সিলেটের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান করোনায় মারা গেছেন। করোনায় মারা যাওয়া তিনিই সিলেটের প্রথম কোন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা। এরআগে একাধিক রাজনৈতিক নেতা সিলেটের আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের কেউ কেউ সুস্থ হয়েও ওঠেছেন, কেউ কেউ আছেন চিকিৎসাধীন। কামরানের এই মৃত্যু সিলেটবাসীকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। কাঁদিয়ে দিয়েছে সিলেটের সকল দল-মতের মানুষদের। একজন রাজনৈতিক নেতার এমন গ্রহণযোগ্যতা যা কামরানকে দিয়ে প্রতিভাত হয়েছে সেটা উদাহরণই। এটা আর সকল রাজনৈতিক নেতার প্রতি বার্তাও। জনতার কাছাকাছি থাকলে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মানুষ কীভাবে ভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানে সেটা কামরানের এই মৃত্যুর পর প্রমাণ হয়েছে। জনবান্ধব রাজনীতিবিদ কামরান এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারেন।
করোনার শুরুতে কামরান দেশে ছিলেন না। মার্চের মধ্যভাগে দেশে ফিরেই কোয়ারেন্টিনে না থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। ওই সময় তিনি দুঃখপ্রকাশ করে সরল স্বীকারোক্তিতে বলেছিলেন তাকে কেউ বলে দেয়নি ঘরে থাকতে। এরপর নিজ থেকে হোম কোয়ারেন্টিনে ছিলেন তিনি। হোম কোয়ারেন্টিন পর্ব শেষের পর ফের দুর্যোগ আক্রান্ত মানুষদের সাহায্য করতে তাদের সঙ্গে মিশে যান। সরকারি, বেসরকারি, দলীয় ও ব্যক্তি উদ্যোগে বিভিন্ন পরিচালিত নানা কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে নেন। এটা ছিল তার সহজাত ধর্ম। ধারণা করা যায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে তিনি কোন এক পর্যায়ে করোনা আক্রান্ত হন, তার স্ত্রীও আক্রান্ত হন। এবং শেষ পর্যন্ত এই করোনাই তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিল। এই করোনাই তাকে মানুষের সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্কের রেখায় যতিচিহ্ন এঁকে দিলো।
কামরানের এই মৃত্যু তার সমাজহৈতিষী চরিত্রের স্বাক্ষর বহন করে। তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেননি। করোনার ভয়কে তুচ্ছজ্ঞান করে মানুষের সেবায় এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনা তার মহত্বের প্রতি সুবিচার করেনি, আপন ধর্মে আক্রান্ত করে তাকে, এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদূতের হাতে তাকে সঁপে দিয়ে তার পিছু ছেড়েছে। এই মৃত্যু দুঃখজনক, এই মৃত্যু বেদনার, এই মৃত্যু হতাশার।
করোনা আক্রান্ত হয়ে সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন সেন্টারে ভর্তির পরও কেউ ভাবেনি মৃত্যু এত সন্নিকটে তার। সিলেট থেকে ঢাকায় স্থানান্তরের সময়েও কেউ ভাবেনি সিলেট ছাড়ছেন তিনি শেষবারের মত। তার শুভ্র বসনে কেউ ভাবেনি এই যাত্রাই শেষ যাত্রা। মৃত্যুর অমোঘ নিয়তি তাকে সিলেট থেকে ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে গেছে, এই ঢাকাযাত্রায় অন্তত চিকিৎসা না পাওয়ার আফসোস থাকবে না কারও। দেশে থাকা সর্বোচ্চ চিকিৎসা পেয়েছেন তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) যা সিলেটে সম্ভব ছিল না। এজন্যে তাকে নিতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ছুটে এসেছে, নিয়ে গেছে তাকে; এই ব্যবস্থা তার জন্যে করা হয়েছিল। অর্থাৎ ধারণা মতে চিকিৎসার ক্রুটি হয়নি কোনও।
বদরউদ্দিন আহমদ কামরান সিলেটের মানুষের কাছে কতটা প্রিয়পাত্র ছিলেন সেটা তার মৃত্যুপরবর্তী হাহাকার থেকেই প্রমাণিত। সিলেটের মানুষের উজাড় করে দেওয়া ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন তিনি। তার সর্বশেষ দায়িত্বক্ষেত্র সিটি করপোরেশন তাকে জানিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মাননা। করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের প্রতি অপ্রত্যাশিত হলেও চেনাজানা আচরণ হয়নি তার প্রতি। সিটি মেয়র প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের হলেও ছুটে গেছেন তার বাসভবনে। তাকে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সম্মাননা জানানোর ব্যবস্থা করেছেন। তিন দিনের শোক কর্মসূচি দিয়েছে তারা, একদিনের কর্মবিরতিও আছে ওখানে- এটা তার প্রতি অশেষ সম্মান প্রদর্শনের নিদর্শন। রাজনৈতিক সম্প্রীতির সে অনুশীলন করে এসেছেন কামরান তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এটা তারও একটা প্রমাণ এবং প্রাপ্তি।
