‘পৃথিবীর ফুসফুস’খ্যাত ব্রাজিলের অ্যামাজন জঙ্গল যখন পুড়ছে, তখন বাংলাদেশের উচ্চ আদালত একটি নির্দেশনা দিয়ে সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটার সংকটাপন্ন এলাকার মধ্যে কী কী স্থাপনা রয়েছে, তার তালিকা চেয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের আগস্টে হাইকোর্ট একটি নির্দেশনা দিয়ে বলেছিলেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে নতুন কোনো শিল্পকারখানা স্থাপন করা যাবে না। সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কতটি শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে, তার তালিকাও আদালত ছয় মাসের মধ্যে দাখিল করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। দুই বছর পরে আদালত ওই ১০ কিলোমিটারের মধ্যে সব ধরনের স্থাপনার তথ্য চাইলেন। প্রসঙ্গত, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন এবং এর চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে।
অ্যামাজনের আগুন ইস্যুতে যখন ফেসবুকে নানারকম মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া,তখন কেউ কেউ এমন প্রশ্নও তুলেছেন, যারা সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গল অ্যামাজনের আগুনে দুঃখ পাচ্ছেন, তারা নিজের দেশের সুন্দরবন সংলগ্ন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন?
এখন প্রশ্ন হলো, অ্যামাজনে কী হচ্ছে। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্পেস রিসার্স (আইএনপিই) বলছে, এ বছর জুন পর্যন্ত ব্রাজিলে ৭২ হাজার ৮৪৩টি অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি আগুনের ঘটনা অ্যামাজন জঙ্গলে, যা আগের বছরের তুলনায় ৮০ শতাংশ বেশি। ২৩ আগস্ট বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, দাবানলে প্রতি মিনিটে বনের ১০ হাজার বর্গমিটার এলাকা পুড়ে গেছে। অ্যামাজনের এই আগুনকে আন্তর্জাতিক সংকট বলছে ফ্রান্স। উদ্বেগ জানিয়েছে সারা বিশ্ব। উদ্ভূত পরিস্থিতি সেখানে সেনাবাহিনী পাঠায় ব্রাজিলের সরকার।
তবে এই আগুনের জন্য দায়ী করা হচ্ছে কথিত উন্নয়নকে। গরুর মাংস রপ্তানিতে ব্রাজিল এক নম্বর দেশ। গত বছর তারা ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন গরুর মাংস রপ্তানি করে। দেশটির ৩০টি প্রতিষ্ঠান গরুর মাংস রপ্তানির সাথে যুক্ত। পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, গরুর খামার বানাতে আগুন দিয়ে অ্যামাজন উজাড় করছে ব্রাজিল। তারা গরুর মাংস রপ্তানি করে আয় বাড়াতে চায়। এজন্য অ্যামাজন বনের সাড়ে ৪ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে গোচারণভূমিতে পরিণত করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, সোনা-রুপা-হীরা ছাড়াও তেল-গ্যাস প্রভৃতি মূল্যবান খনিজ পদার্থের ভাণ্ডার এই অ্যামাজন। এসব খনিজ পদার্থ অন্বেষণের জন্য গাছপালা কেটে এবং আগুন দিয়ে বন পুড়িয়ে সাফ করা হয়। এমন অভিযোগও রয়েছে যে, আমাজন পোড়ানোর এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়েই ক্ষমতায় আসেন ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বলসোনারো। তার নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায়ও অনেক বক্তব্য ছিল আমাজনকে ঘিরে এবং তা কথিত ‘বন উন্নয়নের’ ইস্যুতে। অর্থাৎ কথিত উন্নয়নের বলি হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এই চিরহরিৎ বন।
এরকম বড় ঘটনায় রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান অথবা সরকারের কর্তারা অনেক সময়ই নিজের দায় এড়াতে যে চটুল ও উদ্ভট মন্তব্য করেন, তারও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে মি. প্রেসিডেন্টের একটি মন্তব্যে। তিনি বলেছেন, এনজিওরা অ্যামাজনে আগুন দিয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, আমাদের দেশেও অনেক সময় রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা ও দুর্বলতা ঢাকতে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ও এনজিওদের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হাজির করা হয়।
