লিবিয়ার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত ও ভঙ্গুর এবং মিশরের মতো অর্থনৈতিভাবে ক্রমশ পিছিয়ে পড়া দেশে শ্রমিক পাঠানোর নামে লাখ লাখ টাকা নেয়ার অভিযোগ উঠছে। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে এসব দেশে নেয়ার নামে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা নেয়া হচ্ছে। আর এই কাজের সাথে জড়িত বাংলাদেশ ও সুদানে থাকা দালাল চক্র।
সুদানের রাজধানী খার্তুমে জাতিসংঘের একটি সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশি এক কর্মকর্তা শাহীন জানান, দালালের একটা অংশ থাকে বাংলাদেশে, আরেকটা অংশ সুদানে। দেশিয় দালালরা লিবিয়া, মিশর ইত্যাদি দেশে পাঠানোর নাম করে ৫-১০ লাখ টাকার চুক্তিতে মানুষের পাসপোর্ট সংগ্রহ করে। পাসপোর্টের ফটোকপি পাঠিয়ে দেয় সুদানে অবস্থান করা বাংলাদেশি দালালদের কাছে। তারা সেখানে সুদানের কিছু অসাধু কোম্পানির সাথে চুক্তিতে চাকরির নামে স্টিকার ভিসা বের করে।
তিনি আরো জানান, মূলতঃ কোম্পানিগুলোতে চাকরির কোনো ব্যবস্থা নেই। কোম্পানির চুক্তিমতে, তারা প্যাসেঞ্জারদের এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে দালালদের হাতে দিয়ে দেবে এবং পাসপোর্ট-ভিসা জব্দ করে নিয়ে যাবে। কারণ কোনো কারণে যদি সুদানী পুলিশ প্যাসেঞ্জারদের পাসপোর্ট-ভিসা পায়, তবে এসব কোম্পানির চাকরীর দেয়ার নাম করে ভিসা বের করার চুরি ধরা পড়ে যাবে। তাতে কোম্পানি লাইসেন্স হারাবে এবং শাস্তি পাবে।
শাহীন আরো জানান, সাধারণতঃ চট্টগ্রাম থেকে প্যাসেঞ্জারদের ফ্লাইট করানো হয়। সুদানের রাজধানী খার্তুম এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনের পর ওসব কোম্পানি প্যাসেঞ্জারদের রিসিভ করে পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে যায়। আর এদিকে দালালরা পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া প্যাসেঞ্জারদের খার্তুমে ছেড়ে দিয়ে বলে, তোমরা কয়দিন লুকিয়ে এখানে কাজ করো, তোমাদের লিবিয়া বা মিশরের ভিসার ব্যবস্থা করতেছি; যেটা আসলে সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত ভাওতাবাজি।
এরকম প্রতারণার শিকারদের আবার দালালরাই পুলিশে ধরিয়ে দেয় উল্লেখ করে শাহীন জানান, প্রবাসীরা পৌছানোর কয়েকদিন পর এই দালালরাই পুলিশে ইনফরমেশন দিয়ে অবৈধ প্রবাসীদের পুলিশে ধরিয়ে দেয়। প্রবাসীদের কোর্টে নেয়া হলে জনপ্রতি প্রায় ৫শ ডলার জরিমানা করা হয়। জরিমানা অনাদায়ে তাদের তিন থেকে চার মাস জেল খাটতে হয়। তারপরও নিস্তার নেই। কেবল বিমানের টিকেটের অর্থ দেশ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে নিয়ে ম্যানেজ করে দিতে পারলেই জেল থেকে নিয়ে তাদের সাদা কাগজে বাংলাদেশি বলে এক্সিট সীল দিয়ে বিমানে তুলে দেয়া হয়।
তিনি জানান, কিন্তু পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া যে কোন অবৈধ প্রবাসী বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে দেশে ফেরার আগে বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে এনওসি দেয়ার অথরিটি কেবল বাংলাদেশ এম্বেসী সংরক্ষণ করে। অথচ সুদানে বাংলাদেশ অ্যাম্বাসী না থাকায় সুদানী পুলিশ এ পক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে না। আবার এরা বাংলাদেশি কি-না এ সার্টিফিকেটও সুদানী পুলিশ দিতে পারে না। এ ধরণের সুযোগ দেয়া হলে অন্য দেশের নাগরিকও বাংলাদেশে ঢুকে যেতে পারে বা পাঠিয়ে দিতে পারে। সঙ্গতকারণে বাংলাদেশে আসার পর বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনও পড়ে বিপাকে। আইনতঃ তারা প্যাসেঞ্জারদের বাংলাদেশে ঢুকতে দিতে পারে না, ফেরত পাঠাতে হয়।
জাতিসংঘের এই কর্মকর্তার মতে, সুদানে বাংলাদেশ অ্যাম্বাসী না থাকলেও সুদানের এসব কার্যক্রম দেখাশোনার দায়িত্ব সৌদির রিয়াদে বাংলাদেশ অ্যাম্বাসীর। তিনি রিয়াদ অ্যাম্বাসীর সাথে বহুবার ফোনে যোগাযোগ করে যাচ্ছেন।
অ্যাম্বাসীর পরামর্শ মতে, শাহীন বর্তমানে জেলখানার প্রায় দেড়-দু’শো বাংলাদেশির ন্যাশনাল আইডি, ভোটার আইডি দেশ থেকে আনিয়ে অ্যাম্বাসীতে মেইল করলেও অদ্যাবধি তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। অ্যাম্বাসীর লিগাল কর্মকর্তা তাকে বলেছেন, এ কাগজগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যাচাই করে তারপর জানানো হবে।
তবে কবে নাগাদ হবে, সে বিষয় যদিও এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে। রিয়াদের বাংলাদেশ অ্যাম্বাসী থেকে এ পর্যন্ত কেউ বিষয়টি সুরাহা করতে আসেননি মর্মেও জানান শাহীন।
তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, কেবল খার্তুমেই ৫ হাজারের বেশী বাঙালী অবৈধ প্রবাসী রাস্তাঘাটে মানবেতর জীপন যাপন করছে। প্রতিনিয়ত পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে জেলে দিচ্ছে। কিন্তু কোনো সমস্যারই কুল কিনারা হচ্ছে না।
শাহীনের মতে, দেশি-বিদেশি এ দালাল চক্রের দৌরাত্ম বন্ধ না করতে পারলে এ অবস্থার স্থায়ী কোনো সমাধান আসবে না।