এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ
ছোটবেলায় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ গোয়েন্দা চরিত্রটির প্রেমে পড়েনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। ‘গরীবের নাম ব্যোমকেশ বক্সী, ডিডেক্টিভ নয় সত্যান্বেষী’ লাইনটি শুনলেই আমাদের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে হাজারো রহস্য উদঘাটনের দুর্দান্ত সব গল্প।
একবিংশ শতাব্দীতে এই বিশ্বায়নের যুগে থেমে নেই সত্যান্বেষণও। বর্তমানকালে যা আমরা ‘ইনভেসটিগেটিভ জার্নালিজম’ বা ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা’ বলে জানি। দায়িত্বশীল দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করলে বলা যায়, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার লক্ষ্য হলো আশপাশের পৃথিবীটাকে সংস্কার করা। এটা এক ধরণের দায়িত্বশীলতা যাতে সত্য আবিষ্কারের মাধ্যমে পাল্টে দেওয়া যায় বিশ্বটাকে। রাষ্ট্র-সমাজ ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ শক্তিশালী করতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
বিশ্ব পরিমণ্ডলে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা বের করে এনেছে গোপন সত্য যা পরিবর্তন করেছে দৃশ্যপট, রচনা করেছে ইতিহাস। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: ফ্রান্সের ‘কন্টামিনেটেড ব্লাড অ্যাফেয়ার’ প্রতিবেদনটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ইতিহাসে ভীষণভাবে আলোচিত। রিপোর্টের অ্যান মেরি ক্যাস্টারেটের সঙ্গে একজন হেমোফিলিয়া রোগী যোগাযোগ করে জানান, এইডস রোগের সময় ফরাসী সরকারের একটি সংস্থা হেমোফিলিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের কাছে এইডস ভাইরাস সংক্রমিত রক্ত থেকে তৈরি উপাদান বিক্রি করছে। পরবর্তীতে ক্যাস্টারেটের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে, ওই দপ্তরের বিবৃতিতে দেয়া তথ্যগুলোর সমর্থনে যথাযথ কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী, ইতোমধ্যে সংক্রমিত কোনো মানুষকে পুনরায় আক্রান্ত করা ঘোরতর অপরাধ। ওই সংস্থার উৎপাদিত সব পণ্যই এইডসে আক্রান্ত ছিল বলে পরে তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে আরও ভয়ংকর তথ্য পাওয়া যায়, ওই সংস্থাটি তাদের সেই সংক্রমিত পণ্যের মজুদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিক্রি বন্ধ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ৪ বছর ধরে করা এই প্রতিবেদনের সার্থকতা কোথায়? এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার ফলে বেশ কিছু সম্ভ্রান্ত বেশধারী অপরাধীকে কারাগারে পাঠানো সম্ভব হয়। কিছু ভুক্তভোগী মানুষ এটা জেনে শান্তি পান যে তারা একা নন, তাদের পাশে মানুষ আছে৷ এমনকি এই প্রতিবেদন প্রকাশের ফলে তথ্য গোপন করার অভিযোগে ফরাসী সরকার নির্বাচনে হেরে যায় এবং দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়।
ঠিক একইভাবে ১৯৭২-৭৪ এর ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডাল, ২০০১ সালের এনরন স্ক্যান্ডাল, ২০০২ সালের বোস্তন গ্লোব স্পটলাইট অনুসন্ধান, ২০১৩ সালের এডওয়ার্ড স্নোডেনের সহযোগীতায় এনএসএ’র ক্লাসিফাইড ডকুমেন্টস প্রকাশ, ২০১৬ সালের পানামা পেপারস, ২০১৯ সালের ওয়াশিংটন পোস্টের আফগানিস্তান পেপারস —উপরের ঘটনাগুলো সাড়া ফেলেছিল বিশ্বব্যাপী।
পাশাপাশি আমাদের দেশের কথা চিন্তা করলে সম্প্রতি নাটোরের সাংসদের বিলাসবহুল বাড়ি ও বিপুল সম্পদ গড়ার তথ্য নিয়ে সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল ইমরানের করা প্রতিবেদন ‘জান্নাতী প্যালেস’, আসাদুজ্জামানের ‘সাইবার অপরাধ’ প্রতিবেদন, অপূর্ব আলাউদ্দীনের নিলামে ‘মহাসড়ক’ ও ‘মহাসড়ক উদ্ধারে তোড়জোড় : মাঠে নামছে তদন্ত কমিটি’ এবং ‘খুলনা ওয়াসার প্রকল্প নিয়ে আবুল হাসান হিমালয়ের অনুসন্ধান’ দেশব্যাপী সাড়া ফেলেছে। পেয়েছে টিআইবি পুরষ্কারও। তাছাড়াও সাইদুর রহমান আবিরের করা ‘নেই সনদ তবুও ডাক্তার’ শিরোনামের এই প্রতিবেদনটির মাধ্যমেও স্বাস্থ্যখাতের সকলেই বেশ নড়েচড়ে বসেছিল।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকের কাজই হলো সাপের লেজ দিয়ে কান চুলকানো, যদিও এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ তবুও বলতেই হয় এই সাংবাদিকতার ধারা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম।তবে সৎ সাংবাদিকতা এক্ষেত্রে ভীষণ জরুরি। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ও ব্যক্তিস্বার্থকে পরিহার করে নিরপেক্ষ, সত্য ও বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রেখেই কাজ করে যেতে হবে সমাজের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে। তবেই উদঘাটিত হবে সত্যিকারের সত্য।
যুগে যুগে বেঁচে থাকুক সত্য, সত্যান্বেষণ ও সত্যান্বেষীরা। মূলত তারা সাবলীলভাবে এগিয়ে যেতে পারলেই এ সমাজ, এ দেশের জনগণ বেঁচে থাকার স্বার্থকতা খুঁজে পাবে।
(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)