করোনার কারণে স্তব্ধ পৃথিবীর সুনশান নীরবতা ভাঙতে বসেছে। ধীরে ধীরে সচল হচ্ছে দুনিয়া। জানুয়ারি থেকে যে ভূতুড়ে মহাজাগতিক বসবাস আমাদের, তা একটু একটু করে ‘ব্যস্ত’ হতে যাচ্ছে। করোনাক্রান্তিতে আমাদের নিত্য চলাচলে যে নিষেধাজ্ঞা, স্কুল-অফিস বন্ধ, ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এবং গণ-জমায়েতে বিধিনিষেধ ছিলো তা উঠতে যাচ্ছে। করোনাকাল এমন এক পরিস্থিতি, যা সভ্যতার ইতিহাসে অভূতপূর্ব। বলা বাহুল্য, কোভিড-১৯ নামক একটি রোগ সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। গতবছরের মধ্য নভেম্বরে চিনের উহান থেকে যার যাত্রা শুরু, সে আজ জারি করেছে নয়া-রোগের বিশ্বায়ন। এই করোনাকে ঠেকাতে পুরো বিশ্ব যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালো তা নজিরবিহীন। কারণ, করোনা যা করেছে তা ছিলো অভূতপূর্ব। এই করোনাপরবর্তী সময়কে বলা হচ্ছে নিউ নর্মাল লাইফে ফেরা।
প্রসঙ্গত, গত ২৯ মে, ২০২০ তারিখে চ্যানেল আই অনলাইনে ‘নিউ নরমাল’ পোস্ট করোনায় বদলে যাওয়ার ইঙ্গিত (লিঙ্ক:https://bit.ly/30Ks3dZ ) শীর্ষক এক নিবন্ধে এই সংক্রান্ত প্রাথমিক আলোচনা করেছি। যেখানে বলার চেষ্টা করেছি- ‘বর্তমানে পৃথিবী বিপর্যস্ত করতে করোনা তার চরিত্র পাল্টিয়েছে। দেশে দেশে গিয়ে ভোল পাল্টিয়েছে। হিমশিম খাচ্ছে বিজ্ঞানীরা। করোনা ভাইরাস যদি বদলাতে পারে, তবে বদলাতে আপানাকে হবেই’!
এখন প্রশ্ন হলো, এই অচলাবস্থা থেকে মুক্তি কিভাবে সম্ভব? করোনার গৃহবন্দীত্ব থেকে বেরিয়ে আসার কৌশল কী? সম্প্রতি প্রকাশিত বিবিসি’র খবরে এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির সংক্রামক রোগ বিষয়ক অধ্যাপক মার্ক উলহাউজ’র একটি উদ্ধিৃত ধার করে বলি- এই কৌশল ঠিক করা বড় ধরণের বৈজ্ঞানিক এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘ আলাপে যদিও তিনি তিনটি উপায় বলেছেন- ১. করোনা প্রতিষেধক টিকা আবিস্কার, ২. বহু মানুষের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ ঘটলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠা এবং ৩. স্থায়ীভাবে মানুষ এবং সমাজের আচার-আচরণে পরিবর্তন নিয়ে আসা।
প্রবাহমান সমাজের বিভিন্নযুগকে দেখতে গিয়ে আজ আমরা করোনা পরবর্তী যুগ বলছি। এইভাবে যুগচিহ্নিত করা প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের মতে ‘ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ সবাই প্রত্যেকটি যুগকে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করে বিশ্লেষণ করতে পছন্দ করেন। এর একটি অন্যতম কারণ হলো এতে করে বিশ্লেষণের কাজটি সহজতর হয়। তাছাড়া একটি চিন্তা বা আইডিয়া সর্বব্যপ্ত রূপ লাভ করে এবং শেষাবধি একটি আদর্শ বা আইডিওলজি’তে রূপান্তরিত হয়’ {সূত্র: আলী রীয়াজ, ‘গ্লোবালাইজম, তথ্য-পুঁজি ও গণমাধ্যম’, গণমাধ্যম ও জনসমাজ, গীতি আরা নাসরিন ও অন্যান্য (সম্পাদিত) শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০২; পৃষ্ঠা ২৯১}। এখন বৈশ্বিক করোনাক্রান্তির ফলে বদলে যাওয়া পৃথিবীর চেহারা দেখলে ‘করোনা পরবর্তী নিউ নর্মাল’ পৃথিবীর যুগ হিসেবে দেখতে পারি। একই নিবন্ধে অধ্যাপক রীয়াজের ভাষ্য মতে গত শতাব্দীর তিরিশের দশককে মন্দার যুগ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সময়কে স্নায়ুযুদ্ধের