রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যখন বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি কাজ করছে, সেই মুহূর্তে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা’র নামে কিছু বিবৃতি এবং টুইট গণমাধ্যমে আসছে, যেগুলো নতুন করে কিছু প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
সবশেষ গত ৭ জানুয়ারি রাখাইনে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আরসা নেতা আতাউল্লাহর একটি টুইট সংবাদ শিরোনাম হয়েছে, যেখানে তিনি বলেছেন, “রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের’ বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।” এই টুইটের দুদিন আগেই সেনাসদস্যদের বহনকারী একটি গাড়িতে হামলার অভিযোগ ওঠে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, আরসা ওই হামলার দায় স্বীকার করেছে।
রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সেখানে এই জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূলের কাজ করে যাচ্ছে। তবে গত বছরের আগস্টে নতুন করে সহিংসতা ও নিধন শুরুর পর যে নতুন ডাইমেনশন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা হলো ‘প্রতিরোধ’। বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে জার্মানির গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের এক খবরে বলা হচ্ছে, অন্যান্যবার পুরো পরিবারসহ রোহিঙ্গারা পালিয়ে এলেও এবার শরণার্থীদের দলে পুরুষদের সংখ্যা একেবারেই কম। পালিয়ে আসা অনেকেই বলেছেন, লড়াই করার জন্য পুরুষরা রয়ে গেছেন। আর এই প্রতিরোধের প্রশ্নটি যখন আলোচিত হচ্ছে তখনই সামনে আসে আরসা’র নাম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সংগঠনটি আসলেই রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে কাজ করছে নাকি তারা সেনাবাহিনীরই সৃষ্ট কোনো গোষ্ঠী যাদেরকে দিয়ে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে রোহিঙ্গা নিধনকে জায়েজ করছে মিয়ানমার?
প্রশ্নটি এ কারণে যে, আরসা নামে যে সংগঠনটিকে বলা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার, সেই সংগঠনের প্রধান আতাউল্লাহ এখন অবধি একটি রহস্যজনক চরিত্র। গত বছরের ২৬ আগস্ট বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মক্কায় থাকেন এমন জনাবিশেক নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা এই সংগঠনটি গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে এদের যোগাযোগ রয়েছে। সংগঠনটির নেতা আতাউল্লাহ ‘আবু আমর জুনুনি’ নামেও পরিচিত। আতাউল্লাহর বাবা রাখাইন থেকে পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান। সেখানেই আতাউল্লাহর জন্ম। তিনি বেড়ে উঠেছেন মক্কায়। সেখানে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন।
স্মরণ করা যেতে পারে, আফগানিস্তানে তালেবান শাসনামলে ওসামা বিন লাদেন এবং মোল্লা ওমরের মতো চরিত্রগুলোও খুব রহস্যেঘেরা ছিল। এই আলকায়েদা কারা কেন তৈরি করেছে, তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কী স্বার্থ, এখানে রাশিয়ার কী ভূমিকা ছিল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে যখন আরসা বা আতাউল্লাহর নামে কোন টুইট হয় এবং সেটিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গুরুত্বসহকারে প্রচার করে, সেখানে কিছু সংশয় তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক।
তবে এও ঠিক যে, মিয়ানমার সরকারের দ্বারা রাখাইনের মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা যেভাবে দশকের পর দশক ধরে হত্যা, ধর্ষণ ও জাতিগত নিধনের শিকার হচ্ছেন, যে ধরনের রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, তাতে তাদের অনেকের সশস্ত্র জঙ্গি মতাদর্শে ঝুঁকে পড়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, যখন কোন একটি রাষ্ট্র (মিয়ানমার) সে দেশের কোন একটি জাতিগোষ্ঠীকে (রোহিঙ্গা) নির্মূল করছে, তখন এই কাজকে বৈধতা দেয়ার জন্য তারা এমন কিছু কর্মকাণ্ড (কথিত জঙ্গি তৎপরতা) ঘটানোর চেষ্টা করবে যা ওই জাতিগোষ্ঠীর সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। মধ্যপ্রাচ্যে যে কারণে আইএস-এর মতো নৃশংস জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি করা হয়েছে, কথিত আরসা’র উত্থান বা জন্মের পেছনে সেই একই রাজনীতি থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এ জাতীয় ছোটখাট চরমপন্থি গোষ্ঠী তারা যাদের দ্বারাই সৃষ্ট হোক না কেন বা যে উদ্দেশ্যেই তারা সংগঠিত হোক না কেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এ জাতীয় সংগঠন যে আখেরে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না, তা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া সম্ভব। বরং এরকম সংগঠনের কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পুরো পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজর ঘুরিয়ে দিতে পারে।
রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সারা বিশ্বেই যে একটা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে, সেটি নস্যাৎ করে দিতে পারে আরসা বা এরকম কোনো সংগঠনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। কেননা মিয়ানমারের মতো একটি সামরিক শক্তিশালী দেশ যাদের পেছনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে শক্তভাবে রয়েছে রাশিয়া ও চীন এবং ভারতও যেখানে সরাসরি মিয়ানমারের বিপক্ষে নেই, তখন চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে, এমন ধারণা করাই বাতুলতা। বরং এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে এবং মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আরও ধীরগতি অবলম্বন করবে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপও মনে করে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংগঠিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান পুরো আরাকানের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। আবার মিয়ানমারের সরকারও যদি রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে নির্বিচার সামরিক বল প্রয়োগের মাধ্যমে এদের দমন করতে যায়, তাতে বরং সেখানে চক্রাকারে সহিংসতার মাত্রা আরও বাড়বে।
ফলে যখন রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে অর্থাৎ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ কাজ করছে এবং প্রাথমিকভাবে এক লাখ রোহিঙ্গার তালিকাও করা হয়েছে, সেই সময়ে কথিত আরসার এইসব বিবৃতি বা হুমকি-ধামকি পুরো প্রক্রিয়াকেই বানচাল করতে পারে। এমনকি রোহিঙ্গাদের প্রথম চালান মিয়ানমারে যাওয়ার আগেই গত বছরের আগস্টের মতো পরিস্থিতি আবারও মিয়ানমার সেনাবাহিনী শুরু করবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
কেননা মিয়ানমার (বিশেষ করে সে দেশের সেনাবাহিনী) যে রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় না, তা দশকের পর দশক ধরে তাদের কর্মকাণ্ডে প্রমাণিত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়েও এরইমধ্যে অনেক সংবাদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসেছে। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান তথা তাদের প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া যখন চলছে (শেষ পর্যন্ত কতজন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে, সেই সন্দেহ সত্ত্বেও) তখন আরসা বা অন্য কোন চরমপন্থি সংগঠনের নামে বিবৃতি বা হুমকি-ধামকি দিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটি জটিল ও স্থবির করে দেয় কি না, সে বিষয়েও আমাদের সতর্ক থাকা দরকার। আরসা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এসব কাজ করছে নাকি রোহিঙ্গা সংকট জিইয়ে রাখতে তাদের দিয়ে এসব করানো হচ্ছে, সে বিষয়েও সচেতন থাকা দরকার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)