মিয়ানমারের রাখাইনে গত ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এই সেনা অভিযানে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে পাচঁ হাজার মানুষ। জীবন বাঁচাতে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মধ্যে হাজার হাজার শিশু। ওই শিশুদের সামনে তাদের বাবা-মাকে হত্যা করা হয়েছে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মাইলের পর মাইল পাহাড়ি পথ হেঁটে তারা অনেকে আশ্রয় পেয়েছে বাংলাদেশে। তবে এখনও রোহিঙ্গাদের গন্তব্য অনিশ্চিত। বিশ্ব গণমাধ্যম যেমন জানে না রোহিঙ্গারা শেষ পর্যন্ত ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, আর বাংলাদেশও জানে না কতদিনে এই রোহিঙ্গারা নিজেদের ঘরে ফিরতে পারবে।
দীর্ঘ এই একমাসের বিপর্যস্ত পরিস্থিতির পরও রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের কাছে অনেক দেশের ত্রাণ সহায়তা পৌঁছালেও কেউই মিয়ানমারকে সেভাবে চাপ দিচ্ছে না। তাই মিয়ানমার এখনও স্পষ্ট করে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে কিছুই বলেনি।
এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে নিজেদের মন্তব্য জানিয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। আন্তর্জাতিকভাবে প্রবল সমালোচনার মুখে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অংশ না নিয়ে ১৯ সেপ্টেম্বরে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন সু চি। ভাষণে অং সান সু চি বলেন, ৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে রাখাইনে আর কোন সহিংসতা চলছে না। সু চি বলেন, দেশের বেশিরভাগ সংখ্যালঘু মুসলিমই মিয়ানমার ছেড়ে যায়নি। এছাড়া মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের নেতা অং সান সু চি বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি আন্তর্জাতিক সমালোচনায় ভীত নন।
এরপর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিয়ে ৫ দফা প্রস্তাবনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বনেতৃত্বের সামনে তিনি পাঁচ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন। প্রস্তাব গুলো হলো: অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারের জাতিগত নিধন নিঃশর্তে বন্ধ করতে হবে। দ্রুত মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের একটি বিশেষ অনুসন্ধানী দল প্রেরণ। জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মিয়ানমারের সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং এ লক্ষ্যে জাতিসংঘের তত্বাবধায়নে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিশেষ সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলা। রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত সকল রোহিঙ্গার নিরাপদে ঘর-বাড়িতে প্রত্যাবর্তন এবং পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। কফি আনান কমিশনের প্রস্তাবনা দ্রুত এবং নিঃশর্ত বাস্তবায়ন করা।
এছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ বিশ্বনেতারা আহ্বান জানান। রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরত নিতে মিয়ানমারকে আহ্বান জানান তারা। কিন্তু এরপরও মিয়ানমার যেন এসব কিছুকে পাত্তাই দিচ্ছে না।
রোহিঙ্গাদের এসব পরিস্থিতি ও অজানা গন্তব্য বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়্যারম্যান এহসানুল হক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, এই সমস্যা উদ্ভুত হয়েছে খুব দ্রুত। কিন্তু এত দ্রুত সেটার সমাধান করা যাবে না। তাই সমাধান করতে হবে সময় নিয়ে। বাংলাদেশ সরকারও সেটা একা করতে পারবে না। এজন্য আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।
‘তারা যেহেতু মিয়ানমারের নাগরিক তাই মিয়ানমারকেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে। চীন, রাশিয়া ও ভারত সহায়তা না করলে তাদের ফেরানো খুব কঠিন হয়ে পড়বে। সেজন্য অন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেমন চাপ দিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে তেমনই মিয়ানমারের সঙ্গেও আলোচনার দ্বার সবসময় খোলা রাখতে হবে। এবার বাংলাদেশ যে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে সেটা আর কখনও করেনি। তাই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে খুব সতর্কভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
শরণার্থী শিবির নির্মাণ
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আবাস তৈরির জন্য কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং মৌজায় বর্তমান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে নতুন করে ২ হাজার একর জমি বরাদ্দের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে এ তথ্য জানান। এছাড়া তাদের ত্রাণ কার্যক্রম ও পুনর্বাসনে ইতোমধ্যে কাজ করছে সেনাবাহিনী।