সময় এবং সত্তরের দশককে মহাকাশ যুগ বা স্পেস এই বলে শনাক্ত করার একটি চেষ্টা দেখা গিয়েছিলো। তিনি একে বলছেন, ‘জ্ঞানচর্চার ইতিহাস ঘাঁটলেই আমরা দেখতে পাবো যে, সমাজে যে শ্রেণী বা গোষ্ঠী বস্তুগত সম্পদ এবং সেই সূত্রে মানসিক সম্পদের ওপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে, তারা এভাবেই নিজস্ব আদর্শিক অবস্থানকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে’। করোনা পরবর্তী পৃথিবীকে ‘নিউ নর্মাল’ যুগ বলাটা নিয়েও বিতর্ক আছে। চিনের তৈরি এই অর্থনৈতিক পরিভাষাকে বঙ্গে জোর করে ঢোকানোর প্রয়াশ কিনা কিংবা পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও নিউ নর্মাল লাইফ চালু হওয়াকে পরোক্ষভাবে ‘চিনের বিশ্বায়ন’ কিনা সেটি নিয়েও বিতর্ক চলছে।
নিউ নর্মাল আসলে কী? আজ থেকে একযুগ আগে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা প্রশ্নকে ঘিরে নতুন ইকনোমিক পলিসি নির্ধারণে “নিউ-নর্মাল” প্রত্যয়টি প্রথম সামনে আসে। ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে নিউ-নর্মাল বলতে মানুষের আচরণগত যোগাযোগের নতুন কৌশলকেই বোঝায়। নিউ নর্মাল প্রত্যয়টি আবার আলোচিত হচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যানসাস এর ডাক্তারদের মতে- ‘the coronavirus pandemic will change daily life for most people. This includes limiting person-to-person contact, like handshakes and hugs. Additionally, maintaining distance from others, in general, will likely stick around’ (সূত্র: The ‘new normal’ after coronavirus; Korinne Griffith, Kansas Capitol Bureau, লিঙ্ক: https://bit.ly/3cYk5Aq)। যেহেতু করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি, সেই প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে লকডাউন তুলে দিয়ে মানুষকে নতুন যোগাযোগ কৌশলে অভ্যস্ত হয়ে কাজে যোগদানের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারও ইতিমধ্যে নিউ নর্মাল জীবনের ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ করোনাক্রান্তির পর নতুন সমাজে নতুন যোগাযোগ কৌশলে অভ্যস্ত হওয়ার নামই নিউ নর্মাল। যেমন: এই নতুন সময়ে মুখে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা হয়ে উঠবে অত্যাবশকীয়, যতটা সম্ভব ঘরে থাকবে মানুষ, ওয়ার্ক ফ্রম হোম পপুলারিটি পাবে, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা (খাওয়ার জল, হ্যান্ড-গ্লাভস, স্যানিটাইজার, পোশাক, রুমাল, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহার করা) জীবনে সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি পাবে। ডিজিটাল মাধ্যম বা অনলাইনের মাধ্যমে সক্রিয়তা বহুগুণে বাড়বে। পাশাপাশি নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও অনলাইন সিকিউরিটিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। করোনাত্তোর পৃথিবীতে ‘ক্যাশলেস’ লেনদেন জনপ্রিয়তা পাবে। জনতা যত্রতত্র পানি খাবে না। ব্যাগের কর্নারে ফ্ল্যাক্স বা ওয়াটার বটল নিয়ে চলবে। প্রযুক্তি ব্যবহার হবে ভালো-মন্দ দুই উদ্দেশ্যেই। মহামারী-উত্তর এই পৃথিবীতে প্রযুক্তির শক্তি হবে অলঙ্ঘনীয়। ‘নয়া-মাধ্যম’ বা ‘নয়া বিশ্বব্যবস্থা’ পড়তে ও পড়াতে