সম্পূর্ণ অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সরকারকে আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করতে হচ্ছে। করোনা মহামারি দেশীয় ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কী মাত্রায় বিপর্যয় ঘটিয়েছে সে সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য কারো হাতে নেই। কবে নাগাদ এই মহামারি শেষ তাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এই ঘোর দুর্দিনে সরকার কোথা থেকে কতো টাকা আয় করতে পারবে এবং সেই পরিমাণ টাকা দিয়ে প্রয়োজন মেটানো যাবে কিনা- এসব প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখেই আজ কঠিন পরীক্ষায় নামতে হচ্ছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে। তার সামনে অনেকগুলি চ্যালেঞ্জ। দরকার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা। তিনি কি পারবেন সুদিনের পথ দেখাতে?
১৯৩০ সালের পর এত ভয়াবহ সংকটে আর পড়েনি পুরো পৃথিবী। করোনাভাইরাসে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি, রেমিট্যান্স থেকে শুরু করে উৎপাদন, সাপ্লাই চেন—সব ভেঙে পড়েছে। ব্যবসায়ী থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ—সবার মাথায় হাত। এসব সংকট মাথায় নিয়েই ঘোষিত হচ্ছে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট। করোনার প্রভাবে তছনছ হয়ে যাওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধারই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার এবার ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বিশাল ঘাটতি বাজেট দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
ইতিপূর্বে অর্থনীতির এই জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি কোনও অর্থমন্ত্রীকে। অর্থনীতিকে পুররুদ্ধার করার কথা বললেই তো আর পুনরুদ্ধার হয় না। করোনার ধাক্কায় প্রায় ৬০ ভাগ মানুষের হাতে কাজ নেই। আয় কমেছে ৮০ ভাগ মানুষের। ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের সমস্যা, অন্য দিকে হাতে টাকা না থাকার সমস্যা। স্বাধীনতার পরে এই প্রথম জিডিপি’র হার এত নীচে। শুধু তাই নয়, প্রায় সব উন্নয়নের সূচক নিম্নমুখী। অর্থনীতির ভাষায় স্ট্যাগফ্লেশনে আক্রান্ত (থমকে যাওয়া) দেশের অর্থনীতি। এ অবস্থা বেশি দিন চললে চরম অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে।
অর্থনীতির এই সমস্যা সমাধানের কোনো যাদুমন্ত্র নেই। আবার সরকারের নীতিহীনতা নিঃসন্দেহে এই সমস্যা দীর্ঘায়িত করবে। তাই দরকার সুনির্দিষ্ট আগামীর রূপরেখা। যা ভবিষ্যতে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু তার জন্য অর্থনীতির সমস্যার মূলে ঢুকতে হবে। বিচার করতে হবে সেই সমস্যার পরিধি ও ব্যাপ্তি। পর্যায়ক্রমে সেই সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের দিশা দেখাতে হবে। তাই এ বারের বাজেট এক চ্যালেঞ্জের বাজেট। এখন মোটাদাগে দেখে নেওয়া যাক, সেই চ্যালেঞ্জগুলি কী এবং তার সমাধানের সম্ভাব্য রূপরেখা কী হতে পারে।
প্রথমেই আসে বিপুল বেকারত্বের সমস্যা ও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমতে থাকা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এই দুইয়ের যাঁতাকলে বাজারে চাহিদার অভাব। ফলে, জাতীয় আয় বৃদ্ধি তলানিতে নেমে যাওয়া। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর একমাত্র উপায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা ও মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানো। নতুন কর্মসংস্থানের জন্য দরকার সরকারের অবকাঠামোগত বিনিয়োগ এবং বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের উৎসাহ প্রদান। অবকাঠামো ও আবাসিক শিল্পে কর ছাড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে সরকারি ভর্তুকি অনেকাংশে এই ক্ষেত্রগুলোকে পুনর্জীবিত করতে পারে। কোষাগারের টাকা পরিকল্পিত ভাবে কাজে লাগালে আখরে অর্থনীতির লাভ হয়। অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয় কাজ, যেমন, ধর্ম প্রতিষ্ঠান তৈরিতে সরকারি ব্যয়ে রাজনৈতিক ও ‘আধ্যাত্মিক’ মোক্ষলাভ হলেও কোনও সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক লাভ হয় না।
