সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই অভ্যাসমত সাইড টেবিল থেকে ফোনটি হাতে নিয়ে ই-মেইলগুলোর শিরোনাম দেখে নিচ্ছিলাম, কোন জরুরি বার্তা এলো কিনা। এরপরে ফেসবুকের বাটন চাপতেই চোখ আটকে গেল অগ্রজ হাসান মাহমুদের পোস্ট করা একটি ছবিতে। ওটি ২০০৪ সালের ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা থেকে শেখ হাসিনাকে বাঁচানোর জন্য আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের তৈরী করা মানববর্মের ছবি। ছবিটির ক্যাপশনে হাসান মাহমুদ লিখেছেন, “লৌহ কঠিন সেই মানববর্ম! আমার উপর দিয়ে যাক, নেত্রীর কিছু না হয়! ভয়ঙ্কর মুহূর্তে এমন অনিন্দ্য মানববর্ম আর আছে ইতিহাসে?” না হাসান মাহমুদ, আমার জানা মতে নেই!
মান্যবরেষু শেখ হাসিনা, মানুষ নিজ শরীর দিয়ে ঢাল তৈরী করে আপনাকে বাঁচায়! কত বড় সৌভাগ্যবতী আপনি! মানুষের এতটা আস্থা-ভালবাসা আপনি অর্জন করেছেন! ২১শে আগস্টের সেই ভয়াল মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আপনার দিকে ছুটে আসছে বিষ্ফোরিত গ্রেনেডের জ্বলন্ত লোহার টুকরো, মুহূর্তে চারিদিক থেকে আপনাকে ঘিরে ফেললো দলীয় নেতা কর্মীরা! নিজের জীবন যায় যাক, কিন্তু আপনাকে বাঁচাতে চায় তাঁরা! ঐ মানববর্ম তৈরিকারীদের কেউ কেউ সেদিন মরেও গিয়েছিলেন, আপনাকে বাঁচাতে গিয়ে! মাননীয় শেখ হাসিনা আপনার কাছে কি চাওয়া তাঁদের? আপনি বাঁচলে বা মরলে তাঁদের লাভ-লোকসানটা কি? কেনো তাঁরা নিজে মরেও আপনাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়? মানুষ তাঁদের নিজ জীবন তুচ্ছজ্ঞান করে আপনাকে রক্ষা করে, তার কারণ কি? এত বড় আত্মত্যাগ ফেরৎ দিতে আপনি প্রস্তুততো?
শেখ হাসিনা, আপনার পিতাকেও বাংলার মানুষ একাধিকবার রক্ষা করেছিলো। বাঙ্গালীর আত্মত্যাগের সে ঋণ নিজ জীবন দিয়ে আপনার পিতা শোধ করে গেছেন। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ঘরে ঘরে আপনার পিতার জন্য দুর্গ প্রস্তুত ছিলো। স্মরণ করি ১৯৬৮ সাল, আইয়ুব শাহীর চক্রান্তে আপনার পিতাকে ফাঁসানো হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়। পাকিস্তানিরা সেদিন বুঝেছিলো যে, মুজিবের কন্ঠ দিয়েই বাঙালীর অধিকারের কথাগুলো বের হয়। তো সে কন্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া যাক্! না, পাকিরা সেটা পারেনি! কারণ বাংলার সাড়ে সাতকোটি মানুষও বুঝেছিলো, মুজিব মরলে দেশ-মাতাও মরবে! তাঁরা ছিনিয়ে এনেছিলো সেদিন আইয়ুবের কারাগার থেকে আপনার পিতাকে, কপালে লটকে দিয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু’ তিলকটি।
আরো স্মরণ করি, ১৯৭১ এর ২৬ মার্চের প্রথম লগ্নে সেই পাক সামরিকজান্তা আপনার পিতাকে তুলে নিয়ে গিয়ে একেবারে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিলো। পূর্ব বাংলায় ঐ পিশাচেরা চালালো নৃশংস হত্যাকাণ্ড! বাঙালীর লাশ তখন শকুনের খাদ্য, মা-বোনের শরীর পাকিরা খায়! কি ভয়াল-বিভীষিকাময়, কি নিদারুণ যন্ত্রনার নয়টি মাস! কেউ কি ভেবেছিলো সেদিন শেখের বেটার বাংলা স্বাধীন হবে, তিনি আর কখনও ফিরবেন তাঁর প্রিয় বাংলার মাটিতে? কিন্তু দেখুন শক্তিধর বাঙালীর কি অপার ক্ষমতা! আপনার পিতার অনুপস্থিতিতেই নিরস্ত্র বাংগালী নিজেদের সেদিন সশস্ত্র যোদ্ধায় পরিনত করলো! মাত্র ন’মাস যুদ্ধ করে একটি স্বাধীন দেশের মানচিত্র এঁকে দিলো তাঁরা! আপনার পিতাকেও বাঙালী মুক্ত করে এনেছিলো পাকিস্তানের কারাগার থেকে! শুধু তাই নয় শেখ হাসিনা, সেই স্বাধীন দেশটিকে তাঁরা সেদিন আপনার পিতার হাতেই তুলে দিয়েছিলো!
