কত কত দিন কদম ফুলের গন্ধ নেওয়া হয় না। তাকানো হয় না মুগ্ধ দু’চোখে। তবুও এমন বাদল দিনে মনে পড়ে যায় কদম ফুলের কথা। উন্মনা করে দেয় তার বর্ণ, গন্ধ, সৌন্দর্য। নেশাধরানো এ ফুলটি যেন আসে বর্ষার বারতা নিয়ে। বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল তো উসকে দেয় স্মৃতিকে। প্রিয়জনের হাত থেকে কদম ফুল নেওয়ার মৌতাত যেন এ জীবনে কিছুতেই কাটতে চায় না। জীবন ভারি অদ্ভুত। এর তল খুঁজে পাওয়া যায় না। কত কঠিন ও জটিল সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তবুও মনটাকে আটকে রাখতে পারা যায় না। যা হাতের নাগালের মধ্যে নেই, যা চাইলেও পাওয়া যায় না, তার জন্য মন কেমন কেমন করে। যা আছে অনুভবে, যা আছে স্মৃতিতে, যা আছে দূরে, সেটাই কেন যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে।
বর্ষাকাল বোধকরি এমন। মনটাকে কেমন অচেনা করে দেয়। দুর্বল করে দেয়। ভাবাবেগে আপ্লুত করে তোলে। আকাশ ঘনকালো হলে, অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামলে, মনটা উচাটন উচাটন করে। অকারণেই ভিজে যায় ভিতরভূমি। জমে ওঠে কাব্যের পলিমাটি। উদাসী মন চলে যায় সুদূরে। ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে/আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে’।
বর্ষার সঙ্গে মনের বোধকরি একটা আত্মিক সম্পর্ক আছে। খামখেয়ালি বর্ষার চেয়ে বর্ষাকালের মনও কম অস্থিরমতি নয়। এই মনের সঙ্গে একদমই পেরে ওঠা যায় না। চাইলেই কি এখন আর বৃষ্টিতে ভেজা চায়? চঞ্চলিত মনটা কিছুতেই বুঝতে চায় না। কল্পনায় মনটা ছুটে চলে দুরন্ত ঘোড়ার মতো। হয়ে ওঠে ইচ্ছেপূরণের বাহন। ভিজিয়ে দেয় ইচ্ছের বৃষ্টিতে। ঘুরিয়ে আনে প্রিয়সান্নিধ্যে। আর এ কারণেই ঝুম বৃষ্টিতে প্রিয়জনের সঙ্গে রিক্সায় হুড নামিয়ে নাম না জানা গন্তব্যে হারিয়ে যেতে মন চায়। বন্ধনহীন, বল্গাহীন সেই ছুটে চলায়, আমি জানি না, অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে এর তুলনা হয় কিনা?
অবশ্য সবার ভালো লাগার ধরন তো আর এক রকম নয়। বর্ষাতির ফাঁক-ফোকর দিয়ে দুষ্টু বৃষ্টি যখন একটু একটু ভিজিয়ে দেয়, প্রিয়তমার গাল বেয়ে নামে ধারাবিন্দু, অধরে লেগে থাকে জলের পরাগরেণু, তখন বুকের মধ্যে সুখের কাঁপন না লেগে কি পারে? তখন বোধকরি বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পেতে কোনো দ্বিধা হয় না। টানা বর্ষণে ভেজা শার্টের ভিতর দিয়ে যখন প্রবাহিত হয় শীতল হাওয়া, তখন প্রিয়তমার নিবিড় উষ্ণতায় পাওয়া যায় পানশালার উত্তাপ। বুকের মধ্যে তখন রীতিমতো বাজতে থাকে ভালোবাসার মাদল।
কবির ভাষায়, ‘শিহরিত শরীরে কামনার ঘ্রাণ’। বর্ষাকাল খুবই ছন্নছাড়া। কেমন যেন এলোমেলো ভাবনায় ডুবিয়ে রাখে। বেপরোয়া বৃষ্টির মতো কোনও বাঁধ মানতে চায় না। আলগা করে দেয় মনের বাঁধন। সিক্ত করে দেয় বসন। তাতে কখনো-সখনো স্পষ্ট হয়ে ওঠে শরীরী বিভঙ্গ। একটু আড়াল করার সুযোগ পাওয়া যায় না। বৃষ্টির কি কোনো লাজ-লজ্জা নেই? কেন যে এমন পাগলামি করে?