গিয়ে দেখছি, স্বাভাবিকভাবেই মানুষ তার মৌলিক চাহিদা বদলে ফেলবে। প্রযুক্তিগতপণ্য বিশেষ করে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট হয়ে উঠবে মৌলিক অধিকার। কারণ, এই করোনাক্রান্তিতে আমরা দেখছি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুর্বল ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনার কারণে অনলাইনে ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না। ইন্টারনেট তথা অনলাইনে থাকাটা এখন অনেকটা নাগরিক অধিকারের মতো। ফলে নিউ-নর্মাল লাইফে মফস্বলে-গ্রামে-গঞ্জে উচ্চগতির ইন্টারনেটের জন্য মানুষ সামনে মিছিল করবে, অফিস ঘেরাও করবে, অস্বাভাবিক কিছু নয়।
নিউ নর্মাল লাইফ কি আদৌ সম্ভব? এই প্রশ্নটি দেশ, সমাজ ও গোত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর হবে। গ্রিক দার্শনিক হিরাক্রিটাসের একটি উক্তি আছে, এরকম- ‘একই নদীতে দুইবার স্নান করা যায় না’। সমাজে যোগাযোগের নিরবচ্ছিন্ন সজীব প্রবাহমানতা বোঝাতে যোগাযোগ অধ্যয়ন ক্লাসে আমরা এটি পড়াই। অর্থাৎ, নদীর সঞ্চরণশীল প্রবাহমান জল অ-স্থির; যে পানিতে আমি ডুব দিলাম, একটু পর আবার ডুব দিলে ওই একই পানি আমি পাবো না। কারণ, নদীর পানি গতিশীল! প্রবাহমান নদীর মতো যোগাযোগও যে একটি নিরন্তর গতিশীল প্রক্রিয়া সেটা বোঝাতে এই উক্তিটি সময় উপযোগী হতে পারে- “No man ever steps in the same river twice, for it’s not the same river and he’s not the same man”। তাই আজ পোস্ট-করোনা ‘নিউ নর্মাল’ লাইফের প্রবেশমুখে গবেষকরা বলছেন, করোনার পর বদলে যাওয়া পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই হবে, যা আগে হয়নি। শত সাধনা করেও আমরা এখন বিগত অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর মাসের আমেজকে আনতে পারবো না। করোনাকে নিয়েই বাঁচতে হবে। শত্রুর সাথে সহাবস্থান; বিশ্বব্যাপী এটাই ‘নিউ নর্মাল’। পৃথিবী এখন ‘বিফোর করোনা’ এবং ‘আফটার করোনা’ হিসেবে চিহ্নিত হবে। এই লকডাউন সিচুয়েশনটা হলো যুগসন্ধিক্ষণ। করোনা এসে পরবর্তী পরিবর্তনটা খুবই স্পষ্ট করে দিয়েছে আমাদের।
কেন এই বদলে যাওয়া? আমরা জানি, পরিবর্তনই জগতের নিয়ম। বস্তুর রূপান্তরই বস্তুর ধর্ম। বাংলা সাহিত্যে একটি জনপ্রিয় উক্তি আছে প্রখ্যাত নাট্যকার ও শহিদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর- ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়’। এই নিদানকালে কথাটি খুব মনে ধরেছে। কারণ, আমাদের বদলে যেতে হবে, বদলে যাওয়াই সমাজের ভবিতব্য। কিন্তু ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ এবং ‘লকডাউন’ আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রায় অসম্ভব একটি ধারনা। তবুও আমরা যতটুকু পারি জনে-জনে সম্পর্কচ্ছেদ করে গৃহঅন্তরীণ ছিলাম সত্তর দিনের মতো। তবুও করোনার উর্ধ্বমুখী গ্রাফ নিচে নামেনি, সমান্তরাল হয়নি। সংক্রমণ ঠিকই বেড়েছে। কারণ, ‘আইসোলেশন’ বলতে যা বোঝায়, তা বাঙালির সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের উল্টোধারণা। যে ষড়ঋতুর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় পরিবেশে বাঙালির বেড়ে উঠা, সেই বাঙালিকে ‘দমিয়ে রাখা’ যায় না, কর্মমুখর-আড্ডাবাজ-সামাজিক বাঙালিকে হীমশিতল বরফাচ্ছন্ন পাশ্চাত্যদেশীয় এমন রাশভারি আভিধানিক শব্দে ঢোকানো কিছুটা মুশকিল। সরকারি সিন্ধান্তের containment তাই এপার বাংলা-ওপার বাংলায় সফলতা আনছে না। মানুষকে ‘আটকে রাখা’ বা ‘ঘিরে রাখা’ এই সমাজের নৃতাত্ত্বিক ধারণায় বড্ড অনুপস্থিত।
