চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘স্বর্ণযুগ মানে পেছনে ফিরে তাকানোর গল্প না’

নতুন বছরে নির্মাতার ভাবনা:

ফিল্মমেকার হিসেবে আমি নতুন নির্মাতা। এর আগে টেলিভিশনের কাজ করেছি। প্রায় ১৪ বছর আগে ফিকশন নির্মাণ শুরু করেছিলাম, ২০১০ পর্যন্ত ফিকশন নির্মাণ করেছি। ৭/৮ বছর ধরে আমি নিয়মিত বিজ্ঞাপন নির্মাণ করছি। আমার কাছে মনে হচ্ছে সারা বিশ্বে এই মুহূর্তে এক ধরনের ট্রানজিশন পিরিয়ড চলছে। আমরা এমন একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি সেটা একটা ভয়ঙ্কর রেভ্যুলেশন বলা যায়, অনেক দিক থেকে। কমুনিকেশনে আমরা একটা অদ্ভুত পজিশনে চলে আসছি। এখন আমরা যেকোনো কিছুর সাথেই কানেক্ট করতে পারি, নানা মিডিয়াম তৈরি হয়েছে যোগাযোগের। ফেসবুক টুইটার ভাইবারসহ এরকম অসংখ্য মিডিয়ামের মাধ্যমে আমরা ইন্টারন্যাশনালি কানেক্ট হতে পারি। আর এই কানেকশনের গল্পটা আমাদেরকে অন্য একটা জায়গায় এগিয়ে নিয়ে গেছে।

এখন আমরা যেটা দেখতে পারি, সেটা আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগে সম্ভব ছিল না। তখন যদি কেউ চলচ্চিত্র দেখতে চাইতেন তাকে আসলে কোন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে ছবিটা দেখতে হতো। বিদেশি ছবি দেখলে হয়তো তাকে জার্মান কালচারাল সেন্টার, অঁলিয়স ফ্রঁসেজ অথবা থিয়েটারে যেতে হতো। এরকম কিছু নির্দিষ্ট জায়গা ছিল যেখানে আমরাও ইউরোপিয়ান বা বিভিন্ন ভাষার সিনেমাগুলো দেখতে পেতাম। আমাদের আগের জেনারেশনে এভাবেই বিদেশি সিনেমাগুলো দেখেছেন। জেনারেশন চেঞ্জ হওয়ার কারণে এখন আমার নানা মাধ্যমে চলচ্চিত্র দেখে ফেলতে পারছি। সেটা এই মুহূর্তে যে কোন হিন্দি ফিল্ম থেকে শুরু করে হলিউডের সবচেয়ে লেটেস্ট ফিল্ম, এমনকি পৃথিবীর যেকোনো ছবি এখন আমার-আপনার হাতের নাগালের মধ্যে। এইযে দেখাদেখির যে ব্যাপার এটা এখন বিরাট পরিবর্তনে রূপ নিয়েছে। মানুষের চিন্তা এবং মানুষের চাহিদা চেঞ্জ হয়ে গেছে। তো এখন যদি আমরা আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে পেছনে পড়ে থাকি সেটা আসলে এই সময়ে দৃশ্যত কোন কাজই করবে না।

আমাদের চলচ্চিত্রে এই মুহূর্তে যারা নীতিনির্ধারকরা আছেন, তারা এখনো মনে করছেন ‘স্বর্ণযুগ’ ফিরিয়ে আনা উচিত! কিন্তু যে সময়টাকে আমরা পেছনে ফেলে এসেছি সেই সময়টাকে এই সময়ে বাস করে (এক বিংশ শতকের তৃতীয় দশক) আবার ফেরত আনা কতোটা যৌক্তিক চিন্তা? স্বর্ণযুগে ফিরে যাওয়ার চেয়ে এই সময়ে থেকে আমাদের চলচ্চিত্রে নতুন করে স্বর্ণযুগ সৃষ্টি করাইতো বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে আমার মনে হয়। দর্শকের রুচির বিরাট পরিবর্তন হয়ে গেছে, তার টেস্ট দেখে সিনেমা বানাতে হবে। এই সময়ের দর্শকের রুচির সাথে মার্চ করে আমাকে সিনেমা নির্মাণ করতে হবে, তাহলেই নতুন করে স্বর্ণযুগ তৈরী হবে। স্বর্ণযুগ মানে কিন্তু পেছনে ফিরে তাকানোর গল্প না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি পেছনের যেই যুগকে ফিরিয়ে আনার আবাহন থাকে, তা ফিরে পেলে আমাদের জন্য বা আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য আনন্দদায়ক কিছু ঘটবে না! চলতি সময়ে সিনেমার যে ভাষা, তার সাথে আমাদের সিনেমার যে কমিউনিকেশন দরকার সেটাই এই মুহূর্তে মোক্ষম। তার জন্য আমাদের চলচ্চিত্র কে আধুনিক করা ছাড়া কোন উপায় নেই।

