রাজধানীতে মাস দুয়েক আগে নতুন ফ্ল্যাটে তেলাপোকার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে বারিধারার ডিসিএস অর্গানাইজেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়েছিলেন মোবারক হোসেন। সকালে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা এসে কাজ শুরুর করার আগেই দুই সন্তান ও স্ত্রীকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেন তিনি। প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা বলেছিলেন, তিন ঘণ্টা পর ঘর ব্যবহারযোগ্য হবে। তবে প্রায় ১০ ঘণ্টা পর বাড়িতে ঢুকে কীটনাশকের তীব্র ও ঝাঁঝালো গন্ধ টের পেয়েছিলেন মোবারক হোসেন। তার পরের ঘটনা সবারই জানা। পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটির অজ্ঞতা ও ভুল কীটনাশক প্রয়োগের কারণে দুই শিশু সন্তান শাহিল মোবারত জায়ান (৯) ও শায়েন মোবারত জাহিন (১৫) মারা যায়।
দেশের অন্যান্য শহরেও অবৈধ পেস্ট কন্ট্রোল ব্যবসায়ীদের কারণে এরকম দুর্ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় ছারপোকা নিধনে প্রয়োগ করা কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় রহিমা আক্তার (২৪) ও ফজিলা আক্তার (১৬) নামের দুই বোনের মৃত্যু হয়। ওই কীটনাশক বাসায় দেয়ার পর রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে গেলে দু’জনেরই শ্বাস কষ্ট ও বমি শুরু হয়। দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেল পরদিন দুপুরে তাদের মৃত্যু হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফেসবুক-ইন্সটাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে ভোক্তারা বিভ্রান্ত হন। তবে রাজধানীতে দুই শিশুর অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর কারণে এখন অনেকে নাগরিক সচেতন হয়েছেন। নিবন্ধিত পেস্ট কন্ট্রোল ব্যবসায়ীরা বলছেন, অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক প্রচারণায় প্রতারিত হয়ে নিজেদের জীবন হুমকির মধ্যে ফেলছেন অনেকেই। সরকারের উচিত এই অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া।
পুলিশ জানিয়েছে, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান অব্যাহত আছে।
অনিবন্ধিত পেস্ট কন্ট্রোলের বিজ্ঞাপনে সয়লাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুললেই চোখে পড়ে বিভিন্ন পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানের চটকদার বিজ্ঞাপন। ভোক্তারাও না জেনে বুঝে তাদের ফাঁদে পড়েন। চ্যানেল আই অনলাইনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি পেস্ট কন্ট্রোলের ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করা হয়। সেখানে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের কীটনাশক পণ্য সবচেয়ে সেরাসহ ব্যবহারবিধি প্রতিবেদককে জানান। তবে লাইসেন্সের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তারা প্রতিবেদককে ব্লক করে দেয়। তাদের যোগাযোগের নম্বরে ফোন দিলেও কেউ সাড়া দেন নি।
আমানাতান (Aamanatan) নামের একটি ফেসবুক পেজ উইপোকা, ছারপোকা, তেলাপোকা, ইঁদুর, টিকটিকি নিধনের কীটনাশকের বিজ্ঞাপনে সয়লাব। বিভিন্ন স্প্রে, তরল স্প্রে, শক্তিশালী আঠা, জেল, ম্যাজিক স্প্রের বিজ্ঞাপনে তারা ভোক্তাদের আকৃষ্ট করছে। তারা চায়না ও থাইল্যান্ড থেকে এসব কীটনাশক নিয়ে আসেন বলেও জানায়। কীটনাশকের ব্যবসা করা পেজটি ঘুরে দেখা যায়, রমজান মাসে তারা ভিয়েতনাম ও মালি থেকে জুস ও শরবত জাতীয় পণ্য এবং ঘি বিক্রি করেছে।
বিভিন্ন পোকামাকড় দমনে কীটনাশক পরিবার ও শিশুদের জন্য কতোখানি নিরাপদ জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ‘যে কোন কীটনাশকই বিষ। ওই কীটনাশক শিশুদের নাগালের বাইরে রাখাই ভালো। পণ্যের কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তবে বিষাক্ত কীটনাশকে শিশুরা যেন মুখ না দেয়, সেটা পরিবারের দেখা উচিত।’
বালাইনাশকের কোন লাইসেন্স প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে কিনা জানতে চাইলে উত্তর জানা যায়নি। পরে প্রতিষ্ঠানটির ফোন নম্বরে একাধিকবার ফোন দিলেও সাড়া দেয়নি কেউ।
পিছিয়ে নেই ফুটপাত ও ভ্যান ব্যবসায়ীরাও
রাজধানীর ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজারে সন্ধ্যার পর থেকে ভ্যানে কিংবা চেয়ার টেবিল নিয়ে বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করে বিক্রি করা হয় বিভিন্ন ছারপোকা ও উইপোকা দমনের কীটনাশক। ফার্মগেটে এমনই এক বিক্রেতার সঙ্গে কথা হয়। জসিম নামের ওই বিক্রেতা জানান, তিনি শুধু বিক্রি করে থাকেন। লালবাগ থেকে কেনেন। কীটনাশকের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি অবগত নন।