তাহলে কী হবে আমাদের পরিণতি? যোগাযোগবিদ্যা অধ্যয়ন আমাদের বলছে, করোনার পরের পৃথিবীতে নতুন কিছু বিষয় ঘটবে। যেমন: করোনাক্রান্তির পৃথিবীকে আমি তিনভাগে বিভক্ত করতে চাই। করোনাকান্তির লকডাউন পিরিয়ড, স্বল্পদৈর্ঘ্য নিউ নর্মাল পিরিয়ড এবং দীর্ঘমেয়াদি কমিউনিকেশন চেঞ্জ পিরিয়ড। করোনাকে সময়ভিত্তিক বিভক্তির কারণ লকডাউনকে যদি আমরা মহাভারত মিথলজির পাণ্ডবদের ‘বনবাস’কে বুঝি, নিউ নর্মাল পিরিয়ড হলো ‘অজ্ঞাতবাস’। তৃতীয়ত- এই সমাজের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য আমাদের দরকার ব্যবস্থাকে পাল্টানো। এই তিনটি বিভক্তি নির্ভর করছে ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন, সামাজিক যোগাযোগ কৌশলগত পরিবর্তন এবং রাষ্ট্রীয় সিস্টেম পরিবর্তনের শর্তের ওপর। যোগাযাগবিদ্যার পাটাতনে এই বিভাজিত ধাপগুলো পরস্পর অবিচ্ছিন্নভাবে বৃত্তকার মডেলে আমাদের ভাবতে হবে। অর্থাৎ, পাণ্ডবদের একযুগের বনবাস শেষে যেমন বেশবদল করে অজ্ঞাতবাসধারী হতে হয়েছে, তেমনি ‘হোম কোরায়েন্টাইন’ শেষে এবার ‘নিউ নর্মাল’ জীবনে অজ্ঞাতবাস শুরু হবে। চেনা পোশাকের ওপর থাকবে ভিন্ন মুখাভরণ, শিরোস্ত্রাণ! অতপর রাষ্ট্রকে তাঁর নাগরিক সুরক্ষায় জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা ও গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, দিতেই হতে হবে, এছাড়া মুক্তি নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আসলেই কি পারবো আমরা বদলাতে? করোনার লকডাউনে বসে আমরা যারা দূরের পরাণসখার জন্য ‘কি জানি কাহারো লাগি প্রাণ করে হায় হায়’ করে গুমরে মরেছি, তারা কি লকডাউন শেষে সমাজ সচল হলে সমস্বরে ‘আয় তবে সহচরী’ বলে ‘মাঝে হলো ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়/ আবার দেখা যদি হলো সখা, প্রাণের মাঝে আয়’ গাইবো? না। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে গাইবো না। অর্থাৎ শরীর চাইবে, মন বাদ সাধবে। আবেগ বলবে ‘কাছে আসো’, যুক্তি বলবে ‘দূরে যাও’। এই নিরন্তন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ভেতর আমাদের নতুন যোগাযোগ কৌশল গড়ে উঠবে, সেটিই নিউ নর্মাল। সেই নিউ নর্মাল সময়ে তরুণদের একসঙ্গে বসে কাঁধে হাত দিয়ে চেনাপরিচিত আড্ডা হয়তো আর হবে না। হবে না এক কাপ চায়ের কাপে যুগলঠোঁটের সমবায়। থাকবে না একটি সিগারেটের পেছনে দলবদ্ধ যৌথসুখটান। মানুষ সতর্ক হবে। যৌথখামারের বদলে ব্যক্তিবাদ জনপ্রিয়তা পাবে। মনে পড়ছে আধুনিক সমকালীন কবি ও অধ্যাপক ময়ুখ চৌধুরীর বিখ্যাত প্রেম-বিরহী কবিতার তিনটি বাক্য ‘মাঝে মাঝে দূরে যাওয়া ভালো। দূরে গেলে কাছে আসা যায়/ বোঝা যায় -কেউ কাছে ছিলো’। এখন হবে ‘দূর হতে’ তোমারে দেখার পালা। আর সেই দূরের দেখাতেই মুগ্ধ হয়ে চোখে চেয়ে থাকা। কানে হয়তো বাজবে ‘কিনিকিনি রিনিঝিনি’, মন বলবে ‘তোমারে যে চিনি চিনি’, কিন্তু নিউ নর্মাল লাইফ বলবে সেই ‘মনে মনে ছবি’ আঁকো। কারণ, কাছে ঘেঁষলেই নিজের অস্তিত্ববিপন্ন হবে। প্রিয় মানুষের ‘ভরা দুটি আঁখি চঞ্চল’ যতই কাছে টানুক, নিউ নর্মাল বলছে, বাতাসে ভাইরাস উড়ালে ভীরু অঞ্চল ওই রূপের মাধবী’ সংশয়ে রাখবে আরো বেশি। তাই ভ্রমণের চাইতেও ভাবনার ‘ভ্রমরের গুঞ্জনে’ই সময় কাটাতে হবে বেশি।
রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে/ একটুকু কথা শুনি/ তাই দিয়ে মনে মনে/ রচি মম ফাল্গুনি’। অথচ বসন্তেই আমাদের দেশে ছোঁয়াচে রোগের প্রকোপ বাড়ে। এমনকি এবারও করোনাভাইরাস এসেছে বসন্ত বাতাসে, ফলে পোস্ট করোনা নিউ নর্মাল লাইফে এই আবেগ খারিজ হয়ে যাচ্ছে। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি বলেছিলেন, “গতকাল আমি চালাক ছিলাম তাই পৃথিবীটাকে বদলাতে চাইতাম, আজ বুদ্ধিমান হয়েছি তাই নিজেকে বদলাতে চাই’’। নিউ নর্মাল ধারণাটি আমাদের ‘বদলে যেতে’ বলছে। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগছে- নিউ নর্মাল সময়ে বাংলাদেশের ঘনপ্রান্তিক, বস্তিবাসী, বহুজনগোষ্ঠিীর সমাজ কি পারবে জীবন ও জীবিকাকে সমান্তরালভাবে চালিয়ে নিয়ে যেতে? উচ্চবিত্ত পারলেও, মধ্যবিত্ত কষ্ট করে খাপ খাইয়ে নিবে; কিন্তু হতদরিদ্ররা? এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে একটি কালজয়ী উক্তি আছে। তিনি বলেছেন- ‘ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে, ভদ্র পল্লীতে- এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না’। হতদরিদ্র জেলেদের প্রতি প্রকৃতির প্রতিকূলতা, ক্ষুধার নির্মম কশাঘাতে জর্জরিত অবস্থার বর্ণনায় তিনি এই ভাগ্যবিড়ম্বিত উক্তিটি করেছেন। গরিব জেলেদের হাহাকার ফুটে উঠেছে এই একটি উক্তিতে। যে গরিব, হতদরিদ্র বা নিম্ন মধ্যবিত্ত গণপরিবহনে বাদুরঝোলা হয়ে যাতায়ত করেন, যে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবাসে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীদের বসবাস, যে দেশে ঘনপুঞ্জিভূত বস্তিবাসীরাই রাজনৈতিক মিছিলের জনস্রোত, যে দেশে প্রতি প্রভাতে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি অভিমুখি লাখো শ্রমিক পিপীলিকার মতো যাত্রা, সে দেশে বসে ইউরোপ-আমেরিকার মতো ‘নিউ নর্মাল’ লাইফের স্বপ্ন দেখা অবাস্তব বটে। কথায় বলে, গরিবের জন্য কেউ নাই, হ্যাঁ- গরিবের জন্য নিউ নর্মালের বালাই নেই। সে গরিব হিসেবেই বড্ড ‘নর্মাল’ এই শ্রেণীবিভাজিত সমাজে। ঈশ্বর যা করেন ‘মঙ্গল’র জন্য করেন (‘পৃথিবী’র জন্য কিছু করেন কি?)! যদি করেই থাকেন, তবে নিউ নর্মাল লাইফের পর টেকসই পৃথিবীর জন্য চাই সত্যিকারের নতুন যোগাযোগ কৌশল।
কী সেই নতুন কৌশল? করোনা এসে শিখিয়ে দিলো, সামরিক খাতের বাজেট দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ‘করোনাযুদ্ধ’টা ঠেকানো গেলো না, আমাদের দরকার ছিলো স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানো। করোনার শিক্ষা এই, আমাদেরকে পুরাতন সিস্টেম ভেঙ্গে নতুন মানবিক পৃথিবী গড়ার দিকে যেতেই হবে। নিউ নর্মাল লাইফ মানে- টিকে থাকতে গিয়ে নতুনভাবে বেঁচে থাকা। শরৎচন্দ্র তাঁর বিলাসী গল্পে লিখেছেন, ‘অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে’। হ্যাঁ, এই ধরিত্রীর একমাত্র সত্য- টিকে থাকতে হলে বদলে যেতে হবে। বদল যখন অনিবার্য হয় সেই বদলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকাটাই একমাত্র যোগাযোগ কৌশল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)