অন্যদিকে কক্সবাজারের কাছে কুতুপলং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের ঠিক উল্টো দিকে আরেকটি জরুরি শরণার্থী আশ্রয় গড়ে তোলার কাজ শেষ করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। নতুন আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যারা এখানে তাবু টানিয়ে থাকতে শুরু করেছিলেন, ইউএনএইচসিআরের এই জরুরি আশ্রয়ে তাদেরকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। এছাড়া বালুখালী ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের জন্য ১৪ হাজার তাঁবু তৈরি করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) রোববার থেকে এসব তাঁবু তৈরির কাজ শুরু করেছে।
ত্রাণ কার্যক্রম
গত একমাসে রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে ত্রাণ এসেছে। এসব দেশগুলো হলো-
তুরস্ক: এরই মধ্যে তুরস্ক সরকারের পাঠানো এক হাজার টন ত্রাণ কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের দেখে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনে এরদোগান। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ১০ হাজার টন ত্রাণ পাঠানোর কথা রয়েছে তুরস্কের। এক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে তুরস্ক। এছাড়াও দেশটি রোহিঙ্গাদের জন্য শিগগিরই ১৩টি আইটেমের সমন্বয়ে তৈরি ১০ হাজার প্যাকেট ত্রাণ সামগ্রী প্রদান করবে।
ডেনমার্ক: মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা দিতে ডেনমার্ক সরকার জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)-কে ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ডব্লিউএফপি ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর মাধ্যমে ডেনিস ত্রাণ সহায়তা শরণার্থীদের কাছে পৌঁছাবে।
মালয়েশিয়া: মিয়ানমার থেকে নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে দেড়শ পরিবারের হাতে মালয়েশিয়ার ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ১২ টন ত্রাণ পাঠায় মালয়েশিয়া সরকার। একটি সামরিক উড়োজাহাজে করে তারা ত্রাণ নিয়ে আসে বাংলাদেশে।
ইরান: বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য কার্গো বিমানে করে ত্রাণ পাঠানোর কথা রয়েছে ইরানের। ইরানি কার্গো বিমান অবতরণের অনুমতি চেয়ে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন করেছে ইরান, যা খুব শিগগিরই অনুমতি মিলবে বলে ঢাকায় ইরান দূতাবাস জানিয়েছে। ইরানি ত্রাণ সামগ্রীর মধ্যে শুকনো খাবার, ওষুধ ও কাপড় থাকছে।
আজারবাইজান: সেনা অভিযানের মুখে প্রাণের ভয়ে মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে আজারবাইজান সরকার। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা লাখ লাখ সহায় সম্বলহীন বিপন্ন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মানবিক সহায়তা দিতে জরুরি ভিত্তিতে ১০০ টন খাদ্য সামগ্রী পাঠিয়েছে আজারবাইজান। ত্রাণ নিয়ে শনিবার আজারবাইজান থেকে সিল্ক ওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের বিশেষ কার্গো বিমানে ঢাকায় এসে পৌঁছেছে।
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম এলিয়েভের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ সহায়তা হিসেবে পাঠানো প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যের এসব খাদ্য সামগ্রী কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করা হবে। পরে স্থানীয় জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এসব খাদ্য সামগ্রী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
অস্ট্রেলিয়া: এছাড়া ত্রাণ সামগ্রী পাঠানোর কথা রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও অস্ট্রেলিয়ার। সঙ্কট মোকাবেলায় রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ত্রাণ সহযোগিতা অস্ট্রেলিয়া দেবে বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলিয়া বিশপ।
কানাডা: সেনা অভিযানের মুখে রাখাইন থেকে উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কানাডা ফেডারেল সরকার। উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ১ মিলিয়ন ডলার দেবে দেশটি।
ইউনিসেফ: রোহিঙ্গা শিশু ও তাদের পরিবারের জন্যে ইউনিসেফের জরুরী ত্রাণ সামগ্রীবাহী প্রথম চালানবাহী প্লেনটি ২৪ অগাস্ট কোপেনহেগেন থেকে ঢাকায় পৌঁছে।
প্লেনটি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পারিবারিক হাইজিন কিট, স্যানিটারি’সামগ্রী, তারপলিন এবং শিশুদের জন্যে বিনোদনসামগ্রী সহ ১০০ টনের চালান নিয়ে আসে।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বহুদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশন অং সান সু চির কাছে জমা দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট। ৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন না করতেই মিয়ানমার সরকার কথিত হামলার অভিযোগে এই নিধনযজ্ঞ শুরু করে।