এই মুহূর্তে গড়ে প্রতি বছরে পঞ্চাশটা সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে, কিন্তু তারমধ্যে বেশির ভাগ ছবিই অনাধুনিক। এই অনাধুনিক সংখ্যাটা বছরে যতো কমে আসবে আমাদের চলচ্চিত্র ততো আধুনিক হবে। আর আমাদের সিনেমা যতো আধুনিক রূপ পাবে, ততোই সিনেমার দর্শক আবার নতুন করে হলে যাবে। এখনকার দর্শক কারা? এটাও ভাবতে হবে। দেখবেন এখন যারা সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখেন তাদের বেশির ভাগই ইউনিভার্সিটি, কলেজ পড়ুয়া। তারাই বাংলার আধুনিক সিনেমার দর্শক। এই দর্শকগুলো কিন্তু এখন চাইলে পৃথিবীর যেকোন সিনেমা দেখে ফেলতে পারেন। নেটফ্লিক্সসহ আরো বড় বড় প্ল্যাটফর্ম তাদের হাতের মুঠোয়। তো এই দর্শককে আমি দুর্বল ছবি দেখালে সে থাকবে না, তার মধ্যে সেই ছবিটি নিয়ে আগ্রহই তৈরি হবে না, তো তার জন্য আমার দেশের আমার গল্পের আধুনিক ছবি লাগবে। এমন সিনেমা যদি আমরা করতে না পারি এবং সেই গতানুগতিক স্টাইলেই সিনেমা দিতে থাকি তাহলে ২০১৯ সালের মতই প্রতিটা বছর বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য এভাবে ধ্বস নিয়ে আসবে।

২০২০ সাল নিয়ে আলাদাভাবে বলতে গেলে, এ বছরেই সবচেয়ে বেশি সিনেমা রিলিজ হবে বলে আমি মনে করি। আমার কাছে মনে হচ্ছে এই বছর বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। রেভ্যুলেশন কখন ঘটে যায় সেটা আমরা বুঝতে পারবো না; কোন্ সময়ের ভিতর দিয়ে সেটা ঘটে যাচ্ছে বা ঘটে গেছে বা শুরু হলো, স্পেশালি আর্ট এর ক্ষেত্রে। আমার কাছে মনে হয় এই বছরের পরবর্তী সময়ে আমাদের সিনেমার জন্য নতুন নির্মাতা নতুন গল্প এগুলোর ভেতর দিয়ে আমরা আমাদের অঞ্চলের গল্পটা আধুনিকভাবে বলার, দেখানোর মতো অবস্থার দিকে যেত পারবো। আধুনিক সিনেমা মানে এই না যে পাশ্চাত্য থেকে ফলো করলে সেটা হয়ে যাবে! আধুনিক সিনেমা হল আমার মনের যে গল্পটা আমি বলতে চাই, আমার গ্রাম ও শহরের যে গল্পটা বলতে চাই, নিজের সময়ের গল্পটা বলতে চাই, যেখানে আমি উপস্থিত আছি। সিনেমা আধুনিক হয়ে উঠলে ‘স্বর্ণযুগ’ খুঁজতে আর অতীতেও ফিরে যেতে হবে না!

লেখক: মেজবাউর রহমান সুমন, নির্মাতা

অনুলিখন: মিতুল আহমেদ