বছরের প্রথম বৃষ্টিকে আমার প্রথম প্রেমের মতোই আজীবন কাঙ্ক্ষিত মনে হয়। আর সে বৃষ্টি যদি হয় এই ধূলিধুসরিত নগরীর প্রথম বৃষ্টি তাহলে তাকে নিয়ে অনেক আহ্লাদ, অনেক কথা থাকবেই।
এতো বড় একটা শহর। এতো এতো মানুষ। উত্তর থেকে দক্ষিণে তার দুটি সিটি করপোরেশন। উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের অকাল প্রয়াণ হয়েছে। তার শূন্যস্থানে নতুন কেউ আসার পথে আইনী জটিলতার অবসান হয়নি এখনো। তিনি নগরবান্ধব, নাগরিকবান্ধব মেয়র ছিলেন। তার কিছু পরিকল্পনা-স্বপ্ন ছিলো এই শহর নিয়ে। তার সেসব ইচ্ছে-অসমাপ্ত কাজ বাস্তবায়ন করা হবে এমন প্রতিশ্রুতি এখন অনেকে দিচ্ছেন বটে; তবে তার মতো উদ্যোমী হতে পারবেন কী না তা নিয়ে সংশয় আছে অনেকের।
আর দক্ষিণের মেয়র, তিনি জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ হানিফের ‘জনপ্রিয়’ পুত্র সাঈদ খোকন। হয়তো আনিসুল হকের মতো তিনি অতো স্বপ্ন দেখেন না ঢাকাকে নিয়ে তবুও তিনি বসে আছেন এটা বলা যাবে না। তারপরও প্রশ্ন তুলতেই পারি; সত্যি কি এই শহরে কোনো মেয়র আছেন এখন, আছেন ‘নগরপিতা’। থাকলে একটি শহর এভাবে আটপ্রহর ধূলায় তলিয়ে থাকে কী করে? ঢাকা কেন বায়ুদূষণে রেকর্ড নগরী হয়?
খুব ভোরে, তারপর সূর্য উঠার একটু আগে শহর যেখানে নির্মল বায়ুতে ভরা থাকার কথা; সেখানে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীরা শত শত ঝাড়ু হাতে রাজপথে শুয়ে থাকা ধূলাদের উড়িয়ে দিতে থাকে। নগরীর দিন শুরুর এই সময়টা ঝাড়– দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি ছিটিয়ে দেয়ার কাজটিতো সিটি করপোরেশনের। পৃথিবীর নানান দেশে এমনটিইতো হয়। শহরে ধূলা উড়বে আর আর সে শহরের মেয়র ফুলবাবু সেজে ঘুরে বেড়াবেন, বলবেন-‘টাকা কোনো সমস্যা নয়’- এটা কাজের কথা নয়। আমি জেনে-বুঝে দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, মেয়র সাঈদ খোকন ব্যবসা এবং নানান কাজে পৃথিবীর অনেক শহর দেখেছেন; তো নিশ্চয় জানেন সেসব শহর দেখতে কেমন, কেমনে চলে। তাহলে ঢাকার যে অংশের মেয়র তিনি সেভাবে সাজানোর চেষ্টা করছেন না কেনো? কেনো এই শহরে ধূলা-দূষণের জন্য আমরা, আমাদের সন্তানরা বুকভরে শ্বাস নিতে পারি না?
আর উত্তরের, জটিলতা কেটে গেলে নতুন মেয়র হবেন। আগামীর সেই মেয়রের জন্যও একই প্রশ্ন। আর মধ্যবর্তী কথা হচ্ছে- আনিসুল হক নেই; কিন্তু প্যানেল মেয়রতো আছেন। নিয়মিত কাজতো চলছে। তাহলে নগরীর এই পরিস্থিতি কেনো?
ঠিক এমনি যখন অনেক অনেক প্রশ্ন, তখন ফাল্গুনের এক শেষ রাতে ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টি নগরে প্রাণ এনে দিলো। গাছে গাছে জমে থাকা ধুলো বৃষ্টিছোঁয়ায় গলে গলে পড়লো। আমের মুকুল বৃষ্টিতে ধুয়ে ঘ্রাণ ছড়ালো। প্রেমিক প্রথম বৃষ্টির বার্তা পাঠালো তার বোধের সঙ্গীকে। ফেসবুক ভরে উঠলো প্রথম বৃষ্টি বন্দনায়। দেখে-শুনে-ভেবে মনে হলো এই শহরে দীর্ঘ, দীর্ঘ সময় ধরে এই বৃষ্টি ছিলো অনেক চাওয়ার এক ধন! এতো দিন ধুলো-ময়লায় শহরটা কেমন মলিন, প্রাণহারা, বিশ্রী হয়ে ছিলো। একটু ঝড়ো হাওয়ার মিশ্রিত বৃষ্টিতে সব উড়ে গিয়ে, ধুয়ে গিয়ে ঝিলিক দিয়ে উঠলো সে। খুব সকালে দরজা খুলে বুকভরে বাতাস নেয়া গেলো।
গেলোবার বৃষ্টিরকাল একটু লম্বা ছিলো সত্য। তবে বৃষ্টিহীন শীতে নগর রূপ নিয়েছিলো ‘মুখোশ নগরী’-তে। ধূলার হাত থেকে রেহাই পেতে নগরবাসী মাস্ক পরে বের হতেন। মাস্ক বিক্রি হতো পথে পথে। ধুলোর ছোবল খেয়ে ঘরে ঘরে অসুস্থজনের সংখ্যা বাড়ছিলো। সেই ত্রাহি অবস্থা থেকে বাঁচাতে বসন্তের বৃষ্টি ত্রাণা হয়ে এলো।
তাই, তাই নগরে প্রথম বৃষ্টিকে অভিবাদন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)