনট ঘাট

পাশে থাকা দুটি খাবার হোটেল ও একটি রিসোর্টে বিশেষ ব্যবস্থায়/অনুরোধে টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। খাবার হোটেল বসে তাজা ইলিশ ভাজা, মাছ ভর্তা আর চিংড়ি খেতে খেতে মৈনটের তীড় দেখা এক দারুণ অভিজ্ঞতা।

হোটেলগুলোতে এখনও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেই, সৌর বিদ্যুৎ এর মাধ্যমে সন্ধ্যার পরে আলোকিত হয় মৈনট। বিদ্যুৎ না থাকলেও প্রাকৃতিক বাতাসে এলোমেলো চুল সামলাতে অস্থির হতে হয় ভ্রমণপিপাসুদের।মৈনট ঘাটে ইলিশ খাওয়া

গোসল খাওয়া শেষে নদীতে ঘুরতে যাবার জন্য ঘন্টা চুক্তি হিসেবে দরদাম করে নিতে হবে। স্প্রিডবোট ও খেয়া নৌকার চেয়ে ইঞ্জিন চালিত মাঝারি ট্রলারগুলো বেশ নিরাপদ মনে হয়েছে পদ্মার ঢেউ দেখে।

মৈনট ঘাট

পড়ন্ত বিকেলে মৈনটের পানিতে আলো-জলের খেলায় শিশু হয়ে ওঠেন অনেক দর্শনার্থী। সেলফি আর গ্রুপ ছবি তুলে ঘাটের পাড়ে বাদাম ও ধুমায়িত চা পান করার ব্যবস্থা রয়েছে।

ঘুরতে দেখতে সময় কাটানোর পাশাপাশি মনে রাখতে হবে মৈনট থেকে ফিরে আসার শেষ বাস সর্ম্পকে। মাগরিবের আজানের পরপরই মৈনট থেকে ঢাকাগামী শেষ বাস ছেড়ে যায়।কার্তিকপুরের স্পেশাল জলশিরা রসগোল্লা, চমচম

ফেরার পথে কার্তিকপুরে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মত বিরতি দিয়ে থাকে বাসগুলো। কার্তিকপুরের স্পেশাল জলশিরা রসগোল্লা, চমচম না খেলে কিছুটা অপূর্ণতা রয়ে যাবে।পদ্মা নদীতে সূর্যাস্ত

যারা পদ্মা নদীতে সূর্যাস্ত দেখে ফিরতে চান, তারা অনেকে বাস ছেড়ে দিয়ে অটোরিক্সা ও সিএনজিচালিত ট্যাক্সিতে নবাবগঞ্জ হয়ে ফিরে আসেন। স্থানীয় টহল পুলিশ থাকলেও যারা একা একা যাবেন, তাদের একটু আগে আগে ফেরাটাই নিরাপদ। ফিরতে ফিরতে আবার কবে মৈনট ঘাটে যাবেন, তা মনে আসে অনেকেরই।