ইভটিজিং প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ইভটিজিং বা উত্যক্তকরণকে ‘যৌন হয়রানি’ স্বীকৃতি দিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় প্রক্রিয়াধীন আইনটি দ্রুত প্রণয়ন করার দাবি জানানো হয়েছে।
বিশেষ এই দিনটি উপলক্ষে উইমেন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের (ডব্লিউজেএনবি) উদ্যোগে আজ মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত ‘উত্যক্তকরণের নানা রূপ: প্রতিরোধে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এই দাবি জানান।
আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, উত্যক্তকরণকে হালকা করে দেখার অবকাশ নেই। এটি যৌন হয়রানি এবং সামাজিক অপরাধও। তারা পরিবারে নারীর সম-মর্যাদা ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর আলোচনায় গুরুত্ব দেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন দিবসটি নিয়মিত পালনের উপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, যৌন হয়রানি প্রতিরোধের শিক্ষা পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। ছেলে শিশুদের পরিবারের নারী সদস্যদের সম্মান করার শিক্ষা দিতে হবে। আর মেয়ে শিশুকে বোঝাতে হবে সে মোটেও দুর্বল নয়।
অন্যান্যদের মধ্যে বক্তা স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক রঞ্জন কর্মকার উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় প্রক্রিয়াধীন যৌন হয়রানি বিরোধী আইনটি দ্রুত প্রণয়নের দাবি জানান। তিনি বলেন, উত্যক্তকরণের কুফল ও ভয়াবহতা উপলব্ধি করে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় দিবসটি ঘোষণা করলেও একবারই সেটা জাতীয়ভাবে পালন করেছে। অথচ প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দিবসটি নিয়মিত পালনের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সম্ভব।
জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফৌজিয়া খোন্দকার ইভা উত্যক্তকরণকে প্রাথমিক পর্যায়ের নির্যাতন হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, পরিবারে মেয়ে শিশুকে সাহসী করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে সে মাথা উঁচু করে প্রতিবাদ করতে শেখে। অন্যদিকে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউটের ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে প্রতিবাদ করা শেখাতে হবে। একইসঙ্গে পরিবার এবং সমাজেও সেই প্রতিবাদ সমর্থন করার চর্চা করতে হবে।
যৌন শিক্ষাকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং প্রজন্ম একাত্তরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ডা. নুজহাত চৌধুরী শম্পা। তিনি বলেন, ‘ঘরের শিক্ষায় আমরা আসলে ছেলে শিশুটিকে যতটা না বোনকে সম্মান করা শেখাই, তার চেয়ে বেশি শেখাই বোনের ওপর নজরদারি করা। পরিবারে, স্কুলে মানবিক শিক্ষা দিতে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার।’
আলোচনায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার চাপা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার নারীর প্রতি সব ধরণের সহিংসতার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে। কিন্তু সবকিছু সরকারের ওপর চাপিয়ে দিলে হবে না। ‘আমরা কী দায়িত্ব পালন করছি সেটিও বিবেচনা করতে হবে। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সবাইকে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে হবে,’ বলেন তিনি।
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট লীনা পারভীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উত্যক্ততা, হয়রানি বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘উত্যক্তকরণকে হালকাভাবে দেখা হয় বলেই এটি অপরাধ মনে করা হয় না। তাই আজ আমাদের ৮ মাসের শিশু থেকে বয়স্ক নারী ধর্ষণের ঘটনা দেখতে হচ্ছে। উত্যক্তকরণের চূড়ান্ত রূপই যে ধর্ষণ, সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না।’
নিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান বার্তা সম্পাদক শাহনাজ মুন্নী উত্যক্তকরণের নতুন নতুন রূপ ও ভয়াবহতার মাত্রার উপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে সাইবার আক্রমণের শিকার হচ্ছে নারী। অনলাইনে যৌন নিপীড়ণের ঘটনা ভয়াবহ অবস্থায় গিয়েছে। এখনই প্রতিরোধে জোর দিতে হবে। এ ব্যাপারে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সবাইকে সচেতন হতে হবে।
ডব্লিউজেএনবি ‘র সমন্বয়কারী আঙ্গুর নাহার মন্টির সঞ্চালনায় সভায় মূল প্রবন্ধে জেন্ডার বিশেষজ্ঞ লাভলী ইয়াসমিন জেবা যৌন হয়রানি প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেন। বলেন, ‘আমাদের পরিবারগুলোতে ছেলেরা নারীর প্রতি একটি হেয় ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠে। আর নারীর প্রতি সহিংসতা ও নারীকে হয়রানি করাকে তারা পৌরুষ বা শক্তির অংশ হিসেবে দেখে। এই অবস্থার পরিবর্তনে মানসিকতার পরিবর্তন দরকার।
ইভটিজিং প্রতিরোধ ও জনসচেতনতা তৈরিতে ১৩ জুনকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘ইভটিজিং প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১০ সালের প্রথমবারের মতো দিবসটি জাতীয়ভাবে পালনও করা হয়েছিল। তবে এরপর ইভটিজিং দিবস নিয়ে তেমন কথা শোনা যায়নি, যদিও বিক্ষিপ্তভাবে দিবসটি পালিত হয়।