দেখা যায়, ডিজিটাল মশা-তেলাপোকা-ছারপোকা বিনাশ করা এই কাঠির প্রস্তুতকারক মারুফ অ্যান্ড কোম্পানি। মোড়কের গায়ে শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন ও চোখে-মুখে ব্যবহার করা যাবে না এসব লেখার পাশাপাশি টিআইএন ও ট্রেড লাইসেন্স নম্বর দেওয়া রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওইসব নম্বর অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের।
এছাড়াও ফার্মগেটের বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ মনোহারি দোকানে উইপোকা তেলাপোকা মারার কীটনাশক বিক্রি করতে দেখা গেছে। এগুলোর বেশিরভাগের ট্রেড লাইসেন্স নম্বর জালিয়াতি করা।
উদ্বিগ্ন নিবন্ধিত ব্যবসায়ীরা
নিবন্ধনকারী পেস্ট কন্ট্রোল (বালাইনাশক) প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বত্বাধিকারীরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
ইউএস পেস্ট কন্ট্রোল নামের প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী হারুন অর রশীদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: বাসা বাড়িতে কোন প্রতিষ্ঠান বালাইনাশক দিচ্ছে এটা সরকারের নজরদারিতে থাকা উচিত। যে প্রতিষ্ঠানটি যে এলাকায়, ওই এলাকার থানা পুলিশের মাধ্যমেও খোঁজ নিতে পারে যে প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সসহ অন্যান্য কাগজাদি আছে কিনা। আর যারা অনলাইনে অনিবন্ধিত ভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে, তাদের বিষয়ে আরো কঠোর হওয়া প্রয়োজন যাতে তাদের ভুলের জন্য কোন পরিবারের ক্ষতি না হয়।
সুন্দরবন পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ওবায়দুল হক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমাদের সকল প্রকারের ব্যবসা পরিচালনার লাইসেন্স রয়েছে। কিন্তু যারা ফেসবুক কিংবা অনলাইনে বিভিন্ন পোকামাকড় দমনে কীটনাশক বিক্রি করছে, তাদের কোন কাগজপত্র নেই। তাদের ব্যাপারে প্রশাসনের প্রত্যক্ষভাবে নজরদারি প্রয়োজন।
যা বলছে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) বিকাশ চন্দ্র দাস চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: যারা ভ্যানে বা গাড়িতে, ভ্রাম্যমাণভাবে পোকামাকড় দমনের কীটনাশক বিক্রি করছে- তারা শুধু বিক্রেতা । তারা কেউ কীটনাশক উৎপাদন বা বাজারজাত করে না। যারা বা যেসব অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান এসব উৎপাদন ও বাজারজাত করছে, পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যামে যারা এই ব্যবসা করছে তাদের বিরুদ্ধে তথ্য পেলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।
পুলিশি নদরজারি
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার (লালবাগ) মশিউর রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: বসুন্ধরায় বালাইনাশক ওষুধের বিষক্রিয়ায় দুই ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনার মামলায় ডিসিএল পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরহাদুল আমিন, চেয়ারম্যান আশরাফুজ্জামান ও কর্মী টিটু মোল্লাকে গ্রেপ্তার করে লালবাগ বিভাগ পুলিশ। বর্তমানে তিনজন কারাগারে রয়েছেন।
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনিবন্ধিত পেজ ও প্রতিষ্ঠানের নজরদারি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন: আমাদের অভিযান চলছে। অনলাইনে যারা এসব ব্যবসা করছে তাদেরকেও নজরদারিতে রাখছে ডিবির সাইবার বিভাগ।
চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট না হওয়ার আহ্বান
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. ফরিদুল হাসান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে মূলত পোস্ট বুস্ট করে ভোক্তাদের আকৃষ্ট করা হচ্ছে। আমরা জনসাধারণের সচেতনকার জন্য প্রজ্ঞাপন দিয়েছি। সেখানে আমাদের দুজন কর্মকর্তার ফোন নাম্বার দেওয়া আছে, তাদের সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ নেয়ার কথা জানিয়েছি।
তিনি বলেন: বসুন্ধরায় দুই ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনার পর আমরা নজরদারি বৃদ্ধি করেছি। গত দুমাসে অনিবন্ধিত ব্যবসায়ীরা দৌরাত্ম্য অনেকাংশেই কমেছে। এজন্য প্রশাসন ও পুলিশ কাজ করছে। এরসাথে দেশের জনগণও অনেকাংশে এখন সচেতন। তারা বিভিন্ন সময় পরামর্শ নেওয়ার জন্য আমাদের ফোন দিচ্ছে।
কৃষিবিদ ফরিদুল হাসান বলেন: ২০১৮ সালের বালাইনাশক (পেস্টিসাইডস) আইনে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স ছাড়া বালাইনাশক আমদানি, উৎপাদন, পুনরুৎপাদন, মোড়কজাতকরণ, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি পরিচালনা, বিজ্ঞাপন প্রচারসহ কোনো কাজই করতে পারবে না।
অনলাইনে পোকামাকড় দমনে চটকদার বিজ্ঞাপনে ভোক্তাদের আকৃষ্ট না হওয়ার আহ্বানও জানান তিনি।