এর পরে দৃষ্টি দিতে হবে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানোর উপায়ে। গরিব, প্রান্তিক ও মধ্যবিত্ত জনগণের ভোগব্যয়ের প্রবণতা সব সময়েই ধনী ব্যক্তিদের থেকে বেশি হয়। অর্থাৎ, এক টাকা আয় বৃদ্ধির ফলে গরিব ও প্রান্তিক মানুষেরা ওই বৃদ্ধির সিকিভাগই ভোগ-বাবদ খরচ করে। কিন্তু সেই সমপরিমাণ আয় বৃদ্ধির জন্য ধনী ব্যক্তিদের ভোগব্যয়ের খুব একটা পরিবর্তন হয় না। এই সহজ, সরল তথ্যটি আমরা পাই অর্থনীতির প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তকে। একটি দেশের মোট অভ্যন্তরীণ চাহিদার একটি বিপুল অংশের উৎস হচ্ছে গ্রামীণ মানুষের ভোগব্যয়। তাই চাহিদা বৃদ্ধির জন্য দরকার গরিবের হাতে বেশি করে অর্থের যোগান। আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে গরিব গ্রামীণ মানুষেরা এখনও অধিকাংশই কৃষিনির্ভর। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবে কৃষিক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন রয়েছে। আশা রাখা যায় যে, এ বারের বাজেটে কৃষি ক্ষেত্রের বরাদ্দ অন্য বারের তুলনায় বেশি হবে। দরকার হয়ে পড়েছে গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি। পাশাপাশি করোনাকালে গরিব-নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজগুলোতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি অর্থনীতিকে অনেকটাই চাঙ্গা করে তুলতে পারে।
এর পরে বাজারের চাহিদার আর একটি মূল অংশের উৎপত্তি হয় চাকুরিজীবী, মধ্যবিত্ত জনগণের হাত ধরে। প্রায় বহু বছর ধরে আয়করের বিন্যাস অপরিবর্তিত থেকে গিয়েছে। এখন সময় এসেছে আয়কর নিয়ে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করার। আয় যুক্ত করের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানোর প্রয়োজন। আয়কর হারেরও পূর্ণবিন্যাস দরকার হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন সঞ্চয়ের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো। সরকারের তরফে দীর্ঘমেয়াদী সঞ্চয়ে উৎসাহ দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা খুবই দরকার। এর ফলে এক দিকে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে ও অন্য দিকে মানুষের সঞ্চয়ও বাড়বে। ক্রয় ক্ষমতা বাড়লে চাহিদা বাড়বে আর অধিকতর দীর্ঘমেয়াদী সঞ্চয় সরকারি বিনিয়োগে সহায়তা করবে।
স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে, বাজেটের এই সব পদক্ষেপ করার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। এমনিতেই এখন রাজকোষের ঘাটতি ঐতিহাসিকভাবে খুবই বিপদসীমার মধ্যে রয়েছে। তাই সন্দেহ জাগে যে, সরকারি ব্যয়ের লাগাম টানার জন্য আদৌ কি বাজেটে কোনো দিক-নির্দেশনা থাকবে?
হ্যাঁ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকেও সবিশেষ নজর দিতে হবে। করোনা মহামারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর যে ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করেছে দুনিয়ার কোনো দেশই এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। তবে অনেক দেশই এই চাপ সামাল দেবার চেষ্টা করছে নিজেদের বিশেষ উদ্যোগ, দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনার গুণে। আমাদের ক্ষেত্রে সমস্যা অতীব ভয়াবহ, কারণ আমাদের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের সামর্থ্য নেই; সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনারও যোগ্যতা নেই!
আমরা স্বাস্থ্য খাতকে কখনই গুরুত্ব দিইনি। মানুষ বাঁচানোর চেয়ে এখানে ঠাঁট-বাট বজায় রাখার ব্যাপারে মনোযোগ বেশি। অন্যদিকে অব্যবস্থাপনার মূল বৈশিষ্ট্য হলো প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়হীনতা ও চুরি-চামারি। আর এর ফলাফল হলো- ডাক্তারসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মীরা ভয়ানক করোনা ঝুঁকির মধ্যে, টেস্টের ঘাটতি, অক্সিজেন-আইসিইউ বেডের স্বল্পতা, সাধারণ রোগীরা চিকিৎসা বঞ্চিত। অনেকেই “এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল করে” শেষপর্যন্ত বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। এই প্রতিকারহীন মৃত্যু ও হাহাকারের মধ্যে বসে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপনা উন্নত করার নিদান বাজেটে থাকা অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই বিপুল পরিমাণ বাজেট বরাদ্দের টাকা আসবে কোথা থেকে? হ্যাঁ, বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারকে ঋণ নিতেই হবে। এই ঋণের টাকাটা এবার যথাযথভাবে ব্যয় করার ব্যাপারে আল্লাহর কসম কেটে অঙ্গীকার করতে হবে। এই ঋণের টাকা গরীব ও মধ্যবিত্তদের হাতে অর্থের যোগান বাড়ানোর মাধ্যমে পরিণত করার ওপর নজর দিতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা এবারের বাজেটে যেকোনো মূল্যে লুটপাট এবং বেহিসেবি খরচ তো বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার উপায় অন্বেষণ করতে হবে। সরকারি ব্যয় কমাতে হবে। অপচয় রুখতে হবে। ৫০০ টাকার জিনিস ৫০০০ টাকায় কেনার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)