‘জাতিগতভাবে নির্মূল’ তথা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক হাজার হাজার মুসলিম রোহিঙ্গাকে হত্যার প্রায় সাত বছর পর সেই সেনাবাহিনী এখন রোহিঙ্গাদের সাহায্য চাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এবং পাঠানো হচ্ছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী’র বিরুদ্ধে জান্তার পক্ষে লড়াইয়ের জন্য।
সোমবার (৮ এপ্রিল) বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার থেকে এ তথ্য নিশ্চিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের অন্তত ১০০ জনকে সাম্প্রতিক সপ্তাহে যুদ্ধরত জান্তার পক্ষে লড়াই করার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়াও পরিবর্তন করা হচ্ছে তাদের নামও।
তিন সন্তানের জনক ৩১ বছর বয়সী রোহিঙ্গা ব্যক্তি মোহাম্মদ বলেন, ‘আমি ভীত ছিলাম, কিন্তু আমাকে যেতে হয়েছিল।’ তিনি রাখাইনের রাজধানী সিত্তওয়ের কাছে বাও দু ফা ক্যাম্পে থাকেন। গত এক দশক ধরে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত অন্তত দেড় লাখ রোহিঙ্গা আইডিপি ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য হয়েছে।
মোহাম্মদ বলেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ক্যাম্পের নেতা গভীর রাতে আমার কাছে আসেন। আর বলেছিলেন, আমাকে প্রশিক্ষণে যেতে হবে, এটি সেনাবাহিনীর আদেশ। আর যদি না যায়, তাহলে পরিবারের ক্ষতি করার হুমকি দেয়া হয়েছিল বলেও জানান তিনি।
বিবিসি প্রতিবেদক বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছেন, মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তারা ক্যাম্পের চারপাশে ঘুরছেন এবং তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য রিপোর্ট করার নির্দেশ দিচ্ছেন।
মোহাম্মদের মতো পুরুষদের জন্য ভয়ানক বিষয় হচ্ছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা এখনও নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত। আর নিজস্ব সম্প্রদায়ের বাইরে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার মতো বৈষম্যমূলক বিধিনিষেধের একটি ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার তারা।
২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যের মিশ্র সম্প্রদায় থেকে কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। আর তাদেরকে নির্ধারিত এসব শিবিরে বসবাস করতে বাধ্য করা হয়েছিল। পাঁচ বছর পর ২০১৭ সালের আগস্টে, সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে নৃশংস জাতিগত নিধন অপারেশন শুরু করে। সেই নিধন অপারেশনে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছিল। ধর্ষণ করা হয় তাদের নারীদের। এছাড়াও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের গ্রাম। ওই সময় অন্তত ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের এমন নিষ্ঠুর আচরণের জন্য মিয়ানমার এখন হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার বিচারের মুখোমুখি।
সম্প্রতি আরাকান আর্মি নামক একটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কাছে রাখাইনে বিশাল এলাকা হারানোর পর নির্যাতনকারী সেই সেনাবাহিনী এখন রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক নিয়োগ নিচ্ছে। এটি তাদের জন্য আরেকটি হতাশার চিহ্ন। এরইমধ্যে রাখাইনে সেনাবাহিনীর কামান ও বিমান হামলায় কয়েক ডজন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে।
দেশের অন্যান্য অংশে বিরোধী বাহিনীর আক্রমণে সামরিক বাহিনীর উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে, আত্মসমর্পণ করেছে। তবে রোহিঙ্গাদের মধ্যে খুব কম লোকই আছে, যারা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিতে চায় একটি অজনপ্রিয় শাসনের জন্য।
আর রোহিঙ্গাদের আশঙ্কা যে তাদের আবার টার্গেট করা হচ্ছে। মূলত যুদ্ধে কামানের খোরাক বানাতে চাচ্ছে রোহিঙ্গাদের। যেখানে জান্তা হেরে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
সিত্তওয়েতে ২৭০তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়নের ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মোহাম্মদকে। তিনি বলেন, অথচ ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় বিতাড়িত হওয়ার পর থেকে রোহিঙ্গাদের শহরে বসবাস করা নিষিদ্ধ করা হয়।
মোহাম্মদ বলেন, আমাদের শেখানো হয়েছিল কীভাবে বুলেট লোড করতে হয় এবং গুলি করতে হয়। এছাড়াও তারা আমাদের দেখিয়েছে কিভাবে একটি বন্দুককে বিচ্ছিন্ন করা এবং পুনরায় একত্রিত করা যায়।
বিবিসি’র দেখা একটি ভিডিওতে রোহিঙ্গাদের অন্য একটি দলকে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা ব্যবহৃত একটি পুরানো স্ট্যান্ডার্ড অস্ত্র বিএ-৬৩ রাইফেল কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তা শেখানো হচ্ছে।
মোহাম্মদকে দু’সপ্তাহের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, তারপর তাকে বাড়ি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু মাত্র দু’দিন পর তাকে আবার ডাকা হয়। আর ২৫০ জন সৈন্যের সাথে একটি নৌকায় চড়ে পাঁচ ঘণ্টা নদীতে রাথেদাউং পর্যন্ত নিয়ে যায়। সেখানে তিনটি সামরিক ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণের জন্য আরাকান সেনাবাহিনীর সাথে বিরোধী বাহিনীর একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চলছিল।
তিনি বলেন, আমি জানতাম না কেন আমি যুদ্ধ করছি। যখন তারা আমাকে একটি রাখাইন গ্রামে গুলি করতে বলে, তখন আমাকে গুলি করতে হয়। সেখানে আমি ১১ দিন যুদ্ধ করি। আমাদের অবস্থান করা একটি কুঁড়েঘরে শেল পড়ার পর খাদ্যের অভাব দেখা দেয়। এছাড়াও সেখানে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা সেনা আহত হয়। আর তিনজন নিহত হয়। আমি তখন খুব ভয়ে থাকতাম।
মোহাম্মদ আরও বলেন, যখন যুদ্ধের মাঝখানে ছিলাম আমি পুরো সময় আতঙ্কিত ছিলাম। আমার পরিবারের কথা ভাবতে থাকি। কখনই ভাবিনি আমাকে এভাবে যুদ্ধে যেতে হবে। আমি শুধু বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম। মনে হচ্ছিল মায়ের গর্ভ থেকে আবার জন্ম নিচ্ছি।