বর্ষাকালে কেন যেন বাবুই পাখিকে খুব মনে পড়ে। প্রশ্ন ওঠতে পারে, এত এত পাখি থাকতে বাবুই পাখিকে কেন মনে পড়ে? মানুষের বিচিত্র মন। কেন কী কারণে কাকে কখন মনে পড়ে, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। তবে প্রকৃতির শোভা এই পাখিটি বর্ষা আসার আগে আগে শিল্পীর নিপুণ দক্ষতায় যেভাবে নিজেদের দৃষ্টিনন্দন বাসগৃহ বুনে সুখে-শান্তিতে বসবাস করে, তাতে প্রলুব্ধ না হয়ে পারা যায় না। রোদে, বৃষ্টিতে, ঝড়েও পাখিটি সঙ্গিনীর সঙ্গে নির্বিঘ্নে নিরুপদ্রবে মেতে ওঠে প্রণয়ে।
তবে বৃষ্টিবাদলের দিনে খুনসুটি ভিন্ন মাত্রা পায়। বাবুই পাখির মতো বাসা বানিয়ে প্রিয়তমাকে নিয়ে বৃষ্টিতে দোল খেতে অনেকেরই ইচ্ছে করতে পারে। ইচ্ছে করলে তো কাউকে অভিযুক্ত করা যায় না। একমাত্র ইচ্ছেই তো উড়তে পারে পাখি হয়ে। তাকে কি আর আটকে রাখা যায়? বাদলদিনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফিরে আসেন বার বার। তাঁর মতো মন খুলে আওড়াতে ইচ্ছে করতে পারে,
এমন দিনে তারে বলা যায়/
এমন ঘনঘোর বরিষায়।/
এমন দিনে মন খোলা যায়–/
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে/
তপনহীন ঘন তমসায়॥/
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,/
নিভৃত নির্জন চারি ধার।/
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,/
আকাশে জল ঝরে অনিবার–/
জগতে কেহ যেন নাহি আর॥/
সমাজ সংসার মিছে সব,/
মিছে এ জীবনের কলরব।/
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে/
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব–/
আঁধারে মিশে গেছে আর সব॥
জানি, বাবুই পাখির মতো বাসা বানিয়ে বৃষ্টির দিনে দোল খেতে চাওয়াটা নিছকই ভাববিলাস। অনেকটা আষাঢ়ের গল্পের মতো বৈকি। আর এমন কল্পনা, এমন গল্প শুধু বৃষ্টিমুখর দিনেই মাথায় আসা সম্ভব। বর্ষাকাল নিয়ে এন্তার অভিযোগ থাকলেও তাকে ভালো না বেসে পারা যায় না। আর যাকে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, তারপ্রতি ক্ষোভও থাকে অন্তহীন। তাই বলে কি তাকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়? এতটা হৃদয়হীন হওয়া কি ঠিক? বর্ষাকাল শুধু ভিজিয়ে দেয় না, জীবনকে রাঙিয়েও দেয়। বেলী, বকুল, জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার সুরভিতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে হৃদয়। তাই তো ‘আমি তো হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’। হায়! ‘শুধাইল না কেহ’। তবুও বর্ষার জন্য আমাদের কাতরতা চিরকালের।
আবার এসেছে সেই কদম ফোটার দিন। প্রকৃতিকে ধুইয়ে দিতে। আমাদের ভিতরের কাঠিন্যকে নমনীয় করতে। বৃষ্টি নামবে দু’কূল ভাসিয়ে। বুকের মধ্যে নামবে সুখের প্লাবন। কেউ নিশ্চয়ই প্রিয়জনের হাতে তুলে দেবে একগুচ্ছ ভালোবাসার কদম ফুল। কেউ দূরে কোথাও গিয়ে করবেন বৃষ্টির নিবিড় বন্দনা। কেউ কেউ বারান্দা কিংবা করিডরে দাঁড়িয়ে স্পর্শ করবেন বৃষ্টির উচ্ছ্বাস। একান্তই যদি এর কোনোটাই সম্ভব না হয়, তাহলে একটুখানি আনমনা নিশ্চয়ই হওয়া যাবে। স্মৃতিতে ভাসবে সুখের দিনগুলো। জাগিয়ে তুলবে বিরহ। আর প্রিয়জনের অপেক্ষায় থাকা কোনো প্রেমিক নচিকেতা’র মতো গেয়ে ওঠতে পারেন, তুমি আসবে বলেই/ আকাশ মেঘলা/ বৃষ্টি এখনও হয় নি/ তুমি আসবে বলেই/ কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো/ ঝরে যায় নি।
আর বৃষ্টি ভেজার দিন যাঁরা পেরিয়ে এসেছেন, জীবনের বাদলা দিনের আনন্দটুকুকে বাঁধিয়ে রেখেছেন স্মৃতির ফ্রেমে, তাঁদের অবলম্বন তো কোকিলকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকারের অমর সেই গান , ‘আষাঢ়-শ্রাবণ মানে নাতো মন/ঝর ঝর ঝর ঝরেছে/তোমাকে আমার মনে পড়েছে’। মনে তো পড়তেই হবে। আষাঢ়-শ্রাবণ এলে কেন জানি অনেক বেশি বেশি মনে পড়ে। তোমার কি পড়ে না মনে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)