কিন্তু পরিবেশবাদীরা স্পষ্টতই বলছেন যে, অ্যামাজনকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করার সরকারি নীতির কারণেই আগুন লাগানোর মহোৎসব শুরু হয়েছে। কেননা এ বছর অ্যামাজনের জলবায়ু বা বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নিয়ে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। সুতরাং এই আগুনকে মানবসৃষ্ট নাশকতা বলেই মনে করা হচ্ছে যার পেছনে রয়েছে কথিত উন্নয়ন। কিন্তু এই উন্নয়নের মূল্য দিতে হবে পুরো বিশ্ববাসীকে। কারণ দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন নদের তীরের ১০টি দেশের প্রায় ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে যে বন, সেই অ্যামাজন প্রতি বছর ২০০ কোটি টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। যে কারণে এই বনকে বলা হয় ‘পৃথিবীর ফুসফুস’। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হারকে ধীর করতে আমাজনের ভূমিকাকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। যে কারণে এবারের এই আগুনকে সারা পৃথিবীর জন্যই সংকট বলে হুঁশিয়ার করেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। যদিও এর পাল্টা জবাবও দিয়েছে ব্রাজিল সরকার। তাদের দাবি, অ্যামাজনের আগুন ইস্যুতে তার দেশের ওপর হস্তক্ষেপ করতে চায় বিদেশিরা।
অ্যামাজনের আগুনের প্রসঙ্গ পাশে রেখে আমরা বরং আমাদের রাজধানী ঢাকা শহরের ভেতরের বিভিন্ন বস্তিতে নিয়মিত বিরতিতে আগুনের প্রসঙ্গ তুলতে পারি। কেন ঢাকার বস্তিগুলোয় আগুন লাগে? মনে রাখা দরকার, প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পরেই তদন্ত কমিটি হয় এবং তারা হয়তো একটা রিপোর্টও দেয়। কিন্তু সেই রিপোর্ট আর আলোর মুখে দেখে না। আবার অনেক সময়ই আগুনের কারণ হিসেবে সিলিন্ডারের গ্যাস থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে উল্লেখ করা হলেও পরিকল্পিতভাবে যে বস্তিতে আগুন দেয়া হয় এবং তার পেছনেও যে থাকে কোনো এক বা একাধিক গোষ্ঠীর কথিত উন্নয়ন ও পয়সার খেলা, তা রিপোর্টে আসে না।
অভিযোগ আছে, বস্তিতে আগুন দিয়ে সেখান থেকে মানুষ তাড়িয়ে বহুতল ভবন নির্মাণের পাঁয়তারা চলে। অনেক সময় বস্তিতে চাঁদাবাজি ও মালিকানার বিরোধীর জেরেও আগুন লাগে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন বস্তিতে সেই দলের চ্যালাচামুন্ডুরা বস্তির নিয়ন্ত্রণ নেয়। মনে রাখা দরকার, বস্তিতে যে নিম্ন আয়ের লোকেরা থাকে তারাও ভোটার। আবার এদের মধ্যে অনেকে মাদক ও অন্যান্য অপরাধের সাথেও যুক্ত থাকে। অর্থাৎ বস্তি শব্দটি শুনতে অন্যরকম হলেও এখানে প্রচুর টাকা-পয়সার খেলা চলে। সেটিও আরেক উন্নয়নের গল্প। সুতরাং কোন বস্তিতে কেন আগুন লাগলো সেটি সব সময় পরিষ্কার জানা যায় না।
একটা নিজের অভিজ্ঞতা বলতে পারি। ২০১৬ সালের ৪ মে আমার বাসার ঠিক উল্টো দিকে রাজধানীর গ্রিন সুপার মার্কেটের পেছনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ শিক্ষকদের আবাসিক এলাকার ভেতরের বস্তিতে আগুন লাগে। সকালে প্রতিবেশীর কলিং বেল আর অব্যাহত দরজা ধাক্কানোর শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙে। দরজা খুলে দেখি সবার চোখেমুখে আতঙ্ক। আমরা তখনও ঘুমে ছিলাম। তারপর বারান্দায় গিয়ে দেখি ধোঁয়ায় চারপাশ আচ্ছন্ন। ধূসর ও কালো রঙের ধোঁয়া ধেয়ে আসছে আমাদের ঘরের দিকেই। তখন আমার কন্যার বয়স এক বছরের কিছু বেশি। ফলে ওকে নিয়ে আমি ও আমার স্ত্রী দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে যাই। ঘণ্টা দুয়েক পরে বাসায় ফিরি। যখন আগুনের লেলিহান শিখা আর দেখা যায়নি।
এই ঘটনা নিয়ে ওইদিন প্রথম আলোয় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় যার শিরোনাম ছিল ‘স্বপ্ন পুড়ে ছাই’। আনোয়ারা বেগম (৫০) নামে এক নারীর গল্প। যিনি ছেলেদের বিভিন্ন মেসে রান্নার কাজ করতেন। রোজগারের টাকা একটু একটু করে জমিয়ে ৭০ হাজার টাকা রেখেছিলেন ট্রাঙ্কের ভেতর। কিছুদিনের মধ্যে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করে এই টাকা জমাতেও চেয়েছিলেন। স্বপ্ন ছিল আরও কিছু টাকা জমলে এই শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাবেন। কিন্তু আগুনে তার সেই স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
বস্তিতে যখন আগুন লাগে তখন এরকম স্বপ্নপোড়ার গল্প অনেক তৈরি হয়। সেই গল্পের আড়ালে থাকে উন্নয়নের অন্য গল্প। এই বস্তির আগুনের পেছনেও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ। অনেক জায়গায় বস্তির ঘর পোড়ার পরে সেখানে নতুন করে মানুষ থাকতে শুরু করে। কিন্তু আমবাগানের এই বস্তি পোড়ার পর সেখানে সত্যি সত্যিই বহুতল ভবন উঠেছে।
বলা হয়, গরিব মানুষকে উচ্ছেদ করার জন্য আগুন হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে উচ্ছেদ করতে গেলে সেখানে সংঘাত অনিবার্য। কিন্তু রাতের আঁধারে আগুন ধরিয়ে দিলে কেউই সেটা জানবে না। কেউ চ্যালেঞ্জও করবে না। সঠিক তদন্তও হবে না। তদন্ত হলেও তা আলোর মুখ দেখবে না। আনোয়ারা বেগমদের তিল তিল করে জমানো টাকা ছাই হয়ে যাবে এবং চোখের জল সম্বল করে লোকাল বাসে চড়ে যেই গ্রাম থেকে এসেছিলেন সেখানে চলে যাবেন, অথবা অন্য কোনো বস্তিতে। এবং তারা চলে গেলে লেখা হবে উন্নয়নের নতুন গল্প। যেমন গল্প লেখা হচ্ছে অ্যামাজনে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)