সময় পাননি আপনার পিতা দেশটি গড়ার, তার আগেই তাকে সরিয়ে দেওয়া হলো। কালের পরিক্রমায় দেশের মানুষ আজ আপনার হাতে দেশটি তুলে দিয়েছে। আপনি যথেষ্ট সময়ও পেয়েছেন দেশ গড়ার, দায়িত্ব পালনের সাধ্যমত চেষ্টাও করছেন আপনি। করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আপনাকে কাজ সমাপ্ত করতে প্রয়োজনীয় সময়টুকু বরাদ্দ করেন। বারে বারে আপনাকে নাম ধরে সম্বোধন করছি, ওরকম করে বলাটা আমার ‘প্রথম পছন্দ’ নয়। আমি আপনাকে ‘শেখের বেটি’ বলে ভাবতেই স্বস্তিবোধ করি এবং ঐ নামেই ডাকতে চাই।
দেখুন শেখের বেটি, স্বার্থ ছাড়া মানুষ খামাখা আপনার জন্য জীবন দেয়নি, আর কখনও তা দেবেও না। এখন আপনি রাজক্ষমতায়, আপনাকে নিয়ে কত সব আড়ম্বর, পাইক-পেয়াদা, বরকন্দাজ, চাটুকার, নব্য আওয়ামী লীগার, তথাকথিত সব দেশপ্রেমিকেরা আপনাকে ঘিরে, কতসব সাড়ম্বর চারিদিকে! রাষ্ট্রিয় হালুয়া-রুটির বিতরণকারী আপনি, নানা রংয়ের মৌমাছিরা আপনার চারিদিকে। (আল্লাহ না করুন) এ মুহূর্তে আপনার দিকে যদি তীক্ষ্ম কোন বুলেট ছুটে আসে, তো এই মৌমাছি দলের ক’জনকে পাওয়া যাবে, যারা আপনাকে ঘিরে মানববর্ম তৈরী করবে? বর্ম যাঁরা তৈরী করে, হালুয়া-রুটির ভাগে তাঁদের আগ্রহ নেই। এই বর্মওয়ালাদের একটিই চাওয়া আপনার কাছে, তাঁদের জন্য ‘সোনার বাংলা’ গড়ে দিতে হবে, আর কিছুটি নয়।
সাবধান শেখের বেটি, আজ এত বছর পরে আবার আপনার ভাগের কম্বলটি কিন্তু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! দেশজুড়ে ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা তান্ডব চালাচ্ছে, যুবলীগের নৈরাজ্য চারিদিকে, টেন্ডারবাজি, ঘুষ, দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে দেশ। আপনার ক্ষমতাশালী রাজাকার আত্মীয়দের কুপ্রভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি প্রবীর সিকদারদের হাতে হাতকড়া, ধর্মান্ধদের উদ্যত তরবারি মুক্তমনা লেখকদের বক্ষ এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছে প্রতিদিন, আপনি কি জানছেন না সে সব খবর? বলি কি, যদিও বা ভাগের কম্বলটি খুঁজে পান, অনুগ্রহ করে ওটি মুড়ি দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমুবেন না! আমরা যে আপনার সুরক্ষা নিয়ে বড়ই দুশ্চিন্তায় আছি!
শেখের বেটি, সারা ঘর লেপেপুছে দরজায় কাঁদা রাখলে চলবে কেন? এত খাটাখাঁটুনি করে দেশের অর্থনীতির চাকা সোজা রাখলেন, বীরাঙ্গনার তেজে জ্বলে উঠে বিশ্বের শক্তিধরদের বুড়ো আঙ্গুলটি দেখিয়ে নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানানোর সাহস দেখালেন, রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীগুলোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশটিকে ফিরিয়ে আনলেন, শেখের বেটার যোগ্য কন্যা আপনি। আরেকটু শক্ত না হলে দেশটি এগুবে কেমনে? আপনি পরাজিত হলে দেশ পরাজিত হয়, জাতির সম্মান যায়, মুক্তিযুদ্ধ অস্তিত্ব হারায়, সে কি আপনার অজানা? এ দুর্ভাগা জাতির সর্বশেষ ভরসার জায়গাটি যে আপনিই। শেখের বেটি, আপনিও জানেন: ‘দুর্জন, স্বজন হলেও পরিত্যাজ্য’। দেশ জেগে আছে আপনার জন্য, প্রয়োজনে শত সহস্র মানববর্ম তৈরী থাকবে। তবে তা সেজন্যে চাটুকার আর দুর্জন-স্বজনদের ত্যাগ করতে হবে!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)