সারাদেশ যেখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় পুড়েছে তখন সিলেটে ছিল আশ্চর্য সুন্দর রাজনৈতিক সম্প্রীতি। এটা সম্ভব হয়েছে মূলত এখানকার রাজনৈতিক দলের নেতাদের ঔদার্যের কারণে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মহানগর পর্যায়ের শীর্ষ নেতা হিসেবে তিনি দিয়েছেন এই সম্প্রীতির নেতৃত্ব। ফলে ব্যতিক্রম এক নগর হিসেবে সারাদেশে সিলেট উপস্থাপিত হয়েছে। এই সম্প্রীতি অনূদিত হয়েছে তার প্রতি সর্বস্তরের মানুষের হৃদয় নিঙড়ানো ভালোবাসায়। করোনাকালে যেখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মানুষের চলাচল বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে সেখানে এটা উপেক্ষিত হয়েছে প্রায়। এই নির্দেশনার ব্যতিক্রমে ঝুঁকি আছে ঠিক কিন্তু এর মধ্যে ভালোবাসার প্রকাশ ছিল তারচেয়ে বেশি। অগণন মানুষের স্রোতের গন্তব্য হয়েছে তার বাসায়, জানাজাস্থলে, কবরস্থানের আশপাশে; তাদের বেশিরভাগেই মুখেই মাস্ক থাকলেও ঝুঁকিটা ছিল পাশাপাশি। ফলে এটাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনসমাগমের সঙ্গে মেলানো যায়না। কারণ ওখানে মাস্কবিহীন জনসমাগম আর এখানে ছিল ন্যূনতম সুরক্ষা সামগ্রীর উপস্থিতি। তাই এটার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হওয়া যাচ্ছে না, যা আমরা সচরাচর হয়ে আসছি।
কামরান জীবনে অনেক নির্বাচন করেছেন। তাকে নির্বাচনে বিজয়ী রাজনীতিক বলা হতো। কিন্তু শেষ দুই নির্বাচনে তিনি হেরেছিলেন। সর্বশেষ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আগে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন- এটাই তার জীবনের শেষ নির্বাচন। ওই সময় তার সে বক্তৃতার নানা দিক বিশ্লেষণ করে অনেকে মেয়র হিসেবে তার শেষ নির্বাচন ভাবলেও আরেক নির্বাচন পর্যন্ত তিনি যে বাঁচবেন না সে ভাবনা কারও মাথায় ছিল না। যেভাবেই হোক তার কথাটাই অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। আসছে দিনে সিটি করপোরেশনে আরও অনেক নির্বাচন আসবে কিন্তু কেউ চাইলেও তাকে পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে না তাকে প্রার্থী হিসেবে, কিংবা অন্য কোন প্রার্থীর পক্ষের ভোট চাওয়ার মানুষ হিসেবে।
তার পরিচিতি এতটাই ব্যাপক ছিল যে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান মানে মানুষের কাছে ভোট চাওয়ার এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি সিলেট বিভাগসহ দেশের নানা জায়গায় বিভিন্ন প্রার্থীর জন্যে ভোট চাইতে যেতেন। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে তাকে পাঠাত, বিভিন্ন জায়গার প্রার্থীরা তাকে চাইত, নিজেও অনেক প্রার্থীর প্রতি, দলের প্রতি প্রগাড় ভালোবাসায় উপস্থিত হতেন। তার ওইসব প্রচারণায় নিশ্চিতভাবেই উপকৃত হতেন প্রার্থীরা। ধারাবাহিক প্রচারণা এবং দেশে নানা জায়গায় তার উপস্থিতি সে প্রমাণ বহন করে।
সিলেট সিটির সাবেক মেয়র, মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পরিচয়কে ছাপিয়ে তিনি ❛জনতার কামরান❜ বিশেষণে নিজের আলাদা এক পরিচিতি দাঁড় করিয়ে নিয়েছিলেন। তার এই পরিচিতি মানুষের কাছে ছিল সম্মান আর ভালোবাসার। ফলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের তারচেয়ে উচ্চ পদের কেউ মঞ্চে থাকলেও তিনি ছিলেন স্বনামে প্রোজ্জ্বল। দলের নেতানেত্রী এবং সাধারণ মানুষের কাছে ওভাবেই বিষয়টি উপস্থাপিত হতো। এটা একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাফল্যের সূচক।
কামরানের মৃত্যুতে সিলেটবাসী কেঁদেছে, কেঁদেছে সারাদেশ। তার মৃত্যুতে বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন কিছু লোক ছাড়া প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও শোকাহত হয়েছে। তার মৃত্যুতে শোক জানাচ্ছে সমালোচকরাও। তাদের সকলের সম্মিলিত শোক ভাসিয়ে দিলাম নদী সুরমায়। সুরমা-কুশিয়ারা নদীসহ বিভাগের অগণন নদী ছুঁয়ে আছড়ে পড়ুক সেটা বঙ্গোপসাগরে। একজন কামরান, জনতার কামরানের জন্যে এত শোক মানুষের; এক সুরমা সে শোক কি ধারণ